গায়ে দাগ লাগেনি এতটুকুও, ভাঙা সরকারি বাড়িই আশ্রয় বামফ্রন্ট সরকারের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ দে-র
Life of Partha Dey Education Minister Left Front : আজও শ্রদ্ধায় মাথা নুইয়ে যায়, পার্থ দে তাঁদের মধ্যে একজন। যার ব্যক্তিগত জীবনের গায়ে একবিন্দু আঁচড়ও লাগেনি।
"চক্রধরপুর প্যাসেঞ্জারে যেদিন সকালবেলা হাওড়া নামলাম, সেটা ২৩শে জুন, ১৯৭৭ সাল। আগের দিনই সম্ভবত জানতে পারি আমি মন্ত্রী হচ্ছি। প্রমোদদা (প্রমোদ দাশগুপ্ত) বাঁকুড়া জেলা অফিসে ফোন করে জানিয়েছিলেন। মন্ত্রী-টন্ত্রী হওয়া কাকে বলে তখন এসবের কিছুই জানতাম না, দল ভোটে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে, জিতে গিয়েছি। ব্যস, এটুকুই। জিতব তেমন আশাও ছিল না একেবারেই। একটা আধময়লা পাঞ্জাবি, পায়ে হাওয়াই চটি। ভিড়ে ঠাসা হাওড়া স্টেশনে নামলাম। কলকাতায় তখনও কেউ চেনা নেই, জানা নেই। পরিচিতর মধ্যে শুধু শঙ্করদা (শঙ্কর গুপ্ত)। জ্যোতিবাবু তখনও আমাদের নাগালের বাইরে।
পকেটে যা ছিল তাতে বাস ভাড়া হবে না। হাওড়া থেকে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম শঙ্করদার এন্টালির বাড়িতে। বৌদি লিকার চা আর বিস্কুট দিলেন, সব বুঝেটুঝে নিয়ে পৌছলাম রাজভবনে। সেখানে গিয়ে তো দেখি এলাহি ব্যাপার (একটু হেসে)। যাই হোক, একপ্রকার মনে ভয় নিয়ে সব বড় বড় মানুষের পাশে বসলাম। জ্যোতিবাবু, বিনয় চৌধুরী সামনে বসে। শপথগ্রহণ হল, আমি মন্ত্রী হলাম। ফরোয়ার্ড ব্লকের শম্ভু বাবু (শম্ভু দাশগুপ্ত) উচ্চশিক্ষার দায়িত্বে এলেন। আমি মধ্য। তারপর সেখান থেকে আমরা হৈ হৈ করতে করতে গেলাম রাইটার্সে। সেই প্রথম কলকাতাকে এভাবে দেখা। গোটা শহর যেন আবেগে টগবগ করে ফুটছে। সদ্য শপথ নেওয়া বামফ্রন্ট সরকারকে নিয়ে তাঁদের বিরাট প্রত্যাশা।
ওঁরা প্রথমে জ্যোতিবাবুকে সংবর্ধনা দিল মহাকরণের সামনে। তারপর আমরাও ঢুকলাম ভিতরে। বিশাল বিল্ডিং, কিছুই তো বুঝতে পারছি না। মন্ত্রী হয়েছি ঠিকই, কিন্তু কী করব কিছুই তো জানি না। করিডোরে একটা কাঠের চেয়ারে বসে রয়েছি, আর বোঝার চেষ্টা করছি ব্যাপারটা। কলকাতার কোনও নেতা-মন্ত্রীই আমাকে সেভাবে চেনেন না, যেহেতু আমি বাঁকুড়া থেকে প্রার্থী ছিলাম। যাই হোক, হঠাৎ একজন স্যুট বুট পড়া আমলা আমার দিকে এগিয়ে এলেন, তিনি সম্ভবত বুঝেছিলেন আমি মন্ত্রী হয়েছি। ডেকে নিয়ে গেলেন একটা বিরাট ঘরে। বললেন, এই ঘরে জয়নুল আবেদিন বসতেন। আজ থেকে এটা আপনার ঘর। আপনি পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা মন্ত্রী।"
কথা হচ্ছিল, বাংলার প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ দে-র সঙ্গে। একটি তথ্যচিত্রের সাক্ষাৎকার নেওয়ার সূত্রে প্রায় মাস তিনেক ঘুরে পাওয়া গেল এই পঁচাশি পেরনো লাল পার্টির নেতাকে। বুদ্ধবাবুর পাশেই সাড়ে পাঁচশো স্কোয়ার ফিটের সরকারি আবাসনে থাকেন, হাঁটতে গেলে স্ত্রীর সাহায্য নেন। জ্যোতি বসুর ছবিতে রোদ এসে পড়ে পাম এভিনিউয়ের ছোট্ট ঘরে, কদম গাছের ফাঁক দিয়ে। বয়সজনিত কারণে আজকাল স্মৃতিভ্রংশ হয়ে যায়। তবু এই লুটেপুটে খাওয়া রাজনীতির করিডোরে যে গুটিকয়েক মানুষকে দেখলে আজও শ্রদ্ধায় মাথা নুইয়ে যায়, পার্থ দে তাঁদের মধ্যে একজন। যার ব্যক্তিগত জীবনের গায়ে একবিন্দু আঁচড়ও লাগেনি। যাদের দেখলে একটা মেধাবী ছেলে দামি চাকরি ছেড়ে রাজনীতি করতে চাইবে এই আকালেও।
আরও পড়ুন : ৪০০ স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাটে জীবন কাটল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের, সততার সহজপাঠ ছিল হাতের কাছেই
প্রথম বামফ্রন্ট সরকারের যে দু'জন মন্ত্রী জীবিত রয়েছেন, তাঁদের মধ্যে একজন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, অন্যজন এই পার্থ বাবু। পাঁচবার বিধানসভা নির্বাচনে জিতেছেন, মন্ত্রী থেকেছেন দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে। এখনও অবলীলায় বলে দেন, "আমি তো মানুষের জন্য কিছুই করতে পারিনি। তবু কেন যে তাঁরা আমায় এতদিন ধরে ভোট দিয়ে জেতালেন, সেটাই বুঝতে পারি না।" পাশ থেকে স্ত্রী চিন্ময়ী দে বলে ওঠেন, এখনও বাঁকুড়ার রাস্তা দিয়ে উনি হেঁটে গেলে মানুষ প্রনাম করে যান। বলেন, "বাবু তুই আমাদের মাঠ ময়দানে ফিরে আয়। তুই এলেই সব ঠিক হয়ে যাবেক!"
ইন্টারনেট জমানার সবচাইতে অগ্রগণ্য কতগুলো শব্দের মধ্যে অবশ্যই এগিয়ে থাকবে ভাইরাল কিংবা ট্রেন্ডিং। প্রতিনিয়ত যা বদলে যাচ্ছে। আজ যদি সেই তালিকায় ভুবন বাদ্যকার থাকেন, কাল প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী ও শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টপাধ্যায়। যেদিন রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় গ্রেফতার হয়ে 'ভাইরাল' হলেন, সেদিন ইন্টারনেট জুড়ে একটা ছবি বেশ দেখা যাচ্ছিল। যার একপাশে ছিলেন বাম আমলের পাঁচবার জেতা বিধায়ক তথা মন্ত্রী পার্থ দে। যিনি দাঁড়িয়ে আছেন, তার বাঁকুড়ার জরাজীর্ণ বাড়ির সামনে, পাশেই পার্থ চট্টপাধ্যায়ের ছবি ও তাঁর ঘনিষ্টের বাড়ি থেকে উদ্ধার হওয়া কোটি কোটি টাকা। বিশেষত বামপন্থী বন্ধুরা ফেসবুক জুড়ে লিখছিলেন, 'আমাদের কী ছিল, আর আজ কী পড়ে রয়েছে!' দুই পার্থকে পাশাপাশি রেখে মেলানো যাচ্ছিল না একেবারেই। তবু নামের গুণে তিনিও ট্রেন্ডিং!
ছেলেবেলায় মাকে এসে পাড়ার লোকেরা বলে গিয়েছিল, আপনার ছেলে তো ডাকাতদের সঙ্গে মিশছে। সেই যুগে বাঙালি মধ্যবিত্তের একটা অংশ কমিউনিস্টদের 'ডাকাত' বলেই চিনত। তবু সেই 'ডাকাতের দলে'ই গিয়ে মিশলেন শেষমেশ। 'ডাকাতের দলের' হয়ে মন্ত্রিত্বও সামলালেন দীর্ঘদিন। সারাজীবন কাটিয়ে ফেললেন সেই একই পতাকার মিছিলে।
রাজ্য থেকে চলে গিয়েছে বামফ্রন্ট সরকার, ভোটের অঙ্কে বিধানসভা থেকেও নিশ্চিহ্ন কাস্তে-হাতুড়ি-তারা। সেই সেদিনের প্রথম বামফ্রন্ট সরকারের দিনগুলি এখনও অল্প অল্প মনে পড়ে পার্থ বাবুর। ভূমি সংস্কার, গ্রামে গ্রামে পঞ্চায়েত ব্যবস্থার ফলে গ্রামীণ অর্থনীতির বিকাশ, বাচ্চারা দল বেঁধে স্কুলে যাচ্ছে। মানুষের দু'বেলা খাওয়া জুটছে ভরা ভাদ্র-আশ্বিনের দুপুরেও। এসব ভেবেই রোমাঞ্চিত হন। আজকের আধুনিকতার আলো এই স্মৃতি ভেদ করে পৌঁছতে পারে না। বিরোধী দল, শিক্ষাক্ষেত্রে দুর্নীতি, চাকরি চুরি, খবরের কাগজের হেডলাইন শুধু বেদনা দেয় একটা মনকে।
আরও পড়ুন : জেলবন্দি, অসহায় পার্থর ভাগ্যের চাকা ঘুরছে কোনদিকে
কেন কমিউনিস্ট হলেন? কী পেলেন আর কী হারালেন এই জীবন থেকে?
উত্তর দেন না। অনেকবার জানতে চাইলেও বলতে চান না কিছুই। কোথাও আমিত্বের সেই বড়াইটাই নেই। "ওই লাল পতাকাটাই সব। ওটা ছাড়া আমি কিচ্ছু নই। আজ আপনি যে আমার ইন্টারভিউ নিতে এসছেন, সেটাও ওই পতাকার জন্য। নইলে কে চিনত আমায়?"
সময়ের যে ন্যুনতম আঁচ লাগার কথা একটা মানুষের গায়ে, সেটুকুও নেই পার্থ বাবুর। অধুনা সংবাদমাধ্যম, সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে আজ রাজনীতিকে যে পর্যায়ে দেখতে আমরা অভ্যস্ত, তা থেকে অনেক দূরেই থাকেন। যখন গোটা সমাজে আমিগুলোর ভিড় বাড়ছে রোজ, এই পার্থ দে-রা 'আমরা' হয়ে থেকে গেলেন আজীবন।