শরীরে জটিল অসুখ, ভাগ্নির সঙ্গে বিয়ের 'গুঞ্জন', তবুও অমলিন ভারতের 'ডান্সিং কিং' প্রভু দেবা

Prabhu Deva Dancing King : গোটা ভারতকে মুগ্ধ করে রেখেছেন ‘ডান্সিং কিং’। এই নামেই তাঁকে ডাকেন সবাই। ভারতীয় সিনেমার নাচের রাজা প্রভু দেবা।

১৯৮৬ সাল। ভারতের স্বাধীনতা দিবসের দিন দক্ষিণে একটি তামিল ছবি মুক্তি পেল। নাম ‘মৌনা রাগম’। দেশাত্মবোধক কোনও সিনেমা নয়, বরং আদ্যোপান্ত প্রেমের ছবি। আর পরিচালক? স্বয়ং মণিরত্নম! সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন কিংবদন্তি শিল্পী ইলাইয়ারাজা। সব মিলিয়ে বেশ বড়সড় ব্যাপার। সেবছরই এই সিনেমার জন্য সেরা পরিচালকের পুরস্কার পান মণিরত্নম। সেই সিনেমাতেই একটি গানের দিকে চোখ ফেরানো যাক। ‘পানিভিঝুম ইরাভু’ গানটি যখন পর্দায় দেখানো হচ্ছিল, তখন বছর তেরোর এক কিশোর বেশ আগ্রহ নিয়ে দেখছিল। গায়ের রং শ্যামলা, মাথায় কোঁকড়ানো চুল, রোগা চেহারা। ওই গানেরই একটি জায়গায় এক বাচ্চা ছেলের বাঁশি বাজানোর দৃশ্যে অভিনয় করেছে সে। জ্বলজ্বলে চোখে সে তাকিয়েছিল রুপোলী পর্দায়। কতদিনের স্বপ্ন ছিল তার, অবশেষে পূরণ হল।

কিন্তু এখানেই কি থেমে যাবে সবটা? আর এগোবে না? সিনেমা আর ‘লাইট, ক্যামেরা, অ্যাকশন’-এর মন্ত্র তখন কানের ভেতর ধাক্কা মারছে বারবার। অবশ্য শ্যামলা বর্ণের কিশোরটির স্বপ্ন স্রেফ পর্দায় মুখ দেখানো নয়। ততদিনে বাড়িতে সে জানিয়েছে তার স্বপ্নের কথা। কেবল অভিনয় নয়, নাচের তালে গোটা ভারত জয় করতে চায়। বাবা মুগুর সুন্দরও দক্ষিণী সিনেমায় কোরিওগ্রাফি করতেন। সেখান থেকেই নাচের পোকা নড়ে ওঠা। বাবার তো সায় ছিল প্রথম থেকেই। তাঁর এই ছেলের মধ্যে যে লুকিয়ে আছে অনেক বড় প্রতিভা। সেই ছোট্ট বয়স থেকে ভারতনাট্যমের ক্লাসে ভর্তি হয়ে গেল কিশোরটি। ভারতের ঐতিহ্যশালী সেই নৃত্যকলার হাত ধরেই প্রথমবার মঞ্চে যাওয়া। কিন্তু ওই কিশোর, চান্নামল্লিকার্জুনের স্বপ্ন তো এখানে থেমে থাকতে পারে না। সে চায় নাচের তালে ভারত একদিন তার সঙ্গে চলবে। একটু একটু করে দিন এগোল। আজ অবশ্য চান্নামল্লিকার্জুন বললে সেভাবে কেউ চিনতে পারবে না। বরং গোটা ভারতের কাছে তিনিই সেরা… তিনিই প্রভু দেবা!

আরও পড়ুন : চা খেতে ডেকেছিলেন খোদ দাউদ ইব্রাহিম! ঋষি কাপুরের বয়ানেই স্পষ্ট বলিউডের মাফিয়া যোগ?

সেই ছোট্টবেলায় মণিরত্নমের সিনেমার ছোট একটি রোলে জায়গা পেয়েছিলেন প্রভু দেবা। তার পরের যাত্রাটা খুব একটা মধুর ছিল না। কিন্তু জীবন তো মধ্যবিত্তের জন্য গোলাপ বিছানো রাস্তা সাজিয়ে রাখেনি! বরং আড়ালে থাকা কাঁটার ঘায়ে রক্তাক্ত হওয়াই তার নিয়ম। প্রতিবার ছুরি এসে লাগবে শরীরে, আর সেটা নিয়েই চলতে হবে। আর যারা মহান হন? তাঁরা সেই ছুরিকা বিদ্ধ হয়েও রক্তের ফোঁটাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেন। আজ প্রভু দেবা মঞ্চে উঠলে হাজার হাজার মানুষ তাকিয়ে থাকেন তাঁর দিকে। একমুখ দাড়ি, রোগা, পেটানো চেহারা, শ্যাম বর্ণ – কোনওভাবে তথাকথিত ‘হিরো’র চেহারা নয় তাঁর। কিন্তু নিজের নাচের ম্যাজিকে গোটা ভারতকে মুগ্ধ করে রেখেছেন ‘ডান্সিং কিং’। এই নামেই তাঁকে ডাকেন সবাই। ভারতীয় সিনেমার নাচের রাজা প্রভু দেবা।

ভারতনাট্যম দিয়ে প্রশিক্ষণ শুরু হলেও, ওয়েস্টার্ন ফর্মও চর্চা করতে থাকেন তিনি। সেইসঙ্গে চলতে থাকে কোরিওগ্রাফি। তখনও ১৮ পেরোননি প্রভু দেবা। তার আগেই কোরিওগ্রাফির লাইনে ঢুকে পড়েন তিনি। প্রতিভা তো ছিলই, সেইসঙ্গে ছিল অধ্যবসায়। ব্যাকগ্রাউন্ড ডান্সার থেকে কোরিওগ্রাফি, একটু একটু করে উত্তরণটা দেখতে শুরু করেন প্রভু। নাচের জগতেও তিনি পরিচিত মুখ হয়ে ওঠেন। তাঁর প্রতিটা স্টেপ, তাল গোগ্রাসে গিলতে থাকে উঠতি শিল্পীরা। প্রভু দেবা ধীরে ধীরে একটা বিশ্বাস হয়ে উঠছিলেন। ভারতের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা অজস্র তরুণ তরুণী, যারা নাচের মঞ্চ কাঁপানোর স্বপ্ন দেখেন, তাঁদের মুখ হয়ে উঠছিলেন তিনি।

তবে এসবের পাশাপাশি আরও একজন ছিলেন, যাকে অন্ধের মতো মানতেন প্রভু দেবা। বলা যায়, একলব্যের মতোই ছিল সেই সম্পর্কটি। তিনি আর কেউ নন, স্বয়ং মাইকেল জ্যাকসন। ১৯৯৯ সালে এসেও গেল একটা সুযোগ। জার্মানির মিউনিখ শহরে খোদ মাইকেল জ্যাকসন অনুষ্ঠিত করেছিলেন লাইভ কনসার্ট ‘এমযে অ্যান্ড ফ্রেন্ডস’। সেখানেই এআর রহমান আর অভিনেত্রী শোভনার সঙ্গে হাজির হয়েছিলেন প্রভু দেবা। মাইকেল জ্যাকসন তাঁর গানের পাশাপাশি নাচের জন্যও পৃথিবী বিখ্যাত। প্রভু দেবার মতো ধুরন্ধর প্রতিভা সেই স্টেপ, মুনওয়াক শিখে নিলেন অতি দ্রুত। তারপর মিউনিখের সেই কনসার্টে অনবদ্য পারফর্মেন্স। ব্যস, আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। গোটা দেশের লাখ লাখ মানুষের কাছে তিনি হয়ে গেলেন ‘ভারতের মাইকেল জ্যাকসন’। আজও সেই নামেই তাঁকে ডাকেন অনেকে।

আরও পড়ুন : ফলের দোকান থেকে বলিউডের শেষ কথা! ধাপে ধাপে যেভাবে তৈরি হয়েছে টি-সিরিজের সাম্রাজ্য

তবে ওই যে, জীবন বড় জটিল এক রাস্তা। সেখানে কেবল গোলাপ বিছানো রাস্তাই নয়, সঙ্গে রয়েছে ইট, পাথর, তীক্ষ্ণ কাঁটা। কখনও কখনও ধস নেমে ঢেকে দেয় সমস্তটা। প্রভু দেবার জীবন সেরকমই চড়াই উৎরাইয়ের এক কাহিনি। নাচের কেরিয়ারে তিনি কিংবদন্তিসম, অভিনয় আর পরিচালকের জায়গায় হিট ফ্লপ দুটোরই স্বাদ পেয়েছেন। কিন্তু তছনছ হয়ে আছে ব্যক্তিগত জীবন। ভারতনাট্যম নাচ শিখতে শিখতেই আলাপ হয়েছিল ছোটবেলার প্রেমের সঙ্গে – রামলতা। তিনিও ছিলেন নৃত্যশিল্পী। ব্যস, দুইয়ে দুইয়ে চার হতে আর কতক্ষণ! ১৯৯৫ সাল। ততদিনে প্রভু দেবার নাম ছড়িয়ে পড়েছে গোটা ভারতে। তখনি ছোটবেলার সেই প্রেম রামলতাকে বিয়ে করলেন তিনি। তিন সন্তানও হয় তাঁদের। বাইরে থেকে দেখলে, সুখী সংসারের একটি ছবি। কিন্তু সেখানেই ফুটল ‘নয়নতারা’ ফুল।

দক্ষিণী সিনেমা জগতে সেই সময় অন্যতম শীর্ষে ছিলেন নয়নতারা। কাজের সূত্রে একটু একটু করে প্রভু দেবার সঙ্গে ভাব, কথাবার্তা শুরু। সেই কথাবার্তা প্রেমে গড়াতে সময় লাগেনি। সম্মতি ছিল দুই তরফেই। প্রভু দেবাও সংসার ভুলে ভালোবেসে ফেলেন নয়নতারাকে। শুরু করেন লিভ-ইনও। কিন্তু সেটা জানাজানি হতে বেশি সময় লাগেনি। প্রভু দেবার ঘর অবধি পৌঁছে যায়। স্ত্রী রামলতার তখন মাথায় হাত। বড় ছেলে প্রবল অসুস্থ, সংসার টালমাটাল, এই অবস্থায় প্রভু দেবা কোথায়? দুর্ভাগ্যবশত, ২০০৮ সালে মারা যায় প্রভু-লতার বড় ছেলে, বিশাল। কারণ? ক্যানসার…

আরও পড়ুন : বলিউডের নতুনরা খারাপ ছাত্র, সকলে শুধু বিখ্যাত হতে চায়: তিগমাংশু ধুলিয়া

তখনও প্রভু দেবার সঙ্গে নয়নতারার সম্পর্ক নিয়ে পেজ থ্রি রঙিন হচ্ছে। রামলতা চেষ্টা করছেন, যাতে অবস্থা ঠিক হয়। একসময় হাল ছেড়ে দিলেন। ততদিনে প্রভু দেবাও জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি নয়নতারাকে ভালোবাসেন। দুজনে ঘর বাঁধার স্বপ্নও নাকি দেখছেন! এরপর যেন আগুনে ঘি পড়ে। স্ত্রী রামলতা অনশনের হুমকি দেন। এই ত্রিকোণ সম্পর্ক নিয়ে তখন উত্তাল দক্ষিণী ছবির জগত। নয়নতারার কুশপুতুল দাহ করা হচ্ছে, বিক্ষোভও চলছে। কিন্তু কোনওকিছুই স্থায়ী হয়নি।

২০১১ সাল। একসময় বাধ্য হয়ে ডিভোর্সের পাতায় সই করেন রামলতা। ভাগ্যের মার এখানেই থেমে থাকেনি। যে প্রেম নিয়ে এত গণ্ডগোল, নয়নতারার সঙ্গে সেই প্রেমই ভেঙে যায় এক বছর পরই! শোনা যায়, এরপর নাকি নিজের ভাগ্নির প্রেমে পড়েন প্রভু দেবা! তাঁকেও নাকি বিয়ে করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু অচিরেই জানা যায়, সেসব গুজবমাত্র।

তবে আজও মঞ্চে উঠলে তিনিই রাজা। দেশের অজস্র তরুণ তরুণী তাঁর দিকেই তাকিয়ে থাকেন। তাঁরা হয়তো কেউ জানেন না, ভেতরে ভেতরে প্রভু দেবার শরীর কতটা দুর্বল। জটিল অসুখে আক্রান্ত তিনি, সঙ্গে রয়েছে স্পন্ডালাইটিস। ঘাড় একেবারে নিচু করতে পারেন না। তবুও মঞ্চের আলো পড়লে তিনিই সেরা, তিনিই ‘ডান্সিং কিং’। তিনিই প্রভু দেবা।

More Articles