যুদ্ধ মিলিয়ে দিয়েছে আমাকে আর আমার প্রাক্তনকে!

Israel Palestine War 2023 : আমি যখন এই লেখাটা লিখছি, তখনও গাজা থেকে আমাদের শহরগুলিতে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হচ্ছে

৭ অক্টোবর, শনিবারের সকাল। আমি তখনও বিছানা ছাড়িনি। আমার সাড়ে তিন বছরের মেয়ে আমার পাশেই ঘুমোচ্ছিল। ওর ঠাকুমার সঙ্গে দেখা করতে যাব ঠিক করেছি, এই শহরে সম্প্রতি একটা নতুন খেলার মাঠ তৈরি হয়েছে, সেটাও দেখতে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। সকাল সাড়ে ৭টার এক ফোনে ঘুম ভাঙল! এত সকালে কে ডাকে? অবাক হয়ে গেলাম, এত সকালে আমার প্রাক্তন স্ত্রী-র ফোন! ঘুম জড়ানো গলাতেই জিজ্ঞাসা করলাম, কী ব্যাপার? ওর গলার স্বর ভারী, তরবড়িয়ে কথা বলছে। ওর বাড়ির কাছেই ক্ষেপণাস্ত্র সতর্কীকরণ অ্যালার্ম বাজার শব্দ পেলাম! প্রাক্তন স্ত্রী জানতে চাইল, আমরা ঠিক আছি কিনা। আমি বললাম, কই কিছুই তো হচ্ছে না, এখানে কোনও অ্যালার্ম নেই। সত্যি বলছি, আমি ফোনটা রেখে আবার পাশ ফিরে ঘুমোতে চেয়েছিলাম। আমি যখন ফোন রাখলাম, দেখি আমাকে গত এক ঘণ্টা ধরে মেসেজ করছে আমার প্রাক্তন স্ত্রী।

এক মিনিটেরও কম সময়ে অ্যালার্ম বেজে উঠল, সারা তেল আভিব জুড়ে বেজে উঠল সাইরেন। হামাস ইজরায়েলে হামলা চালিয়েছে এবং শহরে ক্ষেপণাস্ত্রের বর্ষণ শুরু হয়েছে। সৌভাগ্যবশত, আমাদের এই অ্যাপার্টমেন্টে একটি কংক্রিটের তৈরি সুরক্ষিত কক্ষ রয়েছে। আমরা সেখানেই ছিলাম, চুপ করে, ভয়ে সিঁটিয়ে বসেছিলাম। বসে বসে শুনতে পাচ্ছি, রকেটগুলো আমাদের মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে, বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। আমি মোবাইলে নিউজ অ্যাপ খুললাম। বাকিটা স্পষ্ট হয়ে গেল, বুঝতে পারলাম এবার পরিস্থিতি আরও খারাপ। এ নিছক শুধু কোনও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা নয়; এ এক সর্বগ্রাসী আক্রমণ।

আরও পড়ুন- হাসপাতাল থেকে আর কখনও ফিরবে বাবা? গাজায় পথ চেয়ে একরত্তি মেয়ে

এরই মাঝে নানা ভুলভাল খবর। গাজা সীমান্তের পাশের শহর এবং গ্রামগুলিতে অস্ত্রধারী হামাস সন্ত্রাসবাদী দলের অনুপ্রবেশের বিষয়ে ভয়ঙ্কর এবং বিভ্রান্তিকর প্রতিবেদন ভেসে উঠছে ফোনের পর্দায়। কেউ জানছে না আসলে কী হচ্ছে। তবে ব্যাপারটা কল্পনাতীত! এমন কীভাবে ঘটতে পারে? এই একটি প্রশ্নই প্রত্যেক ইজরায়েলি গত ৭ দিন ধরে নিজেদের জিজ্ঞাসা করছে। আমার প্রাক্তন স্ত্রী আবার ফোন করেছিল। প্রচণ্ড ভয় পেয়েছিল, ওর বাড়ির কাছে কোনও বোমা থেকে বাঁচার মতো আশ্রয়ও নেই। হঠাৎ জানাল, আমাদের সঙ্গেই থাকতে চলে আসছে সে।

চুপচাপ প্রাণ বাঁচিয়ে যখন লুকিয়ে আছি, ফোনের অ্যাপে খবরের দিকেই কেবল আঠার মতো সেঁটে রয়েছে চোখ। কোনও টিভি বা রেডিয়ো চালাইনি, যাতে আমার ছোট্ট মেয়েটি এই ভয়ঙ্কর নৃশংস জিনিস চোখে না দেখে। বোমা থেকে বাঁচতে আশ্রয়কেন্দ্রে দৌড়ে যাওয়ার কাজটিকে ততক্ষণে খেলায় পরিণত করেছি: এক অদ্ভুত প্রতিযোগিতা! প্রতিবার মিসাইলের অ্যালার্ম বাজলেই দৌড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে ঢুকতে হবে নিরাপদে। যে আগে ঢুকবে সেইই জিতবে- আমার মেয়ে প্রতিবার জিতেছে।

সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে আমরা বুঝে গেলাম নৃশংসতার মাত্রা কতখানি তীব্র। আমাদের পুরো পৃথিবী ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। প্রত্যেকেই ফোনে বন্ধু এবং আত্মীয়দের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা। সবাই ঠিক আছে কিনা খোঁজ নেওয়ার জন্য অধীর উৎকণ্ঠায় বসে স্বজনরা। ফোনে যে সবসময় আশ্বস্ত হওয়ার মতো উত্তর মিলছে তাও না। কে যে কাকে কী বলব, জানি না। ওই পরিস্থিতিতে কী ভাবব তাও জানি না। আমরা সবাই শুধু হতবাক।

নিরস্ত্র নাগরিকদের লক্ষ্য করে এ ছিল এক সূক্ষ্মভাবে পরিকল্পিত, নজিরবিহীন নৃশংস হামলা। হামাস সন্ত্রাসীরা ইজরায়েলের শহর ও গ্রামে ঢুকে পড়ে, তাদের সামনে পড়া প্রতিটি নাগরিককে হত্যা করেছে, ধর্ষণ করেছে এবং নির্বিচারে পুড়িয়ে দিয়েছে। শিশুদের ওদের বিছানাতেই হত্যা করা হয়েছে, পরিবারকে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এবং শিশুদের অপহরণও করা হয়েছে। একটি রেভ পার্টিতে শত শত যুবক-যুবতীকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
১৩০০ জনেরও বেশি খুন হয়েছে, ৩,০০০ আহত এবং ১৩০ জন নারী ও শিশু অপহৃত। একজন সাধারণ মানুষ এই সংখ্যা গুনলে তাঁর কী অবস্থা হতে পারেন জানেন? মনের কী অবস্থা হয় জানেন? অমানবিকতার সীমা ছাড়িয়ে গেছে।

আরও পড়ুন- থিয়েটার করতেন চুটিয়ে, স্ত্রী-শিশুদের খুন করে ইজরায়েল! হামাসের মাস্টারমাইন্ড দেইফ এক রহস্য

একজন ছাত্র হিসাবে আমি ৪ বছর গাজা সীমান্তের একটি কিবুতজে থেকেছি, এই অঞ্চলের সঙ্গে আমার গভীর আবেগ জড়িয়ে, ব্যক্তিগত সংযোগ আমার। সমস্ত সংবাদ প্রতিবেদন এবং ফুটেজ দেখে তাই সহজেই চিনতে পেরেছি। প্রতিটি গ্রামের নাম আমার জানা, প্রতিটি শহরে আমার অনেক ভালো স্মৃতি রয়েছে। ইজরায়েল ছোট জায়গা। অনেক মানুষই একে অপরকে চেনে। আমরা প্রত্যেকেই এমন কোনও না কোনও মানুষকে চিনি যারা আক্রান্ত হয়েছেন এই হামলায়, স্বজন হোক বা বন্ধু। আমি ভাগ্যবান, আমার পরিবার ঠিক আছে. কিন্তু অনেকেরই সব শেষ হয়ে গেছে।

আমার দেশ হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। সবকিছুই জরুরি অবস্থার মধ্যে রয়েছে এখন। সমস্ত স্কুল এবং কিন্ডারগার্টেন বন্ধ করা হয়েছে; রাস্তা ফাঁকা কারণ প্রত্যেককে সবসময় বম্ব শেলটারের কাছে থাকতে হচ্ছে। সীমান্তের দু’পাশে ব্যাপকভাবে উচ্ছেদ চলছে। আমি যখন এই লেখাটা লিখছি, তখনও গাজা থেকে আমাদের শহরগুলিতে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হচ্ছে; পুলিশ এবং সেনা বাহিনী এখনও ক্রমাগত আক্রমণে আরও বেশি সাধারণ মানুষকে হত্যা করার চেষ্টা করা সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। পুরো জাতি একত্রিত, সমাজের সর্বস্তরের মানুশ এই সংকটের সময়ে পরস্পরকে সাহায্য করছে।

আমার প্রাক্তন স্ত্রী এখনও এখানে, আমাদের নতুন পরিবারের সঙ্গেই আছে। সাত দিন আগে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে সে এখানেই থাকছে। আমি এবং আমার প্রাক্তন স্ত্রী যদি আমাদের মতবিরোধ এবং শত্রুতাকে একপাশে রেখে এক ছাদের নীচে থাকতে পারি, তবে মানবতার এখনও আশা আছে। আমি জানি না পরবর্তীতে কী হবে, তবে আমি জানি আমার দেশ চিরতরে বদলে গেছে।

 


জোসেফ কোহেন তেল আভিভের লেখক এবং চলচ্চিত্র নির্মাতা

More Articles