পেটে আসছে কিন্তু মুখে আসছে না! হামেশাই শব্দ ভুলে যান আপনি? কেন এমন হয় জানেন?

Lethologica: বিজ্ঞানীরা ব্যাখ্যা করেছেন, দুই ধরনের শব্দ আছে যা প্রায়শই আমাদের এই পেটে আসছে মুখে আসছে না অবস্থায় ফেলে দেয়।

খুব সহজ সাধারণ কথা হয়তো। নিয়তই বলছেন, ব্যবহার করছেন। অথচ দরকারের সময় কিছুতেই মনে পড়ছে না? পেটে আসছে, মুখে আসছে না দশা! মাথা খাটিয়ে, হাজার ভেবেও কিছুতেই সেই সাধারণ শব্দটা, কথাটা মনে আসে না। এমনটা হামেশাই তো ঘটে। প্রায় সমস্ত মানুষের ক্ষেত্রেই ঘটে। কেন এমন হয়? বিজ্ঞান ও চিকিৎসা মহলের পরিভাষায় এই বিষয়টিকে বলে 'লেথোলজিকা'!

লেথোলজিকার আরেক নাম 'টিপ অব দ্য টাং সিন্ড্রোম’। "আপনি কোনও সংস্কৃতিতেই, যে কোনও মানুষের সঙ্গে, যে কোনও বয়সের যে কারও সঙ্গে কথাই বলতে পারবেন না যে জানেই না আপনি কী বলছেন," বলেছিলেন পমোনা কলেজের ভাষাবিজ্ঞান এবং জ্ঞানীয় বিজ্ঞানের অধ্যাপক লিস আব্রামস। এমনকী যারা ইশারায় কথা বলেন, সংকেতে তাঁদের ক্ষেত্রেও এটা ঘটে। সেক্ষেত্রে বিষয়টি 'টিপ অব দ্য ফিঙ্গার সিন্ড্রোম' হিসাবে পরিচিত।

মনোবিজ্ঞানী রজার ব্রাউন এবং ডেভিড ম্যাকনিল এই বিষয়টি নিয়ে ১৯৬৬ সালেই একটি গবেষণা করেন। বহু পরে সেই গবেষণা জনপ্রিয় তো হয়ই, যুগান্তকারী গবেষণা হিসেবেও নথিভুক্ত হয়। তারা বলেছিলেন, বিষয়টি বেশ যন্ত্রণার। খানিকটা হাঁচির মতো অস্বস্তিকর। যতক্ষণ না মনে পড়ছে শব্দটা ততক্ষণ অস্বস্তি চলে। কিন্তু কেন এটা ঘটে? মানুষ কি চাইলে এমন হওয়া আটকাতে পারে? যদি খুব বেশি করে এমন ঘটতে থাকে তাহলে কি বিষয়টি চিন্তার?

আরও পড়ুন- মস্তিষ্ক কুড়ে খাচ্ছে অ্যামিবা, পর পর মৃত্যু! ভয়ঙ্কর সংক্রমণ ঘিরে আতঙ্ক

কেন লেথোলজিকা ঘটে?

বহু দশকের গবেষণা সত্ত্বেও বিজ্ঞানীরা এখনও নিশ্চিত নন যে কী কারণে টিপ-অব-দ্য-টাং সিন্ড্রোম হয়। ১৯৭০-৮০-র দশকের শুরুর দিকে বেশ কিছু তত্ত্ব উঠে আসে যাতে বলা হয়, এই হঠাৎ ভুলে যাওয়া বা মনে না পড়ার বিষয়টি আমাদের মস্তিষ্কের ভুল নির্বাচনের ফলাফল হতে পারে। ভুল নির্বাচন অর্থাৎ সমোচ্চারিত বা কাছাকাছি উচ্চারণের ভিন্নার্থক শব্দ। উদাহরণ হিসেবে বিজ্ঞানীরা বলেছিলেন, 'ডিমিনুয়েন্ডো' শব্দটি বলতে চাইছেন, অথচ মাথায় আসছে 'ডিসোসিয়েশন’ শব্দটি। বা 'সেক্সট্যান্ট' বলতে চাইছেন কিন্তু মাথায় আসছে 'সেক্সটন'। ১৯৯০-এর দশকে অবশ্য গবেষকরা নতুন ব্যাখ্যার খোঁজ শুরু করেন।

কেউ কেউ বলেন, কথা বা ধ্বনি যেভাবে তৈরি হয়, সেখানেই নিহিত রয়েছে এর কারণ। অনেক গবেষকরা বললেন, ভাষা ব্যবহার এক অবিশ্বাস্য জটিল প্রক্রিয়া, যার মধ্যে অনেক ক্ষেত্রে অনেক ভুল থেকে যেতে পারে। ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড্যানিয়েল ডেভিস আর আব্রামস এই সিন্ড্রোমের উপর ২০১৬ সালের একটি গবেষণাপত্রে লেখেন, যিনি কথা বলছেন, অর্থাৎ বক্তা প্রথমে যা বলতে চাইছেন সেটির অন্তর্নিহিত ধারণাটি প্রকাশ করার চেষ্টা করেন, তারপরে একটি বিমূর্ত শব্দ (লেমা) বেছে নিয়ে আভিধানিক নির্বাচনের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যান যাতে তাঁর মাথায় যে ধারণাটি রয়েছে সেটির অর্থকে সর্বোত্তমভাবে বোঝানো যায়। শব্দ নির্বাচিত হয়ে গেলে ফোনোলজিক্যাল এনকোডিং চলে, অর্থাৎ উচ্চারণ এবং ধ্বনি। অর্থাৎ যে শব্দটি যেভাবে বলতে চলেছি সেটি সেভাবে প্রকাশ করি। টিপ-অব-দ্য-টাং- তখন হয় যখন এই প্রক্রিয়াটির প্রথম অংশ অর্থাৎ উপযুক্ত লেমা বা শব্দ নির্বাচনটি সফলভাবেই সম্পন্ন হয় কিন্তু শেষ অংশটি সম্পূর্ণ হয় না।

অনেক সময়ই আমরা শব্দটি মনে না পড়লে নানাভাবে তা বোঝানোর চেষ্টা করি। অর্থাৎ, কখনও বলি শব্দটা দিয়ে আসলে কী বোঝানো হয় বা শব্দটি কোন অক্ষর দিয়ে শুরু। তবে তাতেও মনে পড়ে না। নতুন গবেষণা অনুসারে, প্রায় কাছাকাছি একটি শব্দ মনে পড়তেও পারে এক্ষেত্রে তবে সেটিও সঠিক নয়, এক্ষেত্রে আমাদের বিভ্রম বা ইলিউশন হতে পারে।

২০২৩ সালে কলোরাডো স্টেট ইউনিভার্সিটির কগনিটিভ সাইকোলজির অধ্যাপক অ্যান ক্লিয়ারি লিখেছেন, টিপ-অব-দ্য-টাং অবস্থার সময়, মানুষের মনে হয় তারা শব্দটির কিছু বৈশিষ্ট্য জানেন। ধরা যাক, শব্দটির প্রথম অক্ষর তারা জানেন, আসলে কিন্তু সেটিও তারা জানেন না। অর্থাৎ সম্ভাবনা রয়েছে যে যে শব্দগুলি আমাদের মনে পড়ছে না সেগুলি বেশিরভাগই অলীক হতে পারে।" তবে এমনটা কেন ঘটে এই নিয়ে নিশ্চিত নন তারাও।

আরও পড়ুন- গাড়ি থেকে সরাসরি ঢুকছে নাকে! আজীবনের জন্য স্মৃতিশক্তি খোয়াতে পারেন আপনি

আব্রামস ব্যাখ্যা করেছেন, দুই ধরনের শব্দ আছে যা প্রায়শই আমাদের এই পেটে আসছে মুখে আসছে না অবস্থায় ফেলে দেয়। সেই সমস্ত শব্দ যা আমরা খুব কম ব্যবহার করি এবং কোনও সঠিক নাম। দুই ক্ষেত্রেই শব্দ বা লেমা নির্বাচন এবং ফোনোলজির মধ্যে সংযোগের অভাব ঘটে থাকে। কোনও শব্দ খুব কম ব্যবহারের ফলে তা আর মনেই পড়ে না। আর আমরা যাদের ভালোভাবে চিনি তাঁদের প্রায়শই নির্দিষ্ট নামে ডাকি না। তাই এক্ষেত্রেও ভুলে যাওয়ার সম্ভাবনা ঘটে। তাই এমন ঘটনা ঘটলে খুব চিন্তার কিছু নেই। যতক্ষণ না আপনি দৈনন্দিন জিনিসগুলোও ভুলে যাচ্ছেন ততক্ষণ টিপ-অফ-দ্য-টাং-স্টেট নিয়ে খুব বেশি চিন্তা করার কিছু নেই। হ্যাঁ, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এমন ঘটনা ঘটাও বাড়বে কিন্তু এটি আলঝাইমার্স বা ডিমেনশিয়ার মতো ভয়ানক কিছুর লক্ষণ নয়।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, ধরা যাক আপনি ভুলেই গেলেন যে একটি কলম কাকে বলা হয়, তাহলে সেটা চিন্তার বিষয় কিন্তু আপনি যদি 'অ্যাবাকাস' বা 'মারসুপিয়াল'-এর মতো শব্দ মনে করতে না পারেন তাহলে চিন্তার নেই, ঘটনাটা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক।

More Articles