লেনিনের তত্ত্বে দ্বিমত, স্ট্যালিনের চক্ষুশূল! কমিউনিস্ট আন্দোলনের আশ্চর্য বিপ্লবী মানবেন্দ্রনাথ রায়

Indian Revolutionary M. N. Roy: ১৯১৯ সালে মানবেন্দ্রনাথ মস্কোতে লেনিনের সঙ্গে দেখা করে বলেন, তিনি তাঁর ‘অন ন্যাশনাল অ্যান্ড কলোনিয়াল কোয়েশ্চেনস’ শীর্ষক তত্ত্বের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন।

নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য (২১ মার্চ, ১৮৮৭ - ২৫ জানুয়ারি, ১৯৫৪) ছিলেন এক আশ্চর্য বাঙালি বিপ্লবী। বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের জন্য তিনি বহু ছদ্মনাম নিয়েছিলেন, মি. মার্টিন, মানবেন্দ্রনাথ, হরি সিং, ডা. মাহমুদ, মি. হোয়াইট, মি. ব্যানার্জি ইত্যাদি। তবে মানবেন্দ্রনাথ রায় বা এম. এন. রয় নামেই তিনি খ্যাত। তিনি ছিলেন একজন বর্ণময় আন্তর্জাতিক বিপ্লবী আর বিপ্লবীদের জগতে নিঃসঙ্গ।

মানবেন্দ্রনাথ উত্তর চব্বিশ পরগনার আরাবেলিয়াতে প্রাইমারি স্কুলে পড়তেন। বাবা ছিলেন পেশায় পুরোহিত। বাবা দীনবন্ধু ছোট থেকেই ছেলেকে সংস্কৃত পড়াতেন, নিয়ে যেতেন বিভিন্ন মঠ ও আশ্রমে। কিছুদিন পরে দীনবন্ধু পরিবারসমেত কোদালিয়ায় চলে এলে মানবেন্দ্রনাথ হরিনাভি অ্যাংলো-সংস্কৃত স্কুলে ১৯০৫ পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। ১৯০১ সালে ১৪ বছর বয়সে মানবেন্দ্রনাথ গোপন বিপ্লবী সংগঠন অনুশীলন সমিতিতে যোগ দেন। এটি নিষিদ্ধ হওয়ার পর তিনি যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় বা বাঘা যতীনের নেতৃত্বে যুগান্তর গোষ্ঠীকে সংগঠিত করার কাজে লেগে পড়েন। যতীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা হওয়া তাঁর জীবনের একটি টার্নিং পয়েন্ট হিসাবে বর্ণনা করেছিলেন মানবেন্দ্রনাথ। স্কুলে পড়ার সময় মানবেন্দ্রনাথের নেতৃত্বে একদল ছেলে প্রধান শিক্ষকের আদেশ অমান্য করে দেশনেতা সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে সংবর্ধনা জানাতে গেলে মানবেন্দ্রনাথসহ পুরো ছাত্রদলটিকেই স্কুল থেকে বহিস্কার করা হয়। তখন তাঁর বয়স ১৮।

এরপর ১৯০৬-এ জাতীয় শিক্ষা পরিষদ (এখন যা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করে যাদবপুরেরই বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়তেন। বছর তিনেকের মধ্যেই তিনি পড়াশোনা ছেড়ে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক কাজকর্মে জড়িয়ে পড়েন। তাঁর নেতা তখন যতীন্দ্রনাথ। সে সময়ে তিনি তাঁর গুপ্ত বিপ্লবী দলসহ সুন্দরবন এলাকায় পরীক্ষামূলকভাবে বোমা তৈরি এবং গুলি চালানোর চর্চা করেন। কিছুদিনের মধ্যেই মাত্র ২১ বছর বয়সে, ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ডাকাতিতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন গার্ডেনরিচ ও বেলেঘাটায়। রাজনৈতিক ডাকাতিতে অংশগ্রহণকারী সন্দেহে পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করলেও প্রমাণাভাবে ছাড়া পান। ১৯০৮ সালের নভেম্বরে, তিনি বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসুকে গ্রেফতারকারী পুলিশ অফিসার নন্দলাল বন্দ্যোপাধ্যায়কে গুলি করে হত্যা করেন। এবারও প্রমাণাভাবে পুলিশ তাঁকে ধরতে পারেনি।

আরও পড়ুন- সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর হাতে খুন হওয়া বিপ্লবী সঞ্জয় ঘোষ আজও নায়ক অসমে

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে বাঘা যতীন ও মানবেন্দ্রনাথ জার্মান সরকারের কাছে সাহায্যের আবেদন জানান। তাঁরা জার্মান সরকারের কলকাতার প্রতিনিধির সঙ্গে গোপনে দেখা করেন। জার্মান প্রতিনিধি জানান সামরিক ও অর্থ সাহায্য করা হবে। তখন মানবেন্দ্রনাথ চার্লস মার্টিন ছদ্মনামে বাটাভিয়ায় জার্মান কনসাল জেনারেলের সঙ্গে এই বিষয়ে আলোচনা করতে যান। ঠিক হয়, অস্ত্রের চালান ও গোলা-বারুদ সুন্দরবন এলাকায় পাঠানো হবে। কিন্তু অস্ত্রের চালান ভারতে পৌঁছায় না, এদিকে জার্মান অস্ত্র ভারতে আসছে জেনে পুলিশ ধরপাকড় শুরু করে। মানবেন্দ্রনাথ তখন গোয়ায় পর্তুগিজ সরকারের আশ্রয়ে চলে যান। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগের উদ্দেশ্যে বাঘা যতীন বিপ্লব ভোলানাথ চট্টোপাধ্যায়কে পাঠান গোয়াতে। যাওয়ার পথে ধরা পড়ে কারাগারে শহিদ হন ভোলানাথ।

মানবেন্দ্রনাথ আবার বাটাভিয়ায় ফিরে যান এবং সেখানে গিয়ে বোঝেন জার্মান কূটনীতিকরা তাঁকে সাহায্য করতে চান না। তিনি অস্ত্র ছাড়া ভারতে না ফেরার সিদ্ধান্ত নেন এবং হরি সিং ছদ্মনাম নিয়ে ফিলিপাইন চলে যান। সেখান থেকে নাম বদলে মি. হোয়াইট ছদ্মনামে জাপানের নাগাসাকি চলে যান, রাসবিহারী বসুর সঙ্গে দেখা করেন, কিন্তু তখনই কোনও আশা দেখাতে পারেননি রাসবিহারী। তখন তিনি দেখা করেন চিনা জাতীয়তাবাদী নেতা সান ইয়াত-সেনের সঙ্গে যিনি নানকিংয়ে ১৯১৩-র বিদ্রোহের ব্যর্থতার পর জাপানে পালিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি তাঁর কূটনৈতিক অবস্থানের কারণে মানবেন্দ্রনাথকে সাহায্য করতে অস্বীকার করেন। ইতিমধ্যে জাপানি সিক্রেট পুলিশ মানবেন্দ্রনাথের পিছনে পড়ে। তখন ব্রিটিশ–জাপান বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। জাপান সরকার তাঁকে ২৪ ঘণ্টার নোটিশে দেশ ছাড়তে বলায়, স্থলপথে কোরিয়া চলে যান তিনি। তারপর আবার গোপনে জাপানের কোবে শহরে ফিরে এসে নকল ফরাসি পাসপোর্ট (যা তাঁকে জার্মানরা দিয়েছিল) দেখিয়ে আমেরিকার ভিসা জোগাড় করে জাহাজে সানফ্রান্সিসকো চলে যান।

১৯১৬ সালের ১৪ জুন মানবেন্দ্রনাথ সানফ্রান্সিসকো পৌঁছন। পরের দিন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়, "একজন বিপজ্জনক হিন্দু বিপ্লবী ও জার্মান গুপ্তচর আমেরিকায় ঢুকেছে।" কাগজ চোখে পড়া মাত্র তিনি হোটেল ছেড়ে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যান। সেখানে তাঁর বিপ্লবী সহকর্মী যদুগোপাল মুখোপাধ্যায়ের ভাই অধ্যাপক ধনগোপালের কাছে আশ্রয় নেন। ধনগোপাল তাঁর নাম পাল্টে ফেলার উপদেশ দেন। তাঁরই উপদেশে তিনি নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য থেকে মানবেন্দ্রনাথ রায় (এম.এন রায়) হলেন। সানফ্রান্সিসকো বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালন গোষ্ঠীর সভাপতির মেয়ে ইভলিন লিওনোরার সঙ্গে তাঁর প্রেম হয়, তাঁরা বিয়ে করে পুলিশের ভয়ে শহর ছেড়ে নিউইয়র্কে লালা লাজপত রায়ের আশ্রয়ে গিয়ে ওঠেন এবং নিউইয়র্ক পাবলিক লাইব্রেরিতে মার্কসবাদ নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন মানবেন্দ্রনাথ।

১৯১৭ সালের এপ্রিল মাসে আমেরিকা জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং আমেরিকার পুলিশ ভারতীয় বিপ্লবীদের জার্মান চর হিসেবে গ্রেফতার করা শুরু করে। একদিন কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সভা শেষ করে ফেরার পথে মানবেন্দ্রনাথ গ্রেফতার হন। জামিনে ছাড়া পাওয়ার পর মার্কিন গোয়েন্দাদের চোখে ধুলো দিয়ে স্থলপথে পালিয়ে যান মেক্সিকোতে, স্ত্রী থেকে যান আমেরিকায়, এক অর্থে বিচ্ছেদ হয় তাঁদের। আমেরিকার প্রভাবশালী ব্যক্তি ড. জর্ডন তাঁকে একটি পরিচয় পত্র লিখে দেন।

এই চিঠির জোরে তিনি মেক্সিকোর রাষ্ট্রপতি কারাঞ্জা ও যুদ্ধমন্ত্রী সহ উচ্চপর্যায়ের অফিসার ও বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের সঙ্গে পরিচয়ের সুযোগ পান। রাষ্ট্রপতি তাঁকে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেন এবং একটি ভাল বাড়িও দেন থাকার জন্য। প্রসঙ্গত, মানবেন্দ্রনাথের সেই বাসস্থানটি বর্তমানে মেক্সিকো শহরের অভিজাত নাইটক্লাব। বিশেষ ধরনের সঙ্গীত ও শিল্পের প্রদর্শনী হয় এখন এখানে। নাম: এম এন রয়, শহরের প্রথম তিনটি নাইটক্লাবের একটি।

১৯১৮ সালের অগাস্ট মাসে মানবেন্দ্রনাথ বহু বক্তৃতা দিয়ে ও প্রবন্ধ লিখে ভারতের স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গঠন করেন। এ সময় তিনি রাশিয়ান, স্প্যানিশ, ফরাসি ও জার্মান ভাষা শেখেন। মেক্সিকোর রাষ্ট্রপতির আমেরিকা বিরোধী অবস্থানে মানবেন্দ্রনাথ ছিলেন একজন বেসরকারি উপদেষ্টা। মানবেন্দ্র সেখানে সোশ্যালিস্ট পার্টির সম্মেলন আয়োজন করেন। এই সময় বহু আমেরিকান সাংবাদিক, শিল্পী, কবি, বিজ্ঞানী ও দার্শনিক বাধ্যতামূলক সামরিক নিয়োগ এড়াবার জন্য মেক্সিকোতে পালিয়ে গিয়েছিলেন। রাষ্ট্রপতি কারাঞ্জা রায়ের জনপ্রিয়তায় খুশি হন। রায় এতই জনপ্রিয় ছিলেন যে, রাষ্ট্রপতি সোশ্যালিস্ট পার্টির প্রতিনিধিরূপে শ্রমমন্ত্রী হওয়ার জন্য তাঁকে অনুরোধ করেন।

সেই অনুরোধ ফিরিয়ে দিয়ে ১৯১৯ সালে মানবেন্দ্রনাথ মস্কোতে লেনিনের সঙ্গে দেখা করে বলেন, তিনি তাঁর ‘অন ন্যাশনাল অ্যান্ড কলোনিয়াল কোয়েশ্চেনস’ শীর্ষক তত্ত্বের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন। লেনিন মানবেন্দ্রনাথকে তাঁর থিসিস পেপার জমা দিতে বলেন। উভয় তত্ত্ব নিয়েই বিস্তারিত আলোচনা হয় এবং সোভিয়েত কংগ্রেসে দুই তত্ত্বই একত্রে গৃহীত হয়। কংগ্রেস অধিবেশনের পর মানবেন্দ্রনাথ কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের এশিয়ান ব্যুরোর দায়িত্ব পান। এর সদর দফতর স্থাপিত হয় তাসখন্দে। তিনি গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে ইরানের খোরাসান প্রদেশের রাজধানী মাশাদকে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর হাত থেকে মুক্ত করেন। রক্তপাতহীন বিপ্লবের মাধ্যমে বোখারায় সোভিয়েত সরকার গঠন করেন। খিলাফত আন্দোলনে ভারতীয় বিপ্লবীদের পুনর্বাসিত করেন। তাদের মধ্য থেকে শিক্ষিতদের সমাজতান্ত্রিক প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন এবং তাদের জন্য একটি সামরিক স্কুলও প্রতিষ্ঠা করেন। তাসখন্দেই থেকে যান।

১৭ অক্টোবর ১৯২০ সালে, তাসখন্দে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করেন রায়। তাসখন্দে প্রবাসী ভারতীয় ও দু'জন বিদেশি নাগরিককে নিয়ে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করেন। এই বছরই মানবেন্দ্রনাথ লেনিনের আমন্ত্রণে চলে আসেন মস্কোতে। কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের দ্বিতীয় কংগ্রেসে মানবেন্দ্রনাথ সবাইকে বিস্মিত করেন তাঁর বক্তব্যে। পরবর্তীকালে তাঁর থিসিসটি কংগ্রেসে লেনিনের থিসিসটির পরিশিষ্ট হিসাবে গ্রহণ করা হয়। তাঁর বিশ্লেষণী বক্তব্য ও স্বাধীন চিন্তার প্রতিফলন সবাইকে নতুন করে ভাবতে সাহায্য করে। এ ঘটনার পর লেনিন ও অন্য মার্কসবাদী নেতাদের কাছে মানবেন্দ্রনাথের আলাদা অবস্থান তৈরি হয়। মানবেন্দ্রনাথের সঙ্গে ট্রটস্কি, জিনোভিয়েভ ও স্ট্যালিনের আলাপ করিয়ে দেন লেনিন।

১৯২১ সালে তাসখন্দে প্রতিষ্ঠিত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি লাভ করে। এইবার মানবেন্দ্র তাঁর আসল লক্ষ্যে সফল হলেন। অবশেষে তিনি অস্ত্র পেলেন সোভিয়েত সরকারের কাছ থেকে। সোভিয়েত সরকারের দেওয়া দুই ট্রেন ভর্তি অস্ত্রশস্ত্র, সাঁজোয়া গাড়ি, রসদ ধনভাণ্ডার, সৈন্য, প্রশিক্ষক প্রভৃতি সঙ্গে নিয়ে মানবেন্দ্রনাথ তাসখন্দে পৌঁছন। এর আগেই আফগানিস্তান হয়ে ভারত থেকে আগত বিপ্লবীদের জন্য সামরিক স্কুল খোলা হয়েছিল। এবার মানবেন্দ্রনাথ তাঁর সঙ্গে আগত ও তাসখন্দের সামরিক স্কুলের প্রশিক্ষিত তরুণদের নিয়ে গঠন করেন ভারতীয় মুক্তি ফৌজ। মনে রাখতে হবে, এর অনেক পরে সুভাষচন্দ্র বসু ১৯৪২ সালে আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন করেন। এই বছরই অগাস্টে মানবেন্দ্রনাথ কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের তৃতীয় বিশ্ব সম্মেলনে যোগ দেন।

১৯২২ সালে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক মানবেন্দ্রনাথের ‘ইন্ডিয়া ইন ট্র্যানজিশন’ নামক গ্রন্থ চারটি ভাষায় প্রকাশ করে। এই বছরই রায় মস্কোতে শ্রমিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৩ সালে তিনি কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের এশিয়ান ব্যুরোর সদর দফতর বার্লিনে নিয়ে চলে যান এবং সেখান থেকে ভারতের জন্য লিখতে শুরু করেন। প্রথমে ‘দ্য ভ্যানগার্ড অব ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেনডেন্স’ পত্রিকা প্রকাশ করেন এবং ভারতে পাঠান। ভারত সরকার তাৎক্ষণিকভাবে এ পত্রিকা নিষিদ্ধ ঘোষণা করলে তিনি ‘অ্যাডভান্স গার্ড’ শিরোনামে এটি পুনঃপ্রকাশ করেন। এটিও নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। সর্বশেষে তিনি ‘দ্য মাসেস’ পত্রিকা প্রকাশ করেন এবং সেটিও নিষিদ্ধ হয়।

আরও পড়ুন- বাংলার প্রথম দলিত বিদ্রোহ ও এক ভুলে যাওয়া সংগ্রামী লেখক

১৯২৪ সালে তিনি কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য হন। লেনিনের জীবদ্দশায় রায় কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের সকল উচ্চপদে ছিলেন। ১৯২৬ সালে নভেম্বর মাসে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের কার্যকরী সমিতির এক সভা বসে। এ অধিবেশনে এম.এন.রায় আবার সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯২৭ সাল পর্যন্ত তিনি পশ্চিম ইউরোপে ছিলেন। সেখানে থাকার সময় তিনি জার্মানে ও ফ্রান্সে কমিউনিস্ট আন্দোলনের পরিচালনার কাজ করেন।

১৯২৭ সালে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের চিন কমিশনের যুগ্ম-সচিব হিসেবে স্ট্যালিনের পরামর্শে রায়কে কমিউনিস্ট ও কু মিন টাং-এর মধ্যে বিরোধ নিরসনে আলোচনার জন্য চিনে পাঠানো হয়। মানবেন্দ্রনাথ দক্ষতার সঙ্গে তাঁর মিশনটি পূরণ করা সত্ত্বেও, বিরোধ নিষ্পত্তিতে চিনের কমিউনিস্ট পার্টি ও রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে মানবেন্দ্রনাথের মতভেদ হয়। মস্কো ফিরে রায় অসুস্থ হয়ে পড়েন। এই মতভেদকে ভাল চোখে দেখেননি স্ট্যালিন।

১৯২৮ সালে পার্টির প্লেনামের আগে মানবেন্দ্রনাথ স্ট্যালিনের সঙ্গে দেখা করতে চাইলে, স্ট্যালিন দেখা করেননি, এমনকী প্লেনামে তাঁকে বক্তব্যও রাখতে দেওয়া হয়নি। এই সময় তাঁর কানে মারাত্মক ইনফেকশন হয়, স্ট্যালিনের নির্দেশে তাঁকে চিকিত্‍সার সুবিধেও দেওয়া হয়নি। শেষ পর্যন্ত নিকোলাই বুখারিন তাঁকে সাহায্য করেন, এজন্য তাঁকে স্ট্যালিনের চক্ষুশূল হতে হয়েছিল। যাই হোক, ট্রটস্কিকে পার্টি ও দেশ থেকে তাড়ানোর পর, বুখারিনের অনুরোধে স্ট্যালিন মানবেন্দ্রনাথকে চিকিৎসার জন্য বার্লিন যাওয়ার অনুমতি দেন। এই বছর বার্লিনে তাঁর সঙ্গে আলাপ হয় এলেন গটসচক নামে এক মহিলার, যিনি লেখক ও প্রগতিশীল পত্রিকার সম্পাদক।

১৯২৯ সালের ডিসেম্বর মাসে রায়ের অনুপস্থিতিতে কমিউনিস্ট বিরোধী সংবাদপত্রে রচনা প্রকাশ করার অপরাধে ও অন্যান্য অভিযোগে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক থেকে তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয়। তিনি তখন বার্লিনে চিকিত্‍সাধীন। ১৯৩০ সালে রায় স্থির করেন, দেশে ফিরবেন। ডা. মাহমুদ নামে পাসপোর্ট করিয়ে তিনি জাহাজে বোম্বাই শহরে আসেন। দেশে ফিরে মানবেন্দ্রনাথ তত্‍কালীন কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের, অর্থাৎ নেহরু ও সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। বছর খানেক কথাবার্তা চলার পর তিনি যখন ভাবছেন কংগ্রেসে যোগ দেবেন, ঠিক তখনই ১৯৩১ সালের জুলাই মাসে তিনি বোম্বাই শহরে গ্রেপ্তার হন এবং ১৯৩২ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত সরকার তাঁর বিচার চালায়, তাঁকে উকিল পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। এক অর্থে বিনা বিচারে ১৯২৩ সালে রাষ্ট্রদ্রোহী পত্রিকা ভারতে পাঠানোর অভিযোগে তাঁর ১২ বছর সশ্রম কারাদণ্ড হয়। আপিল করে কারাদণ্ডের মেয়াদ ৬ বছর কমানো হয়। এই সময় বেরিলি সেন্ট্রাল জেলে বসে তিনি তাঁর মহাগ্রন্থ ‘ফিলজফিক্যাল কনসিকোয়েন্সেস অব মডার্ন সায়েন্স’ লিখে ফেলেন। এই বছরই এলেন তাঁর নাজি বিরোধী লেখার কারণে গ্রেপ্তারি এড়াতে প্যারিসে পালিয়ে যান।

১৯৩৭ সালে জেল থেকে বেরিয়ে রায় ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসে যোগদান করেন এবং ‘দ্য লীগ অব র‌্যাডিক্যাল কংগ্রেসম্যান’ গঠন করেন। এলেন ভারতে ফিরে এলে মানবেন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। এই সময় নানা রোগে তিনি জর্জরিত, জহরলাল নেহরুর আমন্ত্রণে তাঁর এলাহাবাদের বাড়িতে গিয়ে থাকেন কিছুদিন। ১৯৩৮ সালে তিনি সুভাষচন্দ্র বসুকে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের সভাপতি হতে সমর্থন জানান। যদিও তাঁদের মতপার্থক্য ছিল। মানবেন্দ্রনাথ রায় চাইতেন ভারতের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা। অর্থনৈতিক দিক থেকে ভারত যদি স্বাধীন হয়, তবেই ভারত প্রকৃত স্বাধীনতা পাবে, এই ছিল তাঁর উপলব্ধি। কিন্তু সুভাষচন্দ্র চাইতেন কোনও ভাবে ভারত আগে স্বাধীন হোক।

১৯৩৯ সালে সুভাষচন্দ্র যখন সভাপতি পদে হেরে গেলেন তার পরের বছর মানবেন্দ্রনাথ ১৯৪০ সালে কংগ্রেসের সভাপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হন। ১৯৪০ সালে তিনি কংগ্রেস ত্যাগ করে গঠন করেন র‌্যাডিক্যাল ডেমোক্রাটিক পার্টি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তিনি প্রবলভাবে মিত্র শক্তিকে সমর্থন করেন, কারণ তিনি বুঝতে পারেন ক্ষয়িষ্ণু সাম্রাজ্যবাদ ফ্যাসিবাদের চেয়ে কম ক্ষতিকর। এই সময় থেকে তিনি দেরাদুনে থাকতে শুরু করেন। ১৯৪৫ পর্যন্ত মানবেন্দ্রনাথ শুধু লেখালিখিতেই ব্যস্ত থাকেন এবং প্রায় ১০/১১ টি বই লেখেন। এরপরের ৯ বছর মানবেন্দ্রনাথ দেরাদুনেই বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে আলোচনা করতেন। ১৯৫৪ সালের ২৫ জানুয়ারি হৃদরোগে তাঁর মৃত্যু হয়, অথচ সেই বছরই এপ্রিল মাসে আমেরিকায় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর বক্তৃতা দেবার কথা ছিল।

More Articles