এমন আত্মমগ্ন ভগবান নয়, চাই জননেতা
Lok Sabha Election 2024: মাঝে অটলবিহারী বাজপেয়ীর পাঁচ বছরের সরকার বাদ দিলে, সব প্রধানমন্ত্রীই সমাজবাদী ভাবধারারই পথিক।
তিনি ভগবান। ৬০ মাসের মধ্যে ৫৭ মাস তিনি ভগবানই থাকেন। তখন তিনি উচ্চাসনে। মর্ত্য়লোকে ঘটে যাওয়া কিছুই তখন তাঁকে স্পর্শ করে না। তখন তিনি শুধু আত্মমগ্ন। তাঁর অমোঘ বাণীই শেষ কথা। তিনি ইচ্ছে করলে কথা বলেন। ইচ্ছে না করলে বলেন না। জগতের তুচ্ছাতিতুচ্ছ ব্যাপারে তিনি তখন উদাসীন। তিনি তখন সব জাগতিক সমস্যার উর্ধ্বে। কে কাকে মারল বা ধরল বা একেবারে মেরে ফেলল, কে কী কটু কথা বলে ফেলল, এমনকী কে তাঁকে গালি দিল — এসব বিষয়ে তিনি প্রকাশ্যে কোনও কিছু ব্যক্ত করেন না। কখনও ভক্তদের সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছে হলে, তিনি বসেন গুরুর আসনে। সাজানো মঞ্চে তিনিই বক্তা, তিনিই সূত্রধর, তিনিই সব। তিনি বুঝিয়ে দেন, ভগবানের হাতেই রয়েছে সমস্যার সমাধান। মাটির কাছাকাছি কী হচ্ছে তা নিয়ে তিনি অত বেশি মাথা ঘামান না। কারণ, তাঁর লক্ষ্য এবং আসন অনেক উপরে। তাঁর চোখে তখন বিশ্বজনীন ভগবান হওয়ার স্বপ্ন। ভগবান তখন বিশ্বজয়ের জন্য নিজেকে নিবিষ্ট রাখেন। তখন তাঁর ধারে কাছে কাউকে দেখা যায় না। তিনি একা এবং একাকী। তখন তিনি ক্যামেরার সামনে একা হাঁটেন। একা বসেন। একাই কসরৎ করেন। একাই রঙ্গ-রসিকতা করেন। তিনি ভক্তদের হৃদয়ে থাকেন। কিন্তু ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
কিন্তু পাঁচ বছরে মাত্র তিন মাসের জন্য তিনি মর্ত্যে নেমে আসেন। তখন তিনি সাধারণ। অতি সাধারণ। তখন তাঁকে ভক্তবৃন্দের মাঝে দেখা যায়। ক্যামেরার ফ্রেমে তিনি তখন আর একাকী নন। তখন তিনি মন্দ কথা বলতে দ্বিধা বোধ করেন না। তখন আর বিশ্বগুরু নন। তখন তিনি দেশের কথা বলেন। তাঁর শত্রু পক্ষের কথা বলেন। মিথ্যে কথা বলতেও তাঁর মুখে আটকায় না। তখন তিনি সাংবাদিকদের বাড়িতে ডেকে ডেকে সাজানো প্রশ্নের উত্তর দেন। তাঁদের সঙ্গেই রঙ্গ-রসিকতা করেন। ভগবান তখন রাস্তায় নামেন। নেতা-কর্মী পরিবেষ্টিত হয়ে ভগবান তখন দর্শন দেন ভক্তদের কাছে গিয়ে।
আবার তিন মাস পরে তিনি উচ্চাসনে আসীন। সব 'পাপ' ধুয়ে ফেলতে তিনি ধ্যান করেন। আবার তিনি একাকী হয়ে যান। জগতের সব সমস্যার উপরে উঠে যান।
আরও পড়ুন- শংসাপত্র দিয়ে কেবল মুসলিমদেরই ওবিসি করা হয়েছে? শেষ দফার আগে যে তাস খেলছেন মোদি
এটিই চক্রাকারে চলছে গত এক দশক ধরে। তিনি ভগবান। আর তাঁর ভজনা করেন একদল ভক্তবৃন্দ। সেই ভক্তকুলের আয়তন কম নয়। তাঁদের ভরসাতেই তিনি ভগবান সাজেন। তিনি ভারতের পঞ্চদশতম ব্যক্তি যিনি প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন হয়েছেন। তিনি নরেন্দ্র মোদি। তিনিই 'ভক্ত'দের 'ভগবান'! যিনি প্রকাশ্যে মনের কথা বলেও ফেলেন যে, তিনি বাবা-মায়ের ঔরসজাত সন্তান নন। তিনি ভগবানের অবতার হিসেবে পৃথিবীতে প্রেরিত হয়েছেন।
এমন ভগবান কি আমরা সত্যিই চাই যিনি পাঁচ বছরে তিন মাসের জন্য মর্ত্যে নেমে আসবেন আর বাকি সময়টি একাকী কাটাবেন শুধু নিজের 'মনের কথা' বলে!
সত্যি কথা কী, নরেন্দ্র মোদিকে খুব একাকী মনে হয়। সংসার তিনি স্বেচ্ছায় করেননি কিন্তু তিনি বান্ধবহীন কী করে হতে পারেন! তাঁর আশেপাশে কেউ কোথাও নেই। তিনি একা এবং অদ্বিতীয় হিসেবেই নিজেকে তুলে ধরতে ভালোবাসেন। তিনি কোথাও গেলে, কিছু করলে শুধু নিজেকেই হাজির করেন ক্যামেরার সামনে। তা সে কোনও ব্রিজের উদ্বোধন হোক (এত্ত বড় একটি ব্রিজে তিনি একা হাঁটেন), সমুদ্র সৈকতে ফেলে যাওয়া বোতল ও নোংরা কুড়িয়ে ঝোলাতে তোলা হোক (তিনি জনমানবহীন সমুদ্র সৈকতে একা হাঁটেন), রামলালার প্রাণপ্রতিষ্ঠা হোক (সকলকে ফ্রেমের বাইরে রেখে তিনি একা একা মন্দিরে ঢোকেন) বা বক্তৃতার মঞ্চ হোক, বা ময়ূরের সঙ্গে খেলা করাই হোক।
আমাদের মধ্যে ব্যক্তিপুজোর প্রবণতা বেশি বলে এমন মানুষকেই আমরা জনপ্রিয় নেতা বলে মনে করি। এমন একাকী প্রধানমন্ত্রীর জনপ্রিয়তা থাকলেও তাঁকে জননেতা বলে মনে হয় না। জনগণের নেতা হওয়ার জন্য বোধহয় মাটির আরও কাছাকাছি থাকা দরকার। যাঁকে মানুষ ছুঁতে পারবে। মনের কথাটি সহজে বলতে পারবে। সুখ-দুঃখে সাজানো মঞ্চে নয়, সহজে নিজেদের মধ্যে তাঁকে পাবে।
আসলে আমাদের অনেকের একটি অসুবিধা রয়েছে। প্রায় ২৫ বছর ধরে আমরা সংসদে কোনও একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতাকে প্রধানমন্ত্রী হতে দেখিনি। ১৯৮৯ সালে সেই শেষ রাজীব গান্ধি। তার পর নরেন্দ্র মোদির প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আবির্ভাবের আগে পর্যন্ত সব প্রধানমন্ত্রীই সংখ্যালঘু বা শরিকদের নিয়ে সরকার চালিয়েছেন। ফলে তাঁদের মধ্যে একনায়কতন্ত্রের ভাব ফুটে উঠতে দেখিনি আমরা। শেষ একনায়কতন্ত্রও দেখিয়েছেন একমাত্র ইন্দিরা গান্ধি। তাও কত বছর হয়ে গেল তিনি প্রয়াত।
আমাদের আরেকটি অসুবিধা হলো যে আমরা এমন কট্টরপন্থী হিন্দুত্ববাদী সরকারও দেখিনি। মাঝে অটলবিহারী বাজপেয়ীর পাঁচ বছরের সরকার বাদ দিলে, সব প্রধানমন্ত্রীই সমাজবাদী ভাবধারারই পথিক। পুঁজিবাদের সমর্থক হলেও পিভি নরসিমহা রাও বা মনমোহন সিংয়ের খুঁটি কিন্তু মধ্যপন্থী কংগ্রেস দলেই বাঁধা ছিল।
আমাদের আরও একটি অসুবিধা হলো, আমাদের বড় হওয়া বহুত্ববাদী ভারতে। 'বিবিধের মাঝে মিলন'-ই আমাদের শেখা মন্ত্র। বহু ভাষার, বহু সংস্কৃতির, বহু জাতির দেশে এক হয়ে ভারতীয় হয়ে ওঠার শিক্ষা নিয়েই আমাদের জীবনচর্যা। সমাজের কল্যাণে সবাইকে সমান দৃষ্টিতে দেখাতে ও দেখতেই আমরা অভ্যস্ত হয়েছি। আর্থিক বা সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষদের হাত ধরে সামনে টেনে নিয়ে আসাকেই আমরা জীবনের লক্ষ্য বলে মনে করেছি।
বিচ্যুতি ছিল। তাকে ব্যতিক্রম বলেই মনে করেছি। কিন্তু সেই অভ্যাসের বা স্বপ্নের ভারতবর্ষকে যখন ধর্মের জোরে বিভক্ত হতে দেখি বা বহুত্ববাদকে যখন একত্ববাদের পথে যেতে দেখি বা পোশাক-খাদ্যের অভ্যাস দেখে বন্ধু-শত্রু চিহ্নিত করতে দেখি, তখন মন বিষাদময় হয়ে যায়। আর যিনি এই পথে দেশকে নিয়ে যেতে চান, তাঁকে আর যাই হোক ভগবান মনে করতে দ্বিধা হয়।
আরও পড়ুন- কাঁটা উপড়ে ফেলতে দক্ষ মোদি! ক্ষমতায় আসতে কাকে কাকে পথ থেকে সরিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি?
দেশের প্রধানমন্ত্রী অবশ্যই কঠোর এবং দক্ষ প্রশাসক হবেন। তিনি অবশ্যই জনগণের চোখে 'হিরো' হয়ে উঠবেন। তিনি নিশ্চিতভাবে দেশের ভালো চাইবেন ও দেশকে সুরক্ষিত রাখবেন। তিনি অবশ্যই বিরোধীদের সঙ্গে রাজনীতির লড়াইয়ে থাকবেন। কিন্তু বিরোধীদের সঙ্গে তাঁর সদ্ভাবও থাকবে। অথচ তিনিই যদি দেশকে নানা স্তরে বিভাজনের দিকে নিয়ে যেতে থাকেন, একটিবারের জন্যও 'মিলে সুর মেরা তুমহারা' গাইতে না পারেন, জনগণের থেকে নিজেকে অনেক উঁচুতে ও দূরে রাখেন, শুধু 'ভক্তকুলের' কৃপায় দেশ পরিচালনা করতে চান, তাহলে একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে মন তো বিচলিত হবেই।
দেশের দরকার একজন জননেতার। যিনি মাটির গন্ধ মেখে, জনতার মধ্যে থেকে সরকার পরিচালনা করবেন। যাঁর কান থাকবে মাটির কাছাকাছি, মনের ও বাড়ির দরজা খোলা থাকবে জনতার জন্য, যিনি বেশি শুনবেন ও সীমিত কথা বলবেন। যিনি সব প্রশ্নের উত্তর দেবেন। তিনি দূরদর্শী হবেন। দেশকে ও দেশের সব মানুষকে (মুষ্টিমেয় কয়েকজনকে নয়) কীভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়, সেই চিন্তায় মগ্ন থাকবেন ও সেই স্বপ্নকে সাকার করতে নিরন্তর কাজ করবেন। দেশ বা সরকার শুধু নয়, নিজের রাজনৈতিক দলকেও নেতৃত্ব দেবেন সমানভাবে। নিজের দলের কর্মীদেরও সবাইকে নিয়ে চলার মন্ত্র পড়াবেন। শুধুই মুখের বুলিতে নয়, কাজেও দেখাবেন সবার সঙ্গে তিনি, সবার উন্নয়নে তিনি। শুধুমাত্র রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেবেন না। স্বচ্ছ হবেন, স্বচ্ছতার সঙ্গে তিনি কাজ করবেন মানুষের জন্য। দেশের প্রত্যেকটি মানুষের জন্য।
গত চার দশকে সেই জননেতা আমরা পেলাম কোথায়? যাঁদেরকে আমরা জননেতা বলে ভাবলাম, তাঁরা হয় ক্ষমতালোভী হয়ে গেলেন, কেউ দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়লেন, কেউ অদূরদর্শিতার পরিচয় দিলেন আবার কেউ নীরব হয়ে গেলেন।
ভারতের কোনও আত্মমগ্ন, একাকী ভগবান-সম প্রধানমন্ত্রী নয়, একজন জননেতার দরকার।