মুড়ি আর পাথর চুঁইয়ে পড়া জল! সুড়ঙ্গের যে ভয়ঙ্কর যুদ্ধের কথা শোনালেন ঝাড়খণ্ডের রাজেন্দ্র

Uttarkashi Tunnel Rescue Operation:পাথরের গায়ে ওই সরু জলের রেখা আর সকলের কাছে মিলিয়ে ঝুলিয়ে থাকা অল্প একটু মুড়ি, ওটুকুর ভরসাতেই বেঁচে ছিল ৪১টি প্রাণ।

সূর্যের আলোর কথা প্রায় ভুলতে বসেছিলেন এই ক'দিন ওই ৪১ জন শ্রমিক। ১৭ দিনের মাথায় ফের স্বাভাবিক জীবনে ফেরা! সুড়ঙ্গের ভিতরে বসে এ সব কিছুই মিথ্যা মনে হত শ্রমিকদের। তবু হাল ছাড়েননি তাঁরা। একে অপরকে সাহস জুগিয়েছেন। ঠিক ফেরা হবে, ভরসা দিয়েছেন। ১৭ দিন বাদে উত্তরকাশির সিল্কিয়ারা সুড়ঙ্গের অন্ধকার থেকে বের করে আনা হয়েছে বন্দি শ্রমিকদের। এ যেন অসাধ্যসাধন। সুড়ঙ্গের বাইরে এ কদিন ধরে এক ভয়াবহ যুদ্ধ চালিয়ে গিয়েছেন হাজার হাজার উদ্ধারকারী। যে কোনও সময় যা কিছু ঘটতে পারে। সেই সমস্ত অঘটনের বিরুদ্ধে এক ভয়ঙ্কর লড়াই। আর সুড়ঙ্গের ভিতরে চলেছে অন্য যুদ্ধ। যে কোনও ভাবে টিকে থাকার লড়াই। কেমন ছিল অন্ধকার সুড়ঙ্গের ভিতরে ওই সতেরোটা দিন।

সিল্কিয়ারার সুড়ঙ্গে বন্দি ছিলেন মোট ৪১ জন নির্মাণকর্মী। চারধাম প্রকল্পের অধীনে শুরু হয় এই সুড়ঙ্গখনন। গত ১২ নভেম্বর ওই সুড়ঙ্গে কাজ করার সময়ে হঠাৎ ধস নামে। সেই ধসের জেরে বন্ধ হয় সুড়ঙ্গ থেকে বেরোনোর সমস্ত রাস্তা। সুড়ঙ্গের মধ্যেই অন্ধকারে আটকা পড়ে যান ওই ৪১ জন শ্রমিক। প্রাথমিক ভাবে বন্দি শ্রমিকদের স্বরটুকু বাইরের জগতের কাছে পৌঁছে দেওয়াই ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। খবর জানাজানি হতেই শুরু হয় উদ্ধারকাজ। সব রকম ভাবে চেষ্টা চলতে থাকে সুড়ঙ্গে বন্দি শ্রমিকদের কাছে পৌঁছানোর। উত্তরাখণ্ডের এই এলাকাটি এমনিতেই ধসপ্রবণ। তার সঙ্গে রয়েছে ভূমিকম্পের ভয়। ফলে উদ্ধারকাজে প্রতি পদে পদে বারবার বাধা এসেছে। প্রতিটা পরিকল্পনা যেন বানচাল হয়ে গিয়েছে প্রতিবার। একদিন, দু'দিন করে বেড়েছে অপেক্ষার মেয়াদ। প্রতিদিন সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে যে আশার জন্ম হত, প্রতি সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে সেই আশাকে ডুবে যেতে দেখেছেন ৪১ জন শ্রমিক। ভয়ঙ্কর আতঙ্ক, প্রতিমুহূর্তে শেষ হয়ে যাওয়ার ভয়। তা সত্ত্বেও জীবনের প্রতি আশা না হারানো কাকে বলে, শিখিয়েছেন ওরা।

আরও পড়ুন: ৪১ শ্রমিকের এই পুনর্জন্ম আসলে ‘মিব়্যাকেল’! কেন প্রকৃতিকেই সমস্ত কৃতিত্ব দিচ্ছেন আর্নল্ড? 

সুড়ঙ্গে আটকে পড়া শ্রমিকদের মধ্যে নানা রাজ্যের মানুষ ছিলেন। কেউ এসেছেন ঝাড়খণ্ড থেকে তো কেউ উত্তরপ্রদেশ, কেউ এসেছে হিমাচল থেকে তো কেউ পশ্চিমবঙ্গ। নানা ভাষাভাষী, নানা ধর্মের, নানা বিশ্বাসের ৪১ জন। সহজ ছিল না তাঁদের মাটির নীচের এই সতোরোটা দিন। ঝাড়খণ্ড থেকে ভিনরাজ্যে কাজ করতে এসেছিলেন অনিল ভেদিয়া। তাঁর মতো আর চোদ্দ জন ছিল ওই সুড়ঙ্গে, যাঁদের বাড়ি ঝাড়খণ্ডে। উত্তরাখণ্ডের ওই সুড়ঙ্গে ধস নামার পর থেকে শুধুমাত্র মুড়ি খেয়ে থেকেছেন তাঁরা। সুড়ঙ্গ থেকে বেঁচে ফিরে জানাচ্ছেন অনিল। সুড়ঙ্গের গায়ের পাথর বেয়ে নেমে আসত জলের একটা সরু রেখা। কোনওমতে চুঁইয়ে পড়া সেই জলের রেখার কাছে গিয়ে মুখ পেতে দিতেন। অল্প অল্প জল পেটে পড়ত। ওই টুকুতেই কাটাতে হত ৪১ জন শ্রমিককে।

২২ বছরের অনিলের কাছে এই সতেরোটা দিন ছিল জীবন আর মৃত্যুর মাঝে একটা সুতোর মতো। অনিল জানাচ্ছেন, তাঁরা প্রত্যেকে প্রতিদিন ভাবতেন, আর নয়। এই অন্ধকার সুড়ঙ্গের ভিতরেই চাপা পড়ে এক এক করে মৃত্যু হবে প্রত্যেকের। আর তা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা ছাড়া কোনও উপায় নেই তাদের হাতে। প্রথম কয়েকদিন তো এই হতাশার মাত্রা ছিল আকাশছোঁয়া। সমস্ত আশা যেন মরে গিয়েছিল। এর মধ্যেই উদ্ধারকারীদের তরফ থেকে পাইপের মাধ্যমে খাবার জল পৌঁছতে শুরু করে তাঁদের কাছে। এতদিন সূর্যাস্তবিহীন জীবনে ভিটামিন ডি-র কমতি হবে জেনে পাঠানো হয় ভিটামিন ডি ক্যাপসুল। ফেরে আশার আলো।

কিন্তু প্রথম দশদিন তাঁদের বেঁচে ফেরার স্বপ্ন দেখিয়ে গিয়েছে পাথরের গায়ে ওই সরু জলের রেখা। প্রাথমিক ভাবে বুঝতে পারেননি, পাহাড়ের গা বেয়ে নামা ওই জল মুখে দেওয়া ঠিক হবে কিনা। পরে দুই সুপারভাইজারের বুদ্ধিতে ওই জলটুকু দিয়ে তেষ্টা নিবারণ করার চেষ্টা করতে থাকেন তাঁরা। ওই জলটুকু আর সকলের কাছে মিলিয়ে ঝুলিয়ে থাকা মুড়িটুকু, ওটুকুর ভরসাতেই বেঁচে ছিল ৪১টি প্রাণ। উত্তরাখণ্ডের হাসপাতালে শুয়ে বুধবার সেইসব দিনের কথাগুলো মনে করতে করতে ফের যেন শিউরে উঠলেন বছর বাইশের অনিল।

Licked water dripping from rocks, ate ‘muri’: Jharkhand worker rescued from tunnel

রাঁচি শহর থেকে দূরে খিরাবেদা নামে একটি গ্রাম থেকে উত্তরাখণ্ডের সুড়ঙ্গ খননের কাজে যোগ দিয়েছিলেন অনিল। দারিদ্রের সংসারে দু-পয়সা আয় হবে ভেবে ঘরবাড়ি ছেড়ে এসেছিলেন এতদূরে। কিন্তু সেই দেবভূমিতে এসে যে এত বড় বিপাকে পড়বেন, তা তি ভেবেছিলেন দুঃস্বপ্নেও। রাঁচির ওই গ্রাম থেকে উত্তরকাশিতে কাজ করতে এসেছিলেন মোট ১৩ জন। তার মধ্যে তিন জন আটকে পড়েন ওই সুড়ঙ্গে। তবে ঝাড়খণ্ড থেকে আরও অনেক শ্রমিক বন্দি হয়েছিল ওই সুড়ঙ্গে। তাঁদের কেউ এসেছেন গিরিডি থেকে, তো কেউ খুন্তি বা পশ্চিম সিংভূম থেকে। সকলে একসঙ্গে ওই সুড়ঙ্গ থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে অক্ষত ভাবে, তা এখন স্বপ্নের মতোই লাগছে সকলের সঙ্গে।

পরিবারের মানুষ এ কদিন নিজেদের বাড়িতে বসে অন্য লড়াই লড়েছেন। ছেলে সুড়ঙ্গে বন্দি, বাড়িতে চড়েনি হাঁড়ি। কারণ সেই অর্থটুকুও নেই তাঁদের কাছে। কোনওমতে পড়শিরা যা দিয়েছেন, তা দিয়ে চলেছে। খিরবেড়া থেকে এসেছিলেন রাজেন্দ্র নামে এক শ্রমিক। তাঁর মা পক্ষাঘাতের রোগী। এক প্রকার ছেলেকে ফেরার আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন। মঙ্গলবার ছেলের মুক্তির খবর পেয়ে হুইলচেয়ারে বসেই হাততালি দিয়ে উঠলেন বছর পঞ্চান্নর শ্রাবণদেবী। খিড়বেড়া থেকে আসা সুখরামের বাড়ির ছবিটাও একই রকম।

আরও পড়ুন:“স্নান করে নিস কিন্তু” : সুড়ঙ্গ থেকে বেরিয়ে আসা বাংলার শ্রমিককে বললেন মা

সুড়ঙ্গে আটকা পড়ার প্রায় ৭০ ঘণ্টা পরে তাঁদেক সঙ্গে যোগাযোগ হয় উদ্ধারকারীদের সঙ্গে। তার আগে পর্যন্ত মৃত্য়ুর জন্য় দিন গুনেছেন তাঁরা শুধু। এ কদিন বারবার হতাশা এসে চেপে ধরেছে। ভয় করেছে, আতঙ্কে বুক ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে। ওই অন্ধকার সুড়ঙ্গের ভিতরেই কোনওমতে খাওয়া, ওই খানেই শোয়া। ওই খানেই কোনও মতে হাল্কা হতেন শ্রমিকেরা। তখন অবশ্য এসব বাদবিচারের জায়গা ছিল না। যে কোনও ভাবে টিকে থাকাটাই ছিল প্রধান শর্ত। উদ্ধারকারী দলের সঙ্গে যোগাযোহ হওয়ার পরে প্রথমবার আশা ফিরে পান শ্রমিকেরা। তার পর রোজ ভেবেছেন, আজই এই অন্ধকার সুড়ঙ্গে শেষ দিন। আজই বোধহয় মুক্তি। উদ্ধারকারীদের হাতে এসে পৌঁছেছে কলা, লেবু, আপেলের মতো ফল। দুপুরে-রাতে এসে পৌঁছতো ভাত-ডাল-রুটি। বিশুদ্ধ জলের বোতল পাঠানো হত ওই পাইপের মাধ্যমে।

সেখান থেকে জিতে যেতে যেতে শেষপর্যন্ত ১৭ দিনের মাথায় ফের এই মায়াবী পৃথিবীর আলো, জল, বায়ু। এ যেন অসম্ভব সত্যি হওয়া। যা হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে যেন ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না সুখরাম, অনিল বা রাজেন্দ্রদের। এ যেন তাঁদের কাছে এক নতুন জন্ম।

More Articles