সমকামিতা এখনও কেন স্বাভাবিক হয়ে উঠল না সমাজের চোখে?

তথাকথিত সুশীল সমাজের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত যারা, মাথা তুলে দাঁড়িয়ে সচেতন নাগরিকের ভাষণ তারা দেয় বটে, তবে 'ওরা' ওরাই রইল আর 'আমরা' আমরা। তাই আজকাল দেখি, প্রাইড ওয়াকের সুযোগ নিয়ে বহু মানুষকে ব্যবসা করতে...

ইদানীং বেশিরভাগ ক্যাফে বা ছোট রেস্তোরাঁ গুগলে সার্চ করার সময় দেখি লেখা থাকে 'LGBTQ ফ্রেন্ডলি'। দেখে উচ্ছ্বসিত হই। মনে হয়, এই তো আমাদের সমাজ বদলাচ্ছে, ব্যক্তিগত পরিসর তৈরি করার উদ্যোগ নিচ্ছে প্রতিটি ভিন্ন ধরনের মানুষের জন্য। কিন্তু পরমুহূর্তে মনে হয়, এইভাবে কি আমরা ওদের আসলে আলাদা করে দিতে চাইছি?

একটা সময় ছিল, যখন সমকামী, উভকামী এবং রূপান্তরের গোত্রে পড়া এই সমস্ত মানুষকে মানুষ বলেই গ্রহণ করতে পারতাম না আমরা। ধরেই নেওয়া হতো, এরা বড় হয়ে সকলেই 'হিজড়ে' হবে, নয়তো বেড়ে উঠবে এক তথাকথিত বিকৃত রুচির মনুষ‍্যত্ব নিয়ে। যদিও এখনও অনেকে তাই মনে করেন। তবে সেই সংখ্যা কমছে। কমছে, কারণ সচেতনতা বৃদ্ধি হচ্ছে, প্রতিবাদ মিছিল বেরচ্ছে, প্রতিরোধের শক্তি জোগাচ্ছে প্রত্যেকেই তার তার নিজের মতো করে। ওদের অনেকেই সিদ্ধান্ত নিচ্ছে স্ব-অধিকারে বাঁচার।

প্রত্যেকেরই তো বাঁচতে ইচ্ছে করে আত্মপরিচয় নিয়ে, সমাজে মাথা তুলে, তাই না? আপনি জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে কেন বলে দেবেন আমি কীভাবে থাকব? তাই স্লোগান ধ্বনিত হয়, 'আমার শরীর, আমার মন, দূর হটো রাজশাসন'।

আরও পড়ুন: জুন মাস কেন সমকামীদের জন্য জরুরি? যে ইতিহাস অনেকের অজানা

যাক সে কথা। এখন ওরা অনেক স্বাধীন। তবে স্বাধীন হলেও সচ্ছল নয়। এখন ওরা ভিড়ে একসঙ্গে হাঁটতে পারে, দু'দণ্ড বসে কষ্টযাপন করতে পারে, এবং কিছু কিছু উদাহরণ দেখার পর চেষ্টা করে দেখতেও পারে একসঙ্গে থাকার। বিতাড়িত হওয়ার ভয় কিংবা সমাজচ্যুত হবার যন্ত্রণা এখন গা-সওয়া হয়ে গেছে ওদের বেশিরভাগেরই। পরিবার পাশে না থাকলে কষ্ট হয়েছে খুব, কিন্তু আগের মতো ক্ষণে ক্ষণে মৃত্যুচিন্তা? নৈব নৈব চ! জীবন তো একটাই! নীল আকাশে পতপত করে উড়িয়ে দেওয়া রামধনু পতাকার চেয়েও মৃত্যুর শক্তি বুঝি বেশি? তাহলে আর 'প্রাইড' হলো কই?

তবে যতই আনন্দ পাই, একদল মানুষের লিঙ্গবিভাজনের সামাজিক জটিলতার প্ররোচনা পার করে ঊর্ধ্বে গিয়ে, যত জীবনকে উদযাপন করতে দেখি, মনে হয়, ওদের যাপন কেবল ওদেরই, আমাদের নয়।

আচ্ছা যখন কোনও সামাজিক বা রাজনৈতিক ঘটনার প্রতিবাদ করি আমরা সরাসরি পতাকা হাতে মাঠে নেমে, তখন কি ভয় করে হাঁটতে? মনে হয়, কেউ যদি দেখে ফেলে তখন কী ভাববে? লজ্জা করে পায়ে পা আর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে যেতে? তবে এর বেলায় কেন? মার্কড হয়ে যাওয়ার ভয়ে? এই যদি ওরা আমায় ভাবে, আমি ওদের দলের লোক? ফুসলিয়ে টেনে নেয় ওদের কমিউনিটিতে? চেনা-পরিচিত বন্ধুরা যদি দেখে ফেলে? যদি ট্রোল করে? আরও যে কত 'যদি' লুকিয়ে থাকে আমাদের মনে, তার হদিশ নদীই জানে।

অনেকেই বলবেন, অনেক বিষমকামী মানুষই তো যায়। আত্মপরিচয় ভুলে অনেকেই তো গর্বের পতাকা উড়িয়ে দেয় কাঁধে কাঁধ রেখে! তবে সেটা কেমন যেন ওই বন্ধুদের গেটটুগেদারের মতো। চেনা-পরিচিত মানুষ এল, মজা করল, সেলফি তুলল, বাড়ি চলে গেল। কিন্তু দুঃখ যার, যাপন তারই রইল। বাকি সবাই সমানুভবের কল্পিত চটিতে পা গলিয়েই সান্ত্বনা দিল নিজেদের।

তথাকথিত সুশীল সমাজের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত যারা, মাথা তুলে দাঁড়িয়ে সচেতন নাগরিকের ভাষণ তারা দেয় বটে, তবে 'ওরা' ওরাই রইল আর 'আমরা' আমরা। তাই আজকাল দেখি, প্রাইড ওয়াকের সুযোগ নিয়ে বহু মানুষকে ব্যবসা করতে, দেখি বহু মানুষকে টোপ ফেলে রোজগার করতে, দেখি সোশ্যাল মিডিয়ায় চটকদারি ছবি পোস্ট করে রাতারাতি ভাইরাল হয়ে যেতে। এও এক হুজুগ বটে! যে কোনও সামগ্রীর পাশে প্রাইড মান্থের ট্যাগটি জুড়ে দিলেই হলো!

বহু সময় বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে কথাবার্তায় যখন LGBTQ-র প্রসঙ্গ ওঠে, কিংবা কোনও ভাবনা শেয়ার করতে যাই, দেখি হয় ওদের বেশিরভাগই বিরক্ত হচ্ছে, না হয়তো এড়িয়ে যাচ্ছে। যাদের মধ্যে জানার আগ্রহ কিঞ্চিৎ আছে দেখে প্রকাশ করি মনের কথা, তাদের কাছে আবার বক্তব্য নয়, কৌতূহল বড় হয়ে ওঠে, তাই গোপন তথ্যগুলো জানার পর তারাও আর বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করে না। এই যে এত মনোরঞ্জনের ভিড়ে কত মানুষ তাঁদের আত্মপরিচয় প্রকাশ করতে চেয়েও পারেননা, তা কি জানেন? কত মানুষ কাম আউট করতে চেয়েও পরম বন্ধুর কাছে খিল্লির উপাদেয় হয়ে মানসিক অবসাদের চরম স্বীকার হয় জানেন?

প্রাইড ওয়াকের প্রসঙ্গ এলে যখন কেউ বলে, 'অমুক দিন অমুক জায়গায় ওয়াক আছে', আমি জিজ্ঞেস করি, 'তুই যাচ্ছিস?' উত্তর আসে, 'না।' জিজ্ঞেস করি, 'কেন, সময় নেই না ভয় করে?' উত্তর আসে, 'কোনওটাই না।' তবে? এই 'তবে'-র জায়গাতেই সবাই চুপ করে যায়। কীসের দ্বিধা, কীসের দ্বন্দ্ব বোঝা যায় না!

কেউ কেউ ভাবে, ওরা বুঝি ছেলে দেখলেই টেনে নেবে আর মেয়ে দেখলেই গলে পড়বে! ব্যাপারটা কি এতটাই সহজ? আপনি একজন বিষমকামী মানুষ হয়ে কি রাস্তাঘাটে চলার পথে যে কোনও ছেলে বা মেয়েকে দেখলেই আকৃষ্ট হন? হওয়া কি সম্ভব? এর জন্য অনুভূতি লাগে, আর সেই অনুভূতি সবারই শিরা-উপশিরা দিয়ে একই স্রোতে প্রবাহিত হয়। তা সে মানুষ যে লিঙ্গেরই হোক, আর যে ধর্মের!

একবার এগিয়ে আসুন না, জুনের এই প্রাইড পর্বের সামাজিক কর্তব্যের ঘোর কাটিয়ে, বছরের যে কোনও দিন, যে কোনও সময়ে অনুভবের গলি দিয়ে একসঙ্গে পা মেলাতে? ওদের নয়, আমাদের জন্য।

 

More Articles