রেস্তোরাঁর বিলে জন্ম নিল লতার প্রথম পুজোর গান! আশ্চর্য সেই ইতিহাস

Lata Mangeshkar Puja Song: খাওয়া দাওয়া হয়ে গিয়েছে। বিল দিয়ে গিয়েছে ওয়েটার। সেই বিল টেনে নিয়েই লিখতে শুরু করলেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়। লেখা হল এক কালজয়ী গান— ‘রঙ্গিলা বাঁশিতে কে ডাকে’।

সময়টা পাঁচের দশকের দ্বিতীয়ার্ধ। ‘রাইকমল’ ছবি অত্যন্ত হিট হওয়ার পরপর ছবির অফার পাচ্ছেন কাবেরী বসু। তখনও আঠেরো বছর বয়েস হয়নি তাঁর। কিন্তু একের পর এক অভিনয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন, দাগ রেখে যাবেন। সে সময় দেবকী বসুর সহকারী রতন চট্টোপাধ্যায় ‘অসমাপ্ত’ নামে একটি সিনেমা করবেন বলে ঠিক করলেন। নায়ক প্রবীর কুমার, নায়িকা কাবেরী বসু। এ ছবির সঙ্গীত পরিচালনা করতেই ভূপেন হাজারিকার কলকাতায় আসা। গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ির কাছেই লিলুয়ায় প্রযোজকদের একটি চমৎকার বাগানবাড়িতে সস্ত্রীক এসে উঠলেন ভূপেনবাবু। এইখানে বলে রাখি, ভূপেন হাজারিকার স্ত্রী প্রিয়মের নৃত্যশিল্পী হিসাবে বেশ খ্যাতি ছিল। একটা বাংলা ছবিতে অভিনয়ও করেছিলেন সম্ভবত। তা সেই প্রথম গীতিকার আর সুরকারে পরিচয়। প্রথম দর্শনেই বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেল দুজনের।

এর পরেপরেই বাংলা গানের জগতে একটা বিশেষ ঘটনা ঘটবে। কী সেই ঘটনা? সবুর সবুর! সরোজ মুখার্জির ‘ঘুম’ ছবিতে সহ প্রযোজক ছিল কলকাতার ইস্টার্ন ইন্ডিয়া মোশন পিকচার্স অ্যাসোসিয়েশন। তার প্রাক্তন অধিকর্তা কে কে চৌধুরি নিজে ‘কড়ি ও কোমল’ নামে একটা ছবির কাজ শুরু করেছেন। তাতে নায়ক রবীন মজুমদার আর নায়িকা কমলা চট্টোপাধ্যায়। গীতিকার হিসেবে ঠিক হল পুলকবাবুকেই নেওয়া হবে। ডাকলেন ওঁদের নিউ আলিপুরের বাড়িতে। একথা সেকথার পরে সম্পূর্ণ চিত্রনাট্য শোনা গেল। কথায় কথায় পুলকবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “মিউজিক কে করছে?” জানা গেল, সেটা তখনও ঠিক হয়নি। সবাই মিলে পুলকবাবুকেই ধরলেন, “আপনিই বলুন না— কাকে নিলে ভালো হয়?” ভূপেন হাজারিকার নামটা প্রস্তাব করলেন। কে কে চৌধুরি নিজেও গুয়াহাটির বাঙালি। ভূপেনবাবুর নাম বলতেই লাফিয়ে উঠলেন, “কারেক্ট কারেক্ট। এটাই ফাইনাল। আমিও ওঁর কথাই ভাবছিলাম।”

‘এরা বটের সুর’, ‘শকুন্তলা’—একের পর এক বাংলা ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনা করছেন তখন ভূপেনবাবু। উঠে এসেছেন টালিগঞ্জে। সব শুনে পুলককে জানালেন, কোনও অসুবিধা নেই, তিনি বরং কে কে চৌধুরিকে রাজি করান। নায়িকার গানগুলো লতা মঙ্গেশকরকে দিয়ে গাইয়ে আনবেন। লতা মঙ্গেশকর! পুলকবাবু চমৎকৃত। জানতেন ভূপেন হাজারিকার সঙ্গে লতার সম্পর্ক খুবই ভালো। এর আগে “বৌ ঠাকুরানির হাট”-এ ‘শাঙনগগনে ঘোর ঘনঘটা’ দিয়ে বাংলা ছবির গানের জগতে পা রেখেছেন লতা। ভি শান্তিরামের বাংলা ডাবিং ছবি ‘অমর ভূপালি’-তেও গান গেয়েছেন। আরও দু’ একটি বাংলা ছবিতে গান গেয়ে ফেলেছেন ইতিমধ্যে। কিন্তু পুলকবাবুর কথায় একটিও গাননি। কাজেই গীতিকার এককথায় রাজি। ‘কড়ি ও কোমলে’র প্রযোজকদেরও রাজি করিয়ে ফেললেন। লেখা হল ‘তির বেঁধা পাখি/ আমি জেগে থাকি/ আহত একাকী নীড়ে’, লেখা হল ‘অস্ত আকাশে দিনের চিতা জ্বলে’।

আরও পড়ুন- স্টিয়ারিং বুকে লেগে স্পট ডেথ— সিনেমায় আর ফেরা হয়নি ছবি বিশ্বাসের

কিন্তু দুর্ভাগ্য। ‘কড়ি ও কোমল’ ছবিটা চলল না। তখন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ছবি না চললে ছবির গানও চলত না। কাজেই খুব জনপ্রিয় হয়নি সে সব গান। তবে লাভের লাভ, গীতিকারের সঙ্গে লতার যোগাযোগ। সে যোগাযোগ আর কয়েকদিন পরেই ইতিহাস তৈরি করবে, তা তখনও জানেন না কেউ। যাই হোক, ‘কড়ি ও কোমলে’র হাত ধরেই আরেকটি দরজা খুলল। সেকালে এইচএমভির রাজত্ব। বাংলায় এ রাজত্বের সবটাই দেখাশোনা করতেন পি সি সেন এবং পবিত্র মিত্র। সুরকার থেকে শিল্পী, রেকর্ডের খুঁটিনাটি তাঁদের অনুমতি ছাড়া কিচ্ছুটি করার উপায় ছিল না। ‘কড়ি ও কোমল’-এর গানগুলো ওঁদের বেশ পছন্দ হল। ডেকে পাঠালেন ভূপেনবাবুকে এইচএমভি-তে। ভূপেন বাবুর সুরে পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায় তখন একের পর এক মণিমুক্তো খেলছে। শ্যামল মিত্রের ‘চৈতালী চাঁদ যাক ডুবে যাক’, আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘তারাদের চুমকি জ্বলে আকাশে’— এসব বাঁধা হয়ে চলেছে। ঠিক সেই সময়ই হেমন্তের ছবি ‘নীল আকাশের নীচে’তে চিত্রপরিচালনার ভার নিয়েছিলেন ভূপেনবাবু। নায়কের ভূমিকায় উত্তম। তবে সে কাজ বিশেষ এগোয়নি। পরে মৃণাল সেন যখন সেই ছবি করলেন, কালী ব্যানার্জিকে কাস্ট করলেন। তার মহরতে ক্ল্যাপস্টিক দিতে লতা এলেন কলকাতায়। দমদমে পুলকবাবু, পি কে সেন, পবিত্র মিত্র— সবাই অভ্যর্থনা জানালেন। এবার তাঁকে নিয়ে আসার পালা।

সেই এয়ারপোর্টেই ইতিহাসের এক বিশিষ্ট বীজ পোঁতা হল। পুলকবাবুকে আলাদা করে ডেকে লতা এক ফাঁকে বললেন, “আমার জীবনের প্রথম পুজোর বাংলা গান রেকর্ড করে যাব। আপনার ‘কড়ি ও কোমল’ আমার খুবই ভালো লেগেছে। ভূপেনদাকে দু’টো গান দিন।” তারপর ফের সবার সঙ্গে কথাবার্তায় মেতে উঠলেন। লতা মঙ্গেশকর কলকাতায় এসেছেন, দর্শনার্থীদের বিপুল ভিড়। আলাপচারিতায় সময় যায়। প্রত্যেককেই বলছেন, “কাল মহরত, পরশু সকালেই ফিরে যাব বম্বে।” পুলকবাবু পড়লেন অথৈ জলে। তাঁকে যে বললেন গান রেকর্ড করবেন! তবে? নিজেকে প্রবোধ দিলেন, ও বড় শিল্পীদের খেয়ালি মন। অমন গানটানের কথা বলেন। কথার কথা বলেছেন তাঁকে। খুব একটা পাত্তা দিলেন না আর ব্যাপারটাকে। পরদিন মহরত। এক ফাঁকে লতা এসে ফের বলে গেলেন, “সবাই জানে আমি গ্র্যান্ডে আছি, কিন্তু আছি ভূপেনদার টালিগঞ্জের গলফ ক্লাবের ফ্ল্যাটে। ওখানে কাল সকালেই চলে আসুন।” অ্যাঁ! তাহলে কথার কথা নয়। পুলকবাবু এইবারে ব্যাপারটাকে সিরিয়াসলি নিলেন। লতার প্রথম পুজোর বাংলা গান। তাঁর হাত দিয়ে বেরোবে। ব্যাপারটা ফেলনা নয়।

পরদিন টালিগঞ্জে যথারীতি উপস্থিত গীতিকার। কথায় কথায় হাসিঠাট্টার ফাঁকে লতা জানালেন, পি কে সেন আর পবিত্র বাবু গান চাইছিলেন। লতা-ভূপেন, দু’জনেই বলেছেন পুলকবাবুর কথা। এইবার খটকার ব্যাপারটা জানালেন পুলক। “রেকর্ড করবেন কখন? আজই তো ফিরে যাবেন।” এই এতক্ষণে লতা ব্যাপারখানা ভেঙে বললেন গীতিকারকে, সবাইকে বলেছেন বটে আজকেই ফিরে যাচ্ছেন, কিন্তু তিনি আপাতত ক’দিন আছেন। রেকর্ড সেরে তারপর ফিরবেন। আসলে থাকার ব্যাপারটা জানাজানি হলে মিউজিক ডিরেক্টর, গীতিকারেরা প্রত্যেকেই গানের জন্য ধরাধরি করবেন। তখন ফেরানো মুশকিল হবে। সেই ঝামেলাটা নিতে চাইছেন না। এতক্ষণে ব্যাপারটা পরিষ্কার হল। এক বুক উল্লাস নিয়ে পুলকিত পুলক বন্দ্যো হাজির ভূপেন হাজারিকার কাছে। কিন্তু দেখা গেল ভূপেন বেশ বিরক্ত। বললেন, “রেডি গান কোথায়? নতুন গান সুর করার সময় এখন নেই।”

—একটা গান তো আমাদের আছে। ‘মনে রেখো ওগো চাঁদ।’

—ওটা আপনার লেখার উপর সুর করেছিলাম। একটুও মনে নেই। এখনই যে বসব তারও উপায় নেই। হারমোনিয়ামটা সারাতে দিয়েছি এখনও দিয়ে গেল না।

গীতিকার ছাড়বেন না। ধরে নিয়ে গেলেন তাঁকে পুলকের বড়দি’র ভবানীপুরের বাড়িতে। এ বাড়ির উঠোনে টেনিস খেলতেন খোদ উত্তমকুমার। মরসুমি ক্লাব হয়েছিল সেখানেই। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়, হেমন্ত, সুধীরলাল চক্রবর্তীরা সেই ক্লাবের সদস্য ছিলেন। ভূপেন হাজারিকা নিজেও ছিলেন সেই ক্লাবে। এ বাড়িতেই বহু জনপ্রিয় গানে হারমোনিয়াম ধরে সুর করেছেন হেমন্ত। সেই হারমোনিয়াম নিয়েই বসলেন ভূপেন। ‘মনে রেখো ওগো আধো চাঁদ’ গানটা আবার নতুন করে সুর হল। কিন্তু না। পছন্দ হল না নিজেরই। বললেন, “অসম্ভব। আর সময় নেই। রেকর্ডিং ক্যানসেল করে দিতে হবে। আমার জনতা পিকচার্সে অ্যাপয়েন্টমেন্ট। ওখান থেকে বেরিয়ে চাংওয়া রেস্টুরেন্টে খেয়ে আমি আর একটা কাজে যাব।” কী আর করেন! বেরিয়ে এলেন দু’জনেই। চৌরঙ্গীতে নেমে ভূপেন বাবু জনতায় চলে গেলেন। পুলক চৌরঙ্গিতেই কী এক তাড়নায় এদিক ঘোরেন, ওদিক ঘোরেন। অন্যমনস্ক। কী যেন ভাবছেন। পায়ে পায়ে এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে হাজির হলেন চাংওয়াতে।

একটা কেবিনে উঁকি দিতেই দেখা গেল ভূপেন হাজারিকা বসে আছেন। পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়কে ফের ফিরে আসতে দেখে প্রথমটায় চমকে গিয়েছিলেন। পরক্ষণেই হাসিমুখে ডেকে বসালেন। খাবারের অর্ডার গেল। গীতিকারের সেদিকে মন নেই। চৌরঙ্গীতে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ মাথা খুলে গিয়েছে। কাজেই মিশন ভূপেন হাজারিকায় পুলকের লক্ষ আরেকটা গান বাঁধা। বললেন, “আপনার মুখে একটা গান প্রায়ই শুনি না? ওই ‘পরহু পুয়াতে তুলো না’! এই সুরের উপর আমি এখনই একটা গান লিখতে পারব। লতাজি গাইলে কিন্তু দুর্দান্ত হবে।” এইবারে ব্যাপারটা মনে ধরল ভূপেনের। কলম সঙ্গেই আছে। কিন্তু কাগজ? খাওয়া দাওয়া হয়ে গিয়েছে। বিল দিয়ে গিয়েছে ওয়েটার। সেই বিল টেনে নিয়েই লিখতে শুরু করলেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়। লেখা হল এক কালজয়ী গান— ‘রঙ্গিলা বাঁশিতে কে ডাকে’। ভূপেনবাবু তখন অন্য মেজাজে। কেবিনে বসেই গাইছেন। চাংওয়া রেস্তোরাঁর এক মামুলি কেবিনে আলগোছে জন্ম নিল এক ইতিহাস।

আরও পড়ুন- ‘অসুস্থ তো স্টেজে নেমেছেন কেন!’ একরাশ অপমান নিয়ে চলে গিয়েছিলেন বাংলার প্রথম ম‍্যাটিনি আইডল

সেই প্রথম কলকাতায় গান রেকর্ড করলেন লতা। রেকর্ডিংয়ে কল্যাণজি-আনন্দজির কল্যাণজিও উপস্থিত ছিলেন। তিনি তখনও সুরকার হননি। বাদ্যযন্ত্রী। রেকর্ড হল দু’টি গান, ‘মনে রেখো’ এবং তার উল্টো পিঠে ‘রঙ্গিলা বাঁশিতে’। গান শুরু করার আগে স্টুডিওর মাইকে লতা বলেছিলেন, “আজ আমি ধন্য, যেখানে কে এল সায়গল প্রথম গান রেকর্ড করে গেছেন, সেই কলকাতায় আমি গান রেকর্ড করছি।” চমৎকৃত হয়েছিলেন উপস্থিত সকলেই। এই বিনয় সুর-সম্রাজ্ঞীকেই মানায়।

কথায় বলে, যে শিল্পে ব্যবহার্য সামগ্রী লাগে যত কম সে শিল্প তত উচ্চমানের। কথাটা আংশিক সত্য। বরং এইভাবে ভাবা যেতে পারে, যে আদতে প্রাচুর্যের সঙ্গে শিল্পের কোনও সম্বন্ধই নেই। একটি জেলের ভিতরে নিষ্ঠার সঙ্গে লেখা হতে পারে ‘সালো’ নামক একটি উপন্যাস যাতে চার চারটি শতাব্দী দাঁত বসাতে ব্যর্থ, মহড়া চলতে পারে রঙবেরঙের নাটকের, একটি মাত্র প্রস্তর খণ্ডে খোদিত হতে পারে এঞ্জেলোর পিয়েতা, কেবলমাত্র ডাবলিনকে শিকড়ে রেখেই গড়ে উঠতে পারে জয়েসের সিংহভাগ অক্ষরকর্ম। একটি উজ্জ্বল হলুদ রঙের খোঁজে একটা গোটা জীবন খরচ করে ফেলতে পারেন পাগল শিল্পী, একটি ঘোড়া ভূতের তাড়ায় জীর্ণ দীর্ণ হয়ে পড়েন এক প্রবল ব্যাক্তিত্বের দার্শনিক, রেখে যান বিপুল দর্শনের কাজ। তেমনই, তৃতীয় বিশ্বের এক রেস্তোরাঁর কেবিনে একটি মাত্র পেন, মন থেকে ছন্দ টেনে খাবারের একটি বিলের ওপর লেখা হয় ‘রঙ্গিলা বাঁশিতে কে ডাকে’-র মতো গান। আমাদের এক একটি পলকে ইতিহাসের এক একটি নতুন ধারার জন্ম হচ্ছে। অজস্র সে ধারার কতটুকুই বা আমাদের গোচরে আসে, কতটুকুই বা অনুভূত হয়! প্রাচুর্যের যে ধারণা মানুষ করতে সক্ষম, তা যে এই অবিরল স্রোতের কাছে কতটুকু— এই বোধ খানিক যার আছে, সেইই সৃষ্টিতে সক্ষম। আদতে শিল্প অক্ষমতার অনুভব মাত্র।

More Articles