কুকুরের দিকে তাকালেই তাদের মস্তিষ্কের সঙ্গে জুড়ে যায় মানুষের মস্তিষ্ক? কী বলছে গবেষণা?
Dog Human Relation: দেখা গেছে কুকুর মানুষের দিকে তাকালে দুইক্ষেত্রেই একইরকম যোগাযোগ স্থাপন হচ্ছে।
কুকুরের থেকে নিঃস্বার্থ ভালোবাসা, বন্ধুত্ব যারা পেয়েছেন, তাঁরাই জানেন প্রিয় কুকুরটি আসলে ম্যাজিক ঘটাতে জানে। যে সম্পর্কে কোনও কথা নেই, ভাষা নেই সেই সম্পর্কে এক নিজস্ব শব্দমণ্ডল আছে। কথা না বলেও যেখানে অজস্র অনুভূতি প্রকাশ করা যায়। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, কুকুর এবং মানুষ যখন একে অপরের দিকে তাকায় তখন তাদের মস্তিষ্কে অদ্ভুত যোগসূত্র তৈরি হয়ে যায়। চিনের গবেষকদের এই গবেষণায় এই প্রথম বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে 'নিউরাল কাপলিং' দেখা গিয়েছে।
নিউরাল কাপলিং কী? যখন দুই বা ততোধিক ব্যক্তির মস্তিষ্কের কার্যকলাপ কোনও মিথস্ক্রিয়া চলাকালীন একসঙ্গে মিলে যায় তাকেই নিউরাল কাপলিং বলে। সাধারণত মানুষের ক্ষেত্রে, প্রায়ই কোনও কথোপকথন চললে বা গল্প শোনার প্রতিক্রিয়া হিসাবে এই কাপলিং বা যৌথতা দেখা যায়।
ইঁদুর, বাদুড়, মানুষ এবং অন্যান্য প্রাইমেট সহ একই প্রজাতির সদস্যদের মিথস্ক্রিয়ায় নিউরাল কাপলিং দেখা গেছে। মস্তিস্কের এই সংযোগই সামাজিক নানা যোগাযোগের সময় আমাদের প্রতিক্রিয়া তৈরি করে দেয়। এই যোগসূত্রই আমাদের আচরণও নির্দিষ্ট করে দেয়। এই যোগাযোগের ফলেই কিন্তু 'টিমওয়ার্ক' শেখাও সম্ভব হয়। কোনও প্রজাতির সামাজিক যোগাযোগ হলে তাদের মস্তিষ্কেরও সংযোগ তৈরি হয়। তবে মানুষ আর কুকুরের সম্পর্কের সূক্ষ্মতার ক্ষেত্রে বিষয়টি একটু আলাদা।
আরও পড়ুন- সিংহখেকো কুকুর! হাতিকেও হারাত নিমেষে, আলেকজান্ডারের এই পোষ্য ছিল এমনই ভয়াবহ
কুকুরই মানুষের গৃহপালিত প্রথম প্রাণীদের মধ্যে অন্যতম। ফলে মানুষের সঙ্গে কুকুরের সম্পর্ক দীর্ঘকালের। কুকুর শুধুমাত্র মানুষের সঙ্গী নয়, মানুষের সমাজে তাদের মূল ভূমিকা রয়েছে। কুকুর থেরাপিউটিক সাহায্য করতে পারে, রোগ শনাক্ত করতে পারে। কুকুরের এমন কিছু অদ্ভুত দক্ষতার মধ্যেই আছে মানুষের মানসিক অবস্থা চিনতে পারা এবং প্রতিক্রিয়া জানানোর ক্ষমতাও।
সাম্প্রতিক গবেষণায়, গবেষকরা নন-ইনভেসিভ ইলেক্ট্রোএনসেফালোগ্রাফি (ইইজি) নামক মস্তিষ্কের ক্রিয়াকলাপ রেকর্ডিং করার সরঞ্জাম ব্যবহার করে নিউরাল কাপলিং করেছেন। এতে ইলেক্ট্রোডযুক্ত হেডগিয়ার ব্যবহার করা হয় যা নিউরাল সিগন্যাল সনাক্ত করে। গবেষকরা পরীক্ষা করে দেখেছেন, যখন কুকুর এবং মানুষ একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন তখন স্নায়ু সংকেত কেমন ছিল এবং একে অপরের উপস্থিতিতে, কিন্তু একে অপরের দিকে না তাকিয়েই বা কেমন ছিল। যখন কুকুর এবং মানুষ একে অপরের দিকে তাকায় তখন কুকুরগুলির মস্তিষ্কের সংকেতগুলি যেন খেলা করে যায়। মস্তিষ্কের মূল অংশের যে জায়গাগুলি মনোযোগের সঙ্গে যুক্ত, দেখা গেছে কুকুর মানুষের দিকে তাকালে দুইক্ষেত্রেই একইরকম যোগাযোগ স্থাপন হচ্ছে।
টানা পাঁচদিন এই পরীক্ষা চলে, কুকুর এবং মানুষ যারা গবেষণার এই পাঁচ দিনে একে অপরের সঙ্গে আরও বেশি পরিচিত হয়েছে তাদের নিউরাল সিগন্যালগুলির সিঙ্ক্রোনাইজেশন বৃদ্ধি পেয়েছিল। এর আগে মানুষ-মানুষের মধ্যেকার এই ধরনের মানসিক যোগাযোগের গবেষণায় দেখা গেছে যে, মানুষের মধ্যে এমন যোগাযোগের ফলে দুইজনের পরিচিতি বৃদ্ধি পেয়েছে যার ফলে মস্তিষ্কের ক্রিয়াকলাপও খানিক একই রকমের হয়েছে। সুতরাং মানুষ এবং কুকুরের মধ্যে সম্পর্কের গভীরতাও স্নায়বিক সংযোগকে শক্তিশালী করে তুলতে পারে।
আরও পড়ুন- ভাতঘুম না হলে তার একেবারেই চলে না! বিশ্বের সর্বকালের বয়স্ক কুকুরের বয়স কত, জানেন?
মানুষের সঙ্গে কুকুরের সংযোগের ক্ষমতা সুপরিচিত। ২০২২ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, পরিচিত মানুষের উপস্থিতি কুকুরের নিকটাত্মীয় নেকড়েদের মধ্যে চাপের প্রতিক্রিয়া কমাতে পারে। মানুষের সঙ্গে স্নায়বিক সংযোগ তৈরি করা কুকুর-মানুষের সম্পর্ক উন্নত করার একটি উপায় হতে পারে। গবেষকরা নিউরাল কাপলিংয়ে মস্তিষ্কে পার্থক্যের সম্ভাব্য প্রভাবও খতিয়ে দেখেছেন। যে সমস্ত কুকুরদের জিনে শ্যাঙ্ক ৩ নামক একটি মিউটেশন রয়েছে সেই কুকুরদের নিয়ে গবেষণা হয়েছে। দেখা গেছে, এই জিন মনোযোগের সঙ্গে যুক্ত মস্তিষ্কের অঞ্চলে স্নায়ু সংযোগ দুর্বল করার কারণ হতে পারে। এই জিনটি একটি প্রোটিন তৈরি করে যা কোশের মধ্যে, বিশেষ করে মস্তিষ্কের কোশের মধ্যে যোগাযোগ বাড়াতে সাহায্য করে। শ্যাঙ্ক ৩-এ মিউটেশন হলে তা মানুষের মধ্যে অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডারও তৈরি করতে পারে। যে কুকুরদের শ্যাঙ্ক ৩ মিউটেশন রয়েছে, সেই কুকুররা যখন মানুষের সঙ্গে সংযোগ তৈরি করছে তখন মস্তিষ্কের কোনও সংকেত তৈরি হয়নি, যেমনটা মিউটেশন ছাড়া কুকুরদের মধ্যে হয়েছিল।
গবেষকরা যখন শ্যাঙ্ক ৩ মিউটেশন থাকা কুকুরদের এলএসডি (একটি হ্যালুসিনোজেনিক ড্রাগ)-এর একটি ডোজ দেন, তখন এই কুকুরদের মনোযোগের মাত্রা বেড়ে যায় এবং মানুষের সঙ্গে এই কুকুরদের স্নায়ু সংযোগও বাড়ে। গবেষকরা বলছেন, কুকুর এবং মানুষের মধ্যে নিউরাল কাপলিং সম্পর্কে অনেক কিছু শেখার বাকি রয়েছে। কুকুরের চোখের দিকে তাকানোর অর্থ হতেই পারে নিজ নিজ মস্তিষ্কের সংকেতগুলির আরও জোটবদ্ধ হওয়া, আরও সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া।