মাত্র একুশটা বছর, ফরাসি ও ইংরাজি সাহিত্যে অসাধারণ দৃষ্টান্ত ও ক্ষণজন্মা প্রতিভা তরু দত্ত
সাক্ষর সেনগুপ্ত: তাঁর ডায়রির আকারে লেখা উপন্যাস ‘মাদমোয়াজেল দ্যারভারের দিনপঞ্জী’ (La Journal de Mademoiselle d’Arvers).কোনও ভারতীয় লেখকের ফরাসি ভাষায় লেখা প্রথম সাহিত্যকর্ম। ঠিক তেমনই তাঁর মৃত্যুর পর প্রকাশিত ‘Bianca or The ‘Young Spanish Maiden’ ও প্রথম ভারতীয় মহিলা লেখিকার প্রথম ইংরেজি ভাষায় লেখা উপন্যাস। জীবন সায়াহ্ন নেমে এসেছিল মাত্র ২১ বছর বয়েসে। কিন্তু এই স্বল্প সময়ের মধ্যে সাহিত্যজগতে বাস্তবিকই বিরলতম দৃষ্টান্ত তৈরি করেছিলেন কবি ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সাহিত্যিক তরু দত্ত।
১৮৫৬ সালের ৪ মার্চ রামবাগানের দত্ত পরিবারে তরু দত্তের জন্ম। বাবা গোভিন চন্দ্র দত্ত। মা ক্ষেত্রমোহিনী দেবী। গোভিন চন্দ্রের তিন সন্তান, অরু, তরু ও পুত্র অব্জু। সবাই ছিলেন স্বল্পায়ু। অব্জু বেঁচে ছিল মাত্র চোদ্দ বছর বয়স পর্যন্ত। অরু দত্ত প্রয়াত হন কুড়ি বছর বয়সে। আর তরু ৩০ আগস্ট ১৮৭৭, একুশ বছর বয়সে। শিক্ষিত, ধনী ও সংস্কৃতিমনস্ক হিসাবে পরিচিত ছিল রামবাগানের দত্ত পরিবার। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ও ভাষাবিদ রমেশচন্দ্র দত্ত ছিলেন এই পরিবারের সদস্য। তাঁরই নামানুসারে তরু দত্তের বাসভবনের সামনের মানিকতলা স্ট্রিট আজ রমেশ দত্ত স্ট্রিট। তরুর পরিবার ডেভিড হেয়ার, আলেকজান্ডার ডাফ, উইলিয়াম কেরির মত বিশিষ্টজনেদের সংস্পর্শে এসে খ্রীষ্টধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হন। এবং ১৮৬২ সালে সপরিবারে খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণ করেন। বর্তমান স্কটিশ চার্চ কলেজের উল্টোদিকে যে গির্জা, সেখানেই তাঁদের ধর্মান্তরকরণ হয়েছিল বলে জানা যায়।
একমাত্র পুত্র অব্জুর মৃত্যুর পর তরুর বাবা ইউরোপে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। আর সেই সিদ্ধান্ত অনুসারে ১৮৬৯ সালে তিনি ফ্রান্সে আসেন। তরু এবং অরুকে ভর্তি করা হয় দক্ষিণ ফ্রান্সের এক আবাসিক স্কুলে। সেখানে দুই বোন ফরাসি ভাষায় বিশেষ পারদর্শিতা লাভ করেন। শুরু হয় দুজনের কবিতা লেখা। ১৮৭১ সালে তাঁরা চলে আসেন কেমব্রিজে। সেখানে শুরু ইংরেজি ভাষার চর্চা। দুই বোন এখানে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘হায়ার লেকচারস ফর উইমেন’-এ উচ্চশিক্ষার জন্য ভর্তি হন। ১৮৭৩ সালে তাঁরা দেশে ফিরে আসেন ভগ্ন স্বাস্থ্যের কারণে। ১৮৭৪ সালে অরু মারা যান। তরু দত্ত বোনের মৃত্যুতে চরম আঘাত পান, কারণ সবসময় দুই বোন একসাথে সাহিত্যচর্চা করেছেন, ভাবনার আদানপ্রদান হয়েছে। দুজনে যৌথভাবে অনুবাদ করেছিলেন বেশ কিছু ফরাসি কবিতা। আবার অনেক ক্ষেত্রে কবিতা লিখেছেন তরু আর অরু অলংকরণ করেছেন।
জীবনের অধিকাংশ সময় ইউরোপে কাটালেও তরুর মনের মধ্যে গভীর মমত্ববোধ ছিল দেশের প্রকৃতি, গাছপালা, পুরান, মহাকাব্যের বিষয়ে। নদী মাঠ ক্ষেত ছিল তাঁর প্রকৃতিপ্রেম সম্পর্কিত কবিতার বিষয়। তিনি যেমন লিখেছেন ফরাসি কৃষিজমির কথা, তেমনই দেশের পুকুর, বড় বড় ছায়াভরা গাছের কথাও প্রতিভাত হয়েছে তাঁর সাহিত্যকর্মে। তাঁর কবিতায় বারবার ফিরে এসেছে তাল, তমাল তরু, শিমুল ফুল, বাঁশ বাগান। চাঁদের জ্যোৎস্না যেনএক আশ্চর্য্য অনাবিল ছন্দে খেলা করেছে তাঁর কবিতায়। তাঁর কবিতার অন্তরে যেন ঝাউবন অনুরণন তুলতো অনুক্ষণ। তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত কবিতাটি ‘Our Casuarina Tree’। পদ্মফুলের সৌন্দর্য্যও কি এক অপার আনন্দে ধরা দিয়েছে তাঁর কবিতায়, সে কবিতার নাম ‘Lotus’।
তরু দত্তের লেখায় দৈনন্দিন জীবনের সমস্যা যেমন উঠে এসেছে পাশাপাশি পুরান, রামায়ণ, মহাভারতের মত আকর গ্রন্থ আর মহাকাব্যের প্রসঙ্গও ছুঁয়ে গেছে নানা ভাবে। ফিরে এসেছে সাবিত্রী, একলব্য, সীতা-র মত চরিত্রের কথা। মৃত্যুর এক বছর আগে ১৮৭৬ সালে ফরাসি থেকে ইংরাজিতে অনুবাদ করা তাঁর ১৫০টি কবিতার সংকলন ‘A Sheaf Gleaned in French Field’ (ফরাসি ক্ষেতে কুড়ানো এক আঁটি ফসল) প্রকাশিত হয়। তাঁর বাবা মৃত্যুপথযাত্রী মেয়ের প্রতি ব্যাকুল আবেগে কবিতা সংকলনটি নিজের খরচে প্রকাশ করেন ভবানীপুরের সাপ্তাহিক সংবাদ প্রেস থেকে। এর মধ্যে চারটি কবিতা দিদি অরু দত্তের অনুবাদ। ১৮৭৭ এ সমালোচক এডমন্ড গুজ এটি পড়েন এবং ভূয়সী প্রশংসা করেন তাঁর সমালোচনামূলক প্রবন্ধে। তরুর মৃত্যুর পর বইটির আরো সংস্করণ প্রকাশিত হয়। কিগান পল নামক জনৈক কাব্যবোদ্ধা লন্ডন থেকে এর তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশ করেন। সংস্কৃত সাহিত্য থেকে নেওয়া ‘Ancient Ballads and Legends of Hindustan’ তাঁর মৃত্যুর পর ছাপা হয়। ১৮৭৭ এ তরুর পিতৃদেব এর ম্যানুস্ক্রিপ্ট খুঁজে বার করেন।
তাঁর মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয় কবির ফরাসি ভাষায় লেখা উপন্যাস ‘মাদমোয়াজেল দ্যারভারের দিনপঞ্জী’ (La Journal de Mademoiselle d’Arvers). এ পরে ওই উপন্যাসটি অনুবাদ করে বসুমতী পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা হয়। এই উপন্যাস এতটাই প্রাসঙ্গিক যে বহু বছর পর ১৯৫৬ সালে এটি বই আকারে বের হয়, যার ভূমিকা লেখেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক প্রেমেন্দ্র মিত্র। একইভাবে তাঁর মৃত্যুর পর প্রকাশিত ‘‘Bianca or The ‘Young Spanish Maiden’ নামে ইংরেজিতে লেখা উপন্যাসটিরও বেশ কয়েকটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল।
তরুর মৃত্যুর পর কলকাতার বাস উঠিয়ে যে বাড়ি ছেড়ে পাকাপাকিভাবে বিদেশে চলে যান গোভিন চন্দ্র দত্ত। স্বল্পায়ু এই আসাধারণ কৃতি সাহিত্যিকের চিঠির সংকলনও প্রকাশ করা হয়েছিল পরে। তাতে আছে তাঁর বিদেশি বন্ধুদের লেখা চিঠি এবং বিদেশ থেকে দেশে আত্মীয়দের লেখা পত্রগুচ্ছ। তৎকালীন দিনযাপনের জলছবি যেন উঠে আসে সেই সব চিঠিপত্রে। তরুর প্রকৃতিপ্রেম, মানবচেতনা, তাঁর ভাবনার স্পর্শ পাওয়া যায় সেই সব লেখায়। বোঝা যায় ওই অল্প বয়সেই কতটা ভাষার দক্ষতা অর্জন করেছিলেন তিনি। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের যেন মেলবন্ধন ঘটেছিল তরুর লেখনীতে। মনেপ্রাণে ভারতীয় হয়েও এক হাতে ফরাসি অন্য হাতে ইংরেজি সাহিত্যকে ছুঁয়েছিলেন। প্রাচীন ভারতের ঐতিহ্য, ফরাসি কোমলতা ও ইংরেজি আভিজাত্য – এই তিনটে বৈশিষ্টের সাহচর্য্যে সাহিত্যের আঙিনায় তাঁর অসাধারণ প্রতিভার নিদর্শন রেখে গিয়েছেন ক্ষণজন্মা প্রতিভার এক আশ্চর্য্য উদাহরণ কবি তরু দত্ত।
তথ্যসূত্র - তরু দত্তঃ এক বিস্মৃত কবি - এই সময়, 12.12.2018