কবিতা লেখে মানেই নকশাল! উত্তর কলকাতার কবি প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে কিছু কথা

বাংলা ভাষায় লেখা ফুটবল বিষয়ে এ-পর্যন্ত সেরা বইটির লেখকও প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে, ‘উত্তর কোলকাতার কবিতা’-সহ প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ের দর্শন এবং ফুটবল-ভাবনা বেশ উচ্চাকাঙ্ক্ষী।


যদি না-হারাই- সে-আশঙ্কা কমই— রয়েছে চোদ্দটি চিঠি। তবে চিঠির কথা চিঠিতে। যে-বাড়িতে চিঠিগুলো লেখা হতো, সে-বাড়িটা কেমন?

যেখানে যাওয়া-আসা ছিল, সেটা প্রায় ফ্ল্যাটবাড়ির আদলে তৈরি। কিন্তু ওই বাড়ির তরুণ সদস্যটির চোখে অন্য-এক বাড়ির ঘাসে-ঢাকা বাগানের এককোণে পড়ে-থাকা ভাঙা ব্রুহাম বা ওই ধরনের গাড়ির একটা কঙ্কাল তখনও লেগে ছিল— যেন শৈশবের কাজল। রাস্তা চওড়া করতে গিয়ে পুরো বাড়ি ভাঙা পড়ে। কিন্তু গিরিশ ঘোষের বাড়ির রেপ্লিকা তৈরি হলেও ক্ষীরোদপ্রসাদেরটা আর হয়ে ওঠেনি।

সে আমাদের প্রসূন। প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়। ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদের প্রপৌত্র। হলে কী হবে, একবার হাতিবাগানে দাঁড়িয়ে। দর্জিপাড়ার চেনা একজন এসে— ‘এখানে?’

‘বাগবাজার’ শুনে ফের প্রশ্ন— ‘কোথায়?’

পরেশ ব্যানার্জির বাড়িতে আশ্বস্ত হল— ‘ও, প’শদার বাড়ি! তাই বলো, পার্টিতে নামলে নাকি?’

‘ওঁর ছেলে আমার বন্ধু।’

‘সে কী! ছেলেটা তো নকশাল!’

‘না, না। কবিতা লেখে।’

‘ওই হলো। কবি আর নকশাল কি আলাদা?’

পি-১ ঠাকুর রাধাকান্ত লেন। কলকাতা-৩। কাশিমবাজার স্কুলের পিছনে। জেলেপাড়ার গায়ে।

বাড়িতে নিচের তলায় প্রমাণ মাপের একটা ঘর। কতবার যে সেই ঘরটা কতরকম কাজে লেগেছে! প্রসূনের বিয়ের পর আমিও বহু রাত কাটিয়েছি এই ঘরে। সোফা সরিয়ে। ক্যাম্প খাট পেতে। বললে দু'-চারজনই আজও বিশ্বাস করবে— সেই সোফাতেই কখনও বসে থাকতে দেখেছি প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে, প্রসূনের বাবার অপেক্ষায়।

—কে?

কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস উত্তর— ওই-যে কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য! ওঁর ভাইপো।

সেই ঘরে একবার বাই উঠল— লাইব্রেরি হোক। হলো। এবং উঠেও গেল। প্রসূনের এক ভাই কী-এক ব্যবসা করবে। তাহলে নিক ওই ঘরটা!

প্রসূন তখন স্কটিশ চার্চ শেষ করে যাদবপুর না কোথায় যেন। পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলালের আর আমার ‘অমৃত’-তে যাতায়াত শুরু। মানে আনন্দ চ্যাটার্জি লেনে। প্রাচীন পাড়ার প্রাচীনতম সম্পাদক তুষারকান্তি ঘোষের শতবর্ষ আয়ু কামনা করা হচ্ছে। একদিন বিকেল। খিদে পেয়েছে। যুগান্তরের ক্যান্টিনে। গরম গরম লুচি, ছোলার ডাল। অফিসের অনেকেই খেতেন। প্রতি বিকেলে চাঙারিতে লুচি, বালতি-ভর্তি ছোলার ডাল নিয়ে গলিতে বৈষ্ণবীয় দর্প-সহ একটি পরিক্রমা হতো। দরজায় দরজায় অপেক্ষারত থালা-বাটি। শুনেছি— ওই লুচি-ডাল অগ্রাহ্য করা যেত না।

ক্রমে বামফ্রন্ট। ঊনআশির শুরুতে কলকাতা ছেড়ে আমিও ফের বীরভূমে। খুলে গেল একটা রাস্তা— চিঠির। একদা আমার শিশুবয়সের সহপাঠী, মানিক চক্রবর্তী, তখন কীর্তনীয়া, ছিল ডাকপিয়নও। সে আর নেই। তবে, এইসব চিঠির প্রতিটিতে রয়ে গেছে তার স্পর্শ।

যেমন বড় একটা চিঠির এই অংশটুকুতেও। তারিখ ১-৫-১৯৭৯:

আমি তোমাদের গ্রামে গেছি। আমার মনে আছে তোমাদের দাওয়া, বাইরের ঘর— যার মুখ্য বিষয় বস্তা ও রেডিও। মনে আছে সামনের কাঁচা রাস্তাটা, হাঁসসঙ্কুল পুকুরসমূহ এবং একটূ অহংকারী ও বিষণ্ণ পিচের রাস্তাটুকু, যা দিয়ে সারাদিনে ১৭টি গাড়ী চলাচল করে, মনে আছে লাজুক রফিকের বসে থাকা ও আলাপী আজাদদার কথাবার্তা— ‘আরবান সফিস্টিকেশন’ শব্দটি উচ্চারণ করে যে আমাকে চমকে দিয়েছিল। ইংরেজী যে বিদেশী ভাষা, মনে হয়, সেই প্রথম বুঝতে পেরেছিলুম। এইসব কিছুর মাঝখানে তোমাকে ভাবি।...
আমি ইদানীং এই বিপুল ব্রহ্মাণ্ডের আদি ও অন্ত কারণ হিসেবে একজন ঈশ্বরকে আমার বিশ্বাসে অ্যাপয়েন্ট করতে পেরেছি। মধ্যবর্তী অংশে যার কোনো সরাসরি অস্তিত্ব নেই। প্রসঙ্গত, ধর্মবিরোধী আর একটি অভিযোগ: ধর্ম কখনও প্রকৃত দার্শনিকতা বা আধ্যাত্মিকতাকে প্রশ্রয় দেয়নি। ঈশ্বর সম্পর্কে আমার ধারণা: সূর্যের তাপ বৃষ্টির কারণ কিন্তু বৃষ্টির মধ্যে সূর্যের তাপ অনুপস্থিত। ঈশ্বর এইরকমই এক কারণ মাত্র। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগের কোনো প্রশ্নই ওঠে না। যদিও তিনি সচেতন অস্তিত্ব।...
কলকাতা এসে এবার মেসে না-উঠে সোজা আমার বাড়িতে এসে পড়। একটু অসুবিধে হলেও চালিয়ে নিতে পারবে। এটা কোন অনুরোধ নয়, আরও বেশী কিছু, যা মান্য না হলে দুঃখ পাব। তোমার সঙ্গে বেরিয়ে পড়ার ইচ্ছে আছে। ভাল থেকো। ভালবাসা নিও।

কবিতা থেকে সরাসরি দর্শনে প্রবেশের ঝোঁক এই চিঠিতে স্পষ্ট। এবং এরই আপাতপূর্ণ একটি রূপ আমরা দেখতে পাই তার ‘ভাষাত্মদর্শন’ নামের মুদ্রিত গ্রন্থে। সে-বই নিয়ে বা প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ের দর্শনভাবনা নিয়ে তাঁর কবিতা-পাঠকদের আগ্রহ আছে কি না আমার স্পষ্ট ধারণা নেই। হয়তো সে-আগ্রহ তাঁদের থাকার দায়ও নেই। ‘উত্তর কোলকাতার কবিতা’ প্রসূনের বিখ্যাত বই অবশ্যই। কিন্তু, বাঙালি কবিতাপাঠক কি তাঁর কবিকে পর্দা সরিয়ে-সরিয়ে দেখবেন না? রবীন্দ্রনাথের ‘ন্যাশনালিজম’ নিয়ে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে প্রসূনের বিতর্কটির মুদ্রিত রূপ তো তাঁদেরই সযত্ন-সংগ্রহে থাকতে দেখেছি, যাঁরা কলকাতার স্কলার-মহলে ‘বিগ নেম’। ছিলেন, এবং এখনও কেউ-কেউ আছেন।

book cover

'উত্তর কোলকাতার কবিতা' বইয়ের প্রচ্ছদ

যদি বাড়িয়ে না-বলি, বাংলা ভাষায় লেখা ফুটবল বিষয়ে এ-পর্যন্ত সেরা বইটির লেখকও প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে, ‘উত্তর কোলকাতার কবিতা’-সহ প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ের দর্শন এবং ফুটবল-ভাবনা বেশ উচ্চাকাঙ্ক্ষী। আর, উচ্চাকাঙ্ক্ষা একটা লেখাকে বা লেখার ভাবনাকে কোথায় নিয়ে গিয়ে ফেলতে পারে, আমরা এখনও জানি না।

book cover

বাংলা ভাষায় ফুটবল নিয়ে এমন বই আর লেখা হয়েছে কি?

বলো কার্য, কীভাবে সাধিত হতে চাও
কীভাবে সম্পন্ন হলে যথেষ্ট তৃপ্তির তেরছা আলো
জেগে উঠবে অধরোষ্ঠে সাধনোত্তর

বলো ক্ষুধা, কীভাবে নিবৃত হতে চাও
কীভাবে ভরাতে চাও অন্তর্গত বিপুল শূন্যতা
কীভাবে থামাতে চাও পাচ্যরসক্ষরণবেদনা

এ তো কবিতা। বা, ‘উন্মেষগোধূলি’ থেকে কবিতার একটি অংশ। তারিখহীন (ডাকবিভাগের স্ট্যাম্পে ২৬। ৬। ১৯৮০-টুকু উদ্ধার করা যাচ্ছে।) দীর্ঘ এক চিঠিতে প্রসূন লিখছে:

আট্টু হলেই পুঁটিমাছ বেরিয়ে যাচ্ছিল। গুচ্ছের ট্রেন ক্যানসেল। তিনঘণ্টা লেট আপার ইন্ডিয়া ধরতে হল। এদিকে কলকাতার ভাড়া ৯.২৩ টা। ফলে, হাতে আমার পড়ে থাকে ২ টাকার কিছু মাত্র বেশী ইনক্লুডিং বিড়ি সিগারেট ও সেক্ষেত্রে ক্ষিদে পাওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত বেশী...। আর তিন ঘণ্টা লেটের আপার ইন্ডিয়া!! আহা, এত প্রাণোচ্ছল ট্রেন আগে দেখেছি কি?

তো এই হল মোটামুটি আমার বীরভূম অ্যাডভেঞ্চারের শেষ পর্ব, যাতে একইসঙ্গে গাঁথা ছিল বাদলঘন ম্যাসাঞ্জোরে এক রাত ও লিয়াকতঘন সিউড়িতে একদিন।

এসে দেখি কোলকাতার সেন্টিমেন্টাল আবহাওয়া কিছুটা হাল্কা হয়েছে। ও বর্ষা, দীর্ঘস্থায়িতার আভাসপূর্ণ বর্ষা, নেমে গেছে। কেননা, ওষ্ঠে দুই করতল স্ফীত করে... ইত্যাদি এবং ভাবো, উৎপলের এই ‘কেননা’, এই ভাঁড়ামি, মহত্ব ও শয়তানিপূর্ণ ‘কেননা’। জন ডানের কথা মনে আছে? Early 17th.-এর ইংরেজ কবি! যার মধ্যে পণ্ডিতরা আবিষ্কার করতে পারছেন, প্রথম আধুনিকতার শর্তগুলো থিতিয়ে ছিল। তো এরকম ভয়াবহ কিছু ‘কেননা’ আমি তাঁর লেখায় কিছু পড়েছি...।
উৎপলের ওপর একটা বড় লেখা, প্রায় গবেষণামূলক লেখা আমার মাথায় গজগজ করছে। কিন্তু আমার মাথায় যত কিছু গজগজ করে, খাতায় তত কিছু খচখচ করে উঠতে পারে না। কেন পারে না এ ব্যাপারে গভীর চিন্তা করে দেখলাম সবটাই পরিষ্কার আমোদগেঁড়েমি। ... আর ভাবো, আমোদ করার ধরণধারণ কিরূপ পাল্টে গেছে! একটা সময় ছিল যখন কিছুই লাগত না তেমন আমাদের। ভাগ করে ডিমভাজা খেতে খেতে হেসে আমহার্স্ট স্ট্রিট ফাটিয়ে দিতাম। গাঁজার একটা টানও ফ্লপ করত না। আজ ছিলিমের পর ছিলিম শেষ হয়ে যায়, হায় বাঞ্ছিত ফুর্তিটি দূরেই থাকে। কবিতার কথা বলতে গেলে মনে হয়, আঃ অভ্যেস থেকে বলছি।...

বয়স বাড়তে থাকলেই কি মানুষ বস্তুনিষ্ঠ হয়ে ওঠে? বিলাসদ্রব্যনিষ্ঠ? আমি কি কিছুমাত্রও লেখক নই? Excitement সব সময় বাইরে থেকে দরকার করে কেন? আগে তো করত না! আর একরাম আমি বিশ্বাস করি— ধোঁয়া গুমোট মেঘ অপরিসর বাসস্থল, বিরক্তিকর শব্দ অসম্মানিত পেশা এবং অর্থকষ্ট আরামহীনতা সংসারহীনতা নেশা ও বিশৃংখল যৌনতা এসবই একমাত্র একজন লেখককে ঘিরে থাকতে পারে, যা একজন সামান্য মানুষের পক্ষে সহ্য করা সম্ভব নয়। শুধু একজন লেখকের পক্ষে সম্ভব।

লিয়াকত আলি (জন্মসাল জানা নেই। মৃত্যু- ১২ নভেম্বর ২০১৭)। আপাত-বর্ণাঢ্য জীবন। কৈশোরেই বীরভূমের খ্যাতনামা নকশাল-কর্মী। দমদম সেন্ট্রাল জেলে দেড় বছর। পরে গ্র্যাজুয়েট। বিএসডব্লু পড়তে এসে মেসে আমার গেস্ট। বন্ধুদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা তখনই। পরে দুবরাজপুরের এক ফকির-কন্যাকে বিবাহ এবং ফকিরের আখড়া-সংলগ্ন স্থানে বসনাস করেন। বাংলার বাঊল-ফকিরদের অতি আপনজন। সুধীর চক্রবর্তী-সহ বহু পণ্ডিত এবং গবেষককে তথ্য এবং তত্ত্বজ্ঞানে সাহায্য করেছেন, যদিও নিজে বিশেষ লেখেননি। সুধীর চক্রবর্তীমশাই এক লেখায় এঁর সম্পর্কে প্রায় আড়াই পৃষ্ঠা প্রশস্তি করেছিলেন ‘দেশ’ পত্রিকায়।

চিঠির শেষে যে-জীবনযাপনের কথা বলা হয়েছে, তাতে আমাদের কারও কারও বিশ্বাস ছিল। এবং আজও হয়তো কিছুটা থেকে গেছে।

সেটা কোন সাল? বারদুয়ারি থেকে বেরিয়ে পিঁপড়ের সারি। গতি ধীর। পিছনের সিটে হাত বাড়িয়ে— দশ টাকা। দশ টাকা। পাওয়াও গেল কিছু। নিউ এম্পায়ারে ‘অ্যাবা দ্য মুভি’।

ফ্রন্ট সার্কলের কাউন্টারে, গ্রিল আর তারের খাঁচার ওপারে, তুলকালাম ভিড়। তিন মূর্তি খাঁচার এপারে— প্রসূন, ভিক্টর, আমি। শেষে শিকারের ওপর অবিশ্বাস্য হুংকার দিয়ে সিংহ-লাফের মতো প্রসূনের হাতের উল্লম্ফন এবং ‘চলে আয়’ চিৎকার-সহ বাস্তিলের সরু খাঁচাপথে প্রবেশ।

তারপর তো ঘনিয়ে উঠল প্রসূন-নন্দিনীর বিয়ে। ওই যে রাজবল্লভ পাড়া! দেঊড়িতে সানাই। ওস্তাদ আলি হোসেন? হয়তো-বা। সঙ্গে কেউ-একজন, মৃদু পাখোয়াজে। কীভাবে যেন বাড়তি কিছু জানতে পারে কেউ কেউ। সিঁড়ি বেয়ে উঠছি, ওপরের ধাপ থেকে ভিক্টর— ‘রেলিংটা দেখ। ব্রোঞ্জের।’ দোতলায় নাচমহল তত দিনে লাইব্রেরি। সেদিন সাদা ফরাসের উপর সে-ঘরে আমরা। ঘুরতে ঘুরতে প্রসূনের বাবা। ছেলের পিঠে, আজকাল যাকে বলে, সপ্রতিভ প্যাট করে— ‘ডোন্ট বি নার্ভাস!’

তরুণ দল হতভম্ব।

যে-বছর জ্যোতিবাবু, নন্দিনীর বাবা সে-বছরই বার অ্যাট ল। একসঙ্গে। তবে, জ্যোতি বসু হাই কোর্ট পর্যন্ত গিয়ে নামটুকু লেখালেও তিনি এতটা পেরে ওঠেননি। বাড়িতেই ভিয়েন। পরিবেশনকারীদের ধুতি, গেঞ্জি, কোমরে-গামছা— সব সদ্য কেনা। ওদিকে তিনশো বছরের কলকাতাবাসী হলেও, প্রসূনদের বাড়িতে ঢুকে পড়েছে সিপিএম। ফলে উর্দি-পরা বিজলি গ্রিল। ডানহিল। কোল্ড ড্রিংকস।

তারপর এল ‘কৃষ্ণপক্ষ’। পরে ‘পুনর্বসু’। একটা সময় ছিল, যখন সব চিঠিই ‘কৃষ্ণপক্ষ, নয়তো ‘পুনর্বসু’-সংক্রান্ত— যে-যার সময়।

যেমন ডাকটিকিটের ছাপ-অনুযায়ী ১৯৮০-র জুনে:

অন্যায় একটা করে ফেলেছি। তোমার কবিতা কৃষ্ণপক্ষের দায়িত্বহীন সম্পাদকদের কাছ থেকে উদ্ধার করতে দেরী হয়েছে। হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু একটা চিঠি দেওয়া তো উচিত ছিলই। তাও দিইনি। এর জন্য ক্ষমা চাইবার প্রয়োজন নেই। কারণ, এর পেছনে আমার যুক্তি দেখানোর কিছুই নেই। ...

টিভি-তে উ. ক. বু.-র বদান্যতায় একটা প্রোগ্রাম করে কিছু টাকা হাতে পেয়েছি। আগামী সপ্তাহে যেকোনো দিন তোমার ওখানে চলে যেতে পারি, মানে যাচ্ছিই।...

....

এদিকে লেখালিখি জোগাড় করা তো প্রায় শেষ। আমার প্রবল ইচ্ছে ছিল তোমাদের সামনে ঝাঁপি খুলে বসি কারণ ভাল লেখা বা খারাপ লেখা ছাপার যাবতীয় কৃতিত্ব ও দোষ সব আমার ঘাড়েই পড়ুক এরকম আমি চাইনি। তবু একাই প্রেসে যেতে হচ্ছে— এই একাকীত্ব (য) বড় শ্বাসরোধী।
অন্তত একদিনের জন্য একবার এসো। বিনয়ের ইন্টারভিউটা আমি গ্যাব্রিয়েল মার্কেজের একটা ইন্টারভিউ প্পড়েছিলাম, যা আমার পড়া শ্রেষ্ঠ; তার চেয়ে কিছুটা ভাল হয়েছে। আমাদের যে গদ্যসমস্যাটা ছিল তা অলৌকিকভাবে ভরে যেতে চলেছে কমলবাবুর একটি ১৮ পাতার প্রুস্ত আলোচনায়। তোমার জেনে রাখা ভাল, কমলবাবুর লেখাটার জন্য রীতিমতো লড়াই করতে হচ্ছে। ...

প্রথম চিঠির উ. ক. বু.— উৎপলকুমার বসু। দ্বিতীয় চিঠির বিষয় ‘পুনর্বসু’-র প্রথম সংখ্যা। বিনয় মজুমদারের সাক্ষাৎকারটি পড়ে নিমাই চট্টোপাধ্যায়ের মতো পাঠকও আমাকে প্রায় একই কথা বলেন— তাঁর পড়া সেরা সাক্ষাৎকার। কমলবাবু— কমলকুমার মজুমদার। তবে, সে-লেখা শেষ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।

এর মাঝে একটা ঘটনা ঘটল, যেটার বিরাটত্ব নিয়ে আজ পর্যন্ত কথা হয়নি।

কী একটা ছুতোনাতায় পুরুলিয়ায় নির্মলের (মানে নির্মল হালদার) বা মুকুলের ('জিরাফ'-সম্পাদক প্রয়াত মুকুল চট্টোপাধ্যায়) কোনও অনুষ্ঠান। কাল শরৎ। সাল মনে নেই। শহর থেকে একদিন জয়চণ্ডী পাহাড়। কাচ-স্বচ্ছ জল দেখে গরমে কেউ-কেউ নেমে পড়ে। তলার আদিম পাথরগুলোর কথা কারও মনেই ছিল না। পিছলে হাত ভাঙল প্রসুনের। টুঁ শব্দটি করল না। ওর আপত্তি অগ্রাহ্য করে তড়িঘড়ি পুরুলিয়া। ডাক্তার। চিকিৎসা। ব্যান্ডেজ। প্রসূন নির্বিকার। অনুষ্ঠান হলো, ঠিক যেমনটি হওয়ার কথা ছিল। কবি নয়, দার্শনিক নয়, ফুটবলবোদ্ধা নয়; সেদিনের সেই মানুষটির নীরবতা, দু'-একটা কথা মনে পড়ে।

বহু দিন পর চিঠিগুলো গোছাতে গিয়ে মাসিমার— কল্যাণী বন্দ্যোপাধ্যায়ের— একটা চিঠি ওই গুচ্ছ উপচে উঠে এল। মাত্র একটা? আরও দু'-একটা থাকার কথা না? অন্তত যে-চিঠিটি এক পত্রবাহিকা এনেছিলেন আমাদের হৃষিকেশ পার্কের অফিসে?

সব সময়ই দিয়ে গেছেন। একবারই চেয়েছিলেন কিছু— ওই পত্রবাহিকার জন্য। জানতেন না বা হয়তো জানতেন— আমার কোনও ক্ষমতা ছিল না। আজ উভয়ের নিরুপায় অবস্থানটির কথা মনে পড়ে।

More Articles