তরু দত্ত: বিস্মৃতির অতল থেকে তুলে আনা মুক্তো

জীবন সেঁচে তুলে আনা আশ্বাসের স্বরে, তরু দত্ত তাঁর উত্তরসূরীদের ‘The Young Captive’ কবিতায় জানাতে চেয়েছিলেন, “This answer at least may be given,- / That grace marked her figure, her action, her speech,/ And such as lived near her, blameless might teach/That life is the best gift of heaven.” মাত্র একুশ বছর বয়সে যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে জীবনের সঙ্গে একহাত লড়ে নেওয়ার এই জোর তরুলতা দত্ত পেয়েছিলেন, জীবনের প্রতি তাঁর এই একান্ত দ্বিধাহীন বিশ্বাসের জোরেই। ঊনবিংশ শতাব্দীর নবচেতনার জাগরকাল যখন একে একে বাংলা সাহিত্যের বহুমাত্রিক প্রতিভাদের তুলে আনছিল, সেই সময়ে দাঁড়িয়ে তরু দত্ত এবং তাঁর বোন অরু দত্ত ছিলেন সেই দুই নারী, যারা তৎকালীন সময়ে দাঁড়িয়ে নারীশিক্ষা ও নারী-স্বাধীনতার এক ভিন্নতর আখ্যান বুনে তুলেছিলেন সেই সমাজের গায়ে।  


বর্ধমানের অজপুরের পৈত্রিক ভিটেমাটি ছেড়ে এসে গোবিন চন্দ্র দত্তের পূর্বপুরুষ নীলমণি দত্ত কলকাতায় বসবাস শুরু করেছিলেন বহুকাল আগে থেকেই। কিন্তু ইংরেজ আমলে উচ্চপদস্থ সরকারী চাকরীর সুবাদে ভাষাবিদ গোবিন চন্দ্র দত্ত প্রকৃত অর্থেই বিচিত্র সংস্কৃতির মানুষের সঙ্গে মেশার সুযোগ পেয়েছিলেন। তৎকালীন সময়ের খ্রীষ্টান মিশনারীদের কর্মযজ্ঞের সঙ্গে তিনি ভালোভাবেই পরিচিত ছিলেন। ১৮৬২ সালে, ভাই কিষেনের মৃত্যুর পর তাই খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণ করতে গোবিন চন্দ্রের বিন্দুমাত্র বাধেনি। অন্যদিকে স্ত্রী ক্ষেত্রমণি মিত্র ছিলেন ইংরাজী শিক্ষায় শিক্ষিতা। ঐতিহ্যের প্রতি যত্নশীলা, ক্ষেত্রমণি একদিকে যেমন হিন্দু দেবদেবীদের নিয়ে রচিত নানাবিধ পুরাণের বিভিন্ন প্রসঙ্গ নিখুঁতভাবে জানতেন, তেমনই ‘The Blood of Christ’ নামে একটি ইংরাজী বইয়ের বাংলা অনুবাদও তিনি করেছিলেন। তাই ছোটোবেলা থেকেই তরু ও বোন অরু হিন্দু পুরাণের নানা বর্ণময় কাহিনীর পাশাপাশি যত্ন নিয়ে ইংরাজী ভাষাও শিখেছিলেন। সেইসঙ্গে যোগ হয়েছিল পিতা গোবিন চন্দ্রের চাকরিসূত্রে ভারতব্যপী ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ। খুব কম বয়সেই যক্ষ্মা রোগে কনিষ্ঠ সন্তান আবজুকে হারিয়ে ফেলার পর থেকে গোবিন চন্দ্র কিছুতেই দুই মেয়েকে নিজের কাছছাড়া করতেন না। তাই কর্মসূত্রে ১৮৬৯ সালে ফ্রান্সদেশে যাওয়ার সুযোগ মিললে, গোবিন চন্দ্র স্ত্রী ও মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়াই মনস্থির করেন। কারণ ততদিনে এদেশীয় নারীশিক্ষা ব্যবস্থার অন্তঃসারশূন্যতা সম্বন্ধে তাঁর ভালোই অভিজ্ঞতা হয়েছিল। 


ফ্রান্সে টানা একবছর কাটানোর সুবাদে গোবিন চন্দ্র সেখানকার ফরাসী শিক্ষা ব্যবস্থায় দুই মেয়েকে বিশেষভাবে শিক্ষিত করেন। তরুলতা ও অরু ফরাসী ও ইংরাজী ভাষায় অত্যন্ত পারদর্শী হয়ে ওঠেন। এছাড়াও ইতিহাস, শিল্প ও সূক্ষ্ম কলাবিদ্যাতেও তাঁরা নিজেদের কুশলতা দেখিয়েছিলেন। দুই বোন চমৎকার পিয়ানো বাজাতেও শিখেছিলেন। ফরাসী ভাষায় অপূর্ব দক্ষতা অর্জনের পর তরু মূল ভাষায় শার্লট ব্রন্টি, ভিক্টর হ্যুগো সমূহের লেখা নিবিড় মনোযোগের সঙ্গে পড়তেন বলে জানা যায়। ক্রমে, নিজস্ব এক সাহিত্যের বোধ নিজের মধ্যে গড়ে উঠতে দেখে কবিতা লেখার দিকে তাঁর ঝোঁক বাড়ে। প্রবাস জীবনে উনিশ শতকের এক বাঙালি মেয়ের সাপেক্ষে, ফরাসী ও ইংরাজী ভাষা শিখে সে ভাষায়, নিজের মনের ভাব প্রকাশক এই লেখাগুলির গুরুত্বের কথা ভাবলে বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়েও শিহরণ জাগে! শুধু তাই নয়, তৎকালীন ফরাসী অন্যান্য কবিদের লেখাগুলিকেও তরুলতা সেসময় অনুবাদ করতে থাকেন। কিন্তু পারিবারিক টানপোড়েনে তাঁদের চলে আসতে হয় ইংল্যান্ডে। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘Higher Lectures for Women’ বা ‘Lectures for Ladies’  ইত্যাদি নানা বক্তৃতামালায় অংশগ্রহণ করতে করতে তাঁর ভাষা ও সাহিত্যের বোধ আরও তীক্ষ্ণতর হয়ে ওঠে। ব্রিটেনে তাঁরা তিন বছর ছিলেন। এইসময় তাঁর সঙ্গে মেরি ই মার্টিনের বন্ধুত্ব হয়, যার প্রভাব তাঁর পরবর্তী জীবনের লেখা ও চিঠিপত্রে উল্লেখযোগ্যভাবে ছিল। অনেক পরে হরিহর দাসের সম্পাদনায় তরুর, মেরিকে লেখা চিঠিগুলি ‘Life and Letters of Toru Dutt’ নামে প্রকাশ পায়।  


১৮৭৩ সালে কলকাতায় ফিরে আসার পর বাঘমারী অঞ্চলের মানিকতলা স্ট্রিটে তরুরা স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। ততদিনে স্বাধীন, চিন্তাশীল মননে অভ্যস্ত তরুলতা দেখেন, এদেশের মেয়েদের জন্য পড়ে আছে শুধুমাত্র অশিক্ষার অন্ধকার আর বিয়ে করে পার হয়ে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা। মেরি মার্টিনের কাছে দুঃখপ্রকাশ করে তরু চিঠিতে লেখেন, “if any friend of my grandmother happens to see me, the first question is, if I am married.”। এদেশের নারীদের জন্য সমাজের জমিয়ে রাখা অন্ধকারের উত্তর দিতে গিয়ে তরু দেখেন, সময়ের চেয়েও দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে তাঁর অনাগত যৌবনকাল, ‘My Vocation’  কবিতায় খানিক যেন ক্ষুণ্ণস্বরেই তরু লেখেন- “ Love cheered for a while/ My morn with his ray, / But like a ripple or smile/ My youth passed away.” তাই আরও বেশি করে পড়াশোনার জগতে নিজেকে ডুবিয়ে দেওয়াই তাঁর কাছে জীবনধারণের একমাত্র উপায় বলে মনে হয়। মাত্র আঠারো বছর বয়সে ‘Bengal Magazine’-এ ফরাসী কবি Leconte de Lisle এবং Josephin Soulary- এর সম্বন্ধে প্রবন্ধ লিখে পরিচিতির জগতে তিনি উঠে আসেন। কিছুদিনের মধ্যেই লিখতে শুরু করেন ‘The Diary of Mlle. D’Arvers’, যার অলংকরণের দায়িত্ব নিয়েছিলেন অরু। কিন্তু সেই অলংকারণের কাজ অসমাপ্ত রেখেই ১৮৭৪ সালে যক্ষ্মারোগে ভুগে অরু নিরুদ্দেশে পাড়ি দেন। কাজ, আরও কাজের অতলে নিজেকে ডুবিয়ে দিয়ে সামান্য শান্তির খোঁজ চালিয়ে যান তরু। মৃত বোনের স্মৃতির উদ্দেশ্যে একটি কবিতার অর্ঘ্য যেন সাজিয়ে দেন ‘Our Casuarina Tree’ কবিতায়- “ But not because of its magnificence/ Dear is the Casuarina to my soul: / Beneath it we have played: though years may roll, / O sweet companions, loved with love intense, / For your sakes, shall the tree be ever dear.” চলে যাওয়া মানুষের ফেলে আসা সময়কে ঘিরে সেই কাসুরিনা গাছের পাতারা এখনও রোদের পিঠে হেলান দিয়ে কেমন খেলা করে, দেখার জন্য আছেন শুধু তরুলতা! 
বোনের মৃত্যুশোক কাটিয়ে উঠে তাঁর সাহিত্যকর্মের একেকটি পাঠকে তরু দত্ত ক্রমশ সামনে আনেন এরপর।

১৮৭৬ সালে ভবানীপুরের সাপ্তাহিক সংবাদ প্রেস থেকে ‘A Sheaf Gleaned in French Fields’ প্রকাশ পায়। অত্যন্ত নিম্নমানের কাগজে ছাপা, পিতাকে উৎসর্গীকৃত এই বইটির কোনো মুখবন্ধ অবধি ছিল না! ফরাসী থেকে ইংরাজীতে অনূদিত ১৬৫টি কবিতা্র এই সংকলনটি যে এক ভারতীয় নারীর লেখা, তার স্বীকৃতি জোগাড়েই অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয় বইটিকে। ১৮৭৭ সালে ভাগ্যচক্রে অধ্যাপক W. Minto-এর হাত ঘুরে বইটি Edmund Gosse-এর হাতে পৌঁছায়। বইটির প্রকৃত সম্ভাবনা ও গুরুত্ব অনুধাবন করে মিন্টো ও গোসে ‘The Examiner’ পত্রিকায় বইটির ভূয়সী প্রশংসা করেন। নবজাগৃত বাংলার পাঠককূলের কাছে এই বইয়ের খবর পৌঁছালে, পরবর্তীকালে এর দ্বিতীয় ও তৃতীয় সংস্করণ বেরিয়েছিল বলে জানা যায়। জানা যায়, দ্বিতীয় সংস্করণে আরও ৪৪টি কবিতা ও তরু দত্তের একটি ছবিও বেরিয়েছিল বইটিতে। 


তরু দত্তের ফরাসী ভাষায় লেখা অসমাপ্ত উপন্যাস ‘Bianca, or the Young Spanish Maiden’এর নাম বিশেষ আলোচিত হলেও তাঁর সর্বাধিক প্রশংসিত বইটি হল, ‘Ancient Ballads and Legends of Hindustan’, যার ভূমিকায় এডমণ্ড গোসে লিখেছিলেন, “She brought with her from Europe a store of knowledge that would have sufficed to make an English or French girl seem learned, but which in her case was simply miraculous.” বিদেশী ভাষা শিখে ও আত্মস্থ করে সেই ভাষায় নিজস্ব ঐতিহ্যের নানা বিষয়ে আলোকপাত করা ও পর্যালোচনা করার মতো ঋজু মানসিকতা উনিশ শতকের এক বাঙালি নারীর মধ্যে কীভাবে অবলীলায় বেড়ে উঠেছিল, দেখে চমক লাগে। নিজস্ব বিশ্বাস ও চিরন্তন ঐতিহ্যের প্রতি সৎ থেকেও আধুনিকতার সঙ্গে আন্তর্জাতিকতার মেলবন্ধন ঘটানোর কাজটি যে কত সহজেই হতে পারে, তা তরু দত্তের লেখাগুলি থেকে শিক্ষনীয়। এছাড়াও তাঁর দ্য বেঙ্গল ম্যাগাজিনের ‘Poet’s Corner’এর প্রবন্ধগুলি বা ‘The Calcutta Review’- এর ফরাসী থেকে ইংরাজীতে অনূদিত কবিতাগুলিও বর্তমান সাহিত্য জগতে বারবার উল্লেখের দাবী রাখে। 


তাঁর ‘The Broken Bell’ কবিতায় তরু লিখেছিলেন, ‘Blessed the bell that through the darkness blind / sends honest greetings, consolations kind. / And solemn warnings from its lusty throat / Tis like a wakeful soldier, - mine, alas!/ The soul-bell in me, can but give one cry…” যুদ্ধক্ষেত্রে আহত মৃত্যুপথযাত্রী সৈনিকের পাশ দিয়ে হাওয়া চিরে যেভাবে ছুটে যায় প্রাণবন্ত ক্লান্ত যোদ্ধার দল, তেমনই যেন তরুর লেখা, অনুবাদ ও কথাগুলিকে পাশ কাটিয়ে, না দেখার ভান করে অনন্তর ছুটে চলেছে আমাদের এই বাংলা ভাষা। তবু কোনো এক মরমী, সহৃদয় পাঠক যদি এক  মুহূর্ত থমকে গিয়ে খুঁজে নেন তরু দত্তের কোনো লেখা, তবে আশ্বাস দিতে পারি, তিনি হতাশ হবেন না! বরং অনপেক্ষ প্রাপ্তির আনন্দে বুঁদ হলেও হতে পারেন।  

তথ্যসূত্রঃ

More Articles