আইএসএফের সঙ্গে ছন্দপতন! আসন-সমঝোতায় কংগ্রেসই শেষ ভরসা বামেদের?
Lok Sabha Election 2024: একরকম ভাবে বোঝা হয়ে গিয়েছে যে বামেদের সঙ্গে তেমন নমনীয়তার প্রশ্নে যাচ্ছে না আইএসএফ। তাদের ঘোষিত প্রার্থীতালিকা অন্তত তেমনই বার্তা দিয়েছে এ রাজ্যের বামেদের।
এক সময় ইন্ডিয়ান সেক্যুলার ফ্রন্ট (আইএসএফ)-এর হাত ধরা বেশ শক্তি জুগিয়েছিল সিপিএমকে। তবে ২০২৪ লোকসভা ভোটের আগে সেই জোটের অস্তিত্ব যেন একটি সংশয়ের মুখে। আসন সমঝোতার প্রশ্নে যেন আইএসএফের সঙ্গে তাল কাটছে এ রাজ্যের বামেদের। ভোটের আর দেরি নেই প্রায়। ফলে সমস্ত দলই প্রায় কোমর বেঁধে তৈরি। প্রায় সমস্ত জায়গাতেই প্রার্থীঘোষণা করে ফেলেছে অধিকাংশ দল। বিরোধীর ওজন বুঝে জল মাপতে শুরু করেছেন প্রার্থীরা। ব্যতিক্রম শুধু ডায়মন্ড হারবার কেন্দ্র।
ডায়মন্ড হারবার তৃণমূলের সেকন্ড ইন কম্যান্ড অভিষেক বন্দ্যোধ্যায়ের গড়। ফলে হীরকবন্দরে তাঁর দাঁড়ানো এক প্রকার ঠিকই ছিল। প্রার্থীতালিকা বেরোলে দেখা গেল, ডায়মন্ডহারবার থেকে ২০২৪ লোকসভা ভোটে দাঁড়িয়েছেন তিনিই। তবে এখনও পর্যন্ত তিনি প্রতিদ্বন্দীহীন। না সিপিআইএম, না বিজেপি- কেউই সেখানে কোনও প্রার্থী ঘোষণা করেনি।
প্রাথমিক ভাবে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিপরীতে আইএসএফের বিধায়ক নওশাদ সিদ্দিকির প্রার্থী হওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। জানা যায়, সেই প্রস্তাব সমর্থনও করে সিপিএম। তবে পরবর্তীতে সেই নিয়ে কোনও উচ্চবাচ্য করতে দেখা যায়নি আইএসএফকেই। কার্যত কোনও স্পষ্ট জবাব মেলেনি তাদের তরফ থেকেই। ফলে বাধ্য হয়েই আইএসএফ-কে বাদ দিয়েই লোকসভা নির্বাচনের পরিকল্পনা করতে শুরু করে সিপিএম। এমনকী শোনা যাচ্ছে, আইএসএফের জন্য ধরে রাখা আসনেও এখন কংগ্রেসের সঙ্গে কথাবার্তা বলেই চূড়ান্ত করতে চাইছে বামেরা।
আরও পড়ুন: অভিজিৎ, দেবাংশু বনাম সায়ন, তমলুকে কতটা কঠিন হতে চলেছে বামেদের লড়াই?
একরকম ভাবে বোঝা হয়ে গিয়েছে যে বামেদের সঙ্গে তেমন নমনীয়তার প্রশ্নে যাচ্ছে না আইএসএফ। তাদের ঘোষিত প্রার্থীতালিকা অন্তত তেমনই বার্তা দিয়েছে এ রাজ্যের বামেদের। সিপিএমের সঙ্গে সমঝোতার প্রক্রিয়া চলাকালীনই রাজ্যের আট আসনে প্রার্থীঘোষণা করেছিল আইএসএফ। শ্রীরামপুর, উলুবেড়িয়া, মালদহ দক্ষিণের মতো আসন থেকে আইএসএফ-কে প্রার্থী তুলে নেওয়ার বার্তা দেওয়া হয়েছিল সিপিএমের তরফে। দফায় দফায় আইএসএফের সঙ্গে আলোচনা চালিয়েছেন সিপিএমের রাজ্য কমিটির সদস্য ও আইনজীবী-সাংসদ বিকাশ ভট্টাচার্য। বামফ্রন্টের শরিক দল এবং কংগ্রেসের জন্য কেন্দ্র ছেড়ে আইএসএফের জন্য তিনটির বেশি আসন দেওয়া কঠিন, এই কথাই তাদের বারবার বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। একই সঙ্গে বলা হয়েছিল, ডায়মন্ড হারবারে নওসাদ প্রার্থী হলে সিপিএম ও কংগ্রেস মিলিত ভাবেই তাঁকে সমর্থন করবে। কিন্তু তা সত্ত্বেও কোনও কিছুতেই তেমব ইতিবাচক কোনও সাড়া মেলেনি বলে সিপিএম সূত্রের খবর। সেই কারণেই লোকসভা ভোটের বাজারে ক্রমশ নওসাদদের জন্য বন্ধ হচ্ছে যেন আলিমুদ্দিনের দরজা।
ডায়মন্ডহারবারে একটা বড় অংশের ভোট রয়েছে সংখ্যালঘুদের। সেখানে নওসাদের দাঁড়ানোটা বাম এবং আইএসএফ- দু'দলের জন্যই লাভজনক হতে পারে। এমন একটা ভাবনা থেকেই ডায়মন্ডহারবারে ভোট পরিকল্পনা করেছিল বামেরা। কিন্তু পরিবর্তীত পরিস্থিতিতে সেই ছক পাল্টাতে বাধ্য হয় সিপিএম। খুব বড় কোনও বদল না হলে রাজ্যকমিটির তরুণ সদস্য তথা এসএফআইয়ের রাজ্যসভাপতি প্রতীক-উর-রহমানকেই ডায়মন্ডহারবারে প্রার্থী করতে চলেছে সিপিএম। এর আগে বিধানসভা ভোটে ডায়মন্ডহারবার থেকে লড়েছিলেন তিনি।
যতদূর জানা গিয়েছে, বাম ও কংগ্রেস মিলিয়ে এখনও পর্যন্ত মোট ৩১টি আসনে প্রার্থীঘোষণা হয়েছে। বাকি আসনগুলির ব্যাপারে কংগ্রেসের সঙ্গে আলোচনায় বসার কথা রয়েছে বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসুর। দুই বিধানসভা কেন্দ্র ভগবানগোলা ও বরাহনগরের উপনির্বাচনে প্রার্থী দেওয়া নিয়েও আগে কংগ্রেসের সঙ্গে ফয়সালা করা হবে। তার পরে বামফ্রন্টের বৈঠক করে বামেরা তাদের বাকি কয়েকটি আসনের প্রার্থী ঘোষণা করতে পারে। তবে এই গোটা ব্যাপারে আইএসএফের এই নির্লিপ্তি কিন্তু বামেদের সঙ্গে তাদের জোটের ভবিষ্যতকে সঙ্কটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সিপিএমের এক পলিটব্যুরো সদস্যের কথায়, "বিজেপি ও তৃণমূলের বিরুদ্ধে এই সমঝোতায় আইএসএফ আর আসতে চাইছে না, এটাই এখন বোঝা যাচ্ছে। কেউ কেউ হয়তো ওদের ভুল বোঝাচ্ছে। ওরা হয়তো ভাবছে, বাংলায় এমআইএম-এর মতো একটা শক্তি হয়ে উঠবে! আমরা বোঝানোর অনেক চেষ্টা করেছি। এ বার কংগ্রেসের সঙ্গে আলোচনা করে আমরা যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার, নিয়ে ফেলব।"
তবে জমি যে তারাও ছাড়তে রাজি নয়, তা কিন্তু আকার ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিয়েছে আইএসএফ। নওসাদ সিদ্দিকির বক্তব্য, "আমরা ৮টি আসনে প্রার্থী দিয়েছি। জোটের স্বার্থে ৮টিতেই সীমাবদ্ধ থাকতে চাইছি। দু’টি বড় দল যদি আমাদের ‘সাইড লাইন’ করার চেষ্টা করে, আমাদের ৩-৪টে তেই সীমাবদ্ধ রাখে, তখন আমরা আটের জায়গায় দ্বিগুণ বা তারও বেশি জায়গায় প্রার্থী দেব!" মালদহ জেলার কালিয়াচক ও চাঁচলে দলের কর্মিসভা করতে গিয়ে নওসাদ রবিবার ইঙ্গিত দিয়েছেন, দু-এক দিনের মধ্যে সমঝোতা না হলে দক্ষিণ মালদহ আসনেও তাঁরা প্রার্থী দেবেন। কিন্তু তিন-চার আসনের বেশি দাবি করলে সমঝোতা কীভাবে সম্ভব, তার কোনও স্পষ্ট ব্যাখ্যা মেলেনি আইএসএফের তরফে। তবে সমস্যা রয়েছে তাতেও। বামেদের সঙ্গে আসন সমঝোতা ঠিক মতো না হলে নওসাদ ডায়মন্ড হারবারে দাঁড়াতে চাইলেও বামেদের সমর্থন পাবেন না। যা তিনি পেয়েছিলেন ভাঙড় থেকে বিধায়ক হওয়ার সময়ে।
শিয়রে ভোট। আর কিছুদিনের মধ্যেই বেজে যাবে চূড়ান্ত ঘণ্টি। এই সময়েও একগুচ্ছ কেন্দ্রে প্রার্থীঘোষণা করে উঠতে পারেনি সিপিএম। শুধু আইএসএফই নয়, বাম শরিক ফরওয়ার্ড ব্লককে নিয়ে সমস্যাও মেটেনি বামফ্রন্টের অন্দরে। ফ্রন্ট চেয়ারম্যানের অনুরোধে ফরওয়ার্ড ব্লকের রাজ্য সম্পাদক নরেন চট্টোপাধ্যায় পুরুলিয়া গিয়ে দলের জেলা কমিটির বৈঠক করলেও তারা ওই আসনে লড়াইয়ের দাবি থেকে সরেনি। কোচবিহার কেন্দ্রে বামফ্রন্টের তরফে ফরওয়ার্ড ব্লকের প্রার্থী থাকলেও সেখানে কংগ্রেস প্রার্থী দিয়েছে। বিমানবাবুর অনুরোধেও কংগ্রেস প্রার্থী মনোনয়ন প্রত্যাহার করেননি। এই ঘটনা ফরওয়ার্ড ব্লকের জেদ আরও বেড়ে গিয়েছে! ফরওয়ার্ড ব্লকের ভাগের আর এক কেন্দ্র বারাসতে এদিকে আইএসএফ প্রার্থী দিয়ে রেখেছে। শেষ পর্যন্ত আইএসএফের সঙ্গে সমঝোতা না হলে বারাসতের ক্ষেত্রে কী করবে বামেরা, সেটাও একটা বড় ব্যাপার।
এ রাজ্যে এমনিতেই গত কয়েক বছরে কোণঠাসা সিপিএম। কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কোনও মতে অস্তিত্বটুকু টিকিয়ে রাখতে পেরেছে বহুকষ্টে। কিছুদিনের মধ্যেই ঘোষণা হয়ে যাবে নির্বাচনী আচরণবিধি। শেষমুহূর্তে প্রার্থীঘোষণা হলে প্রচারের সময়েও ভালোমতোই টান পড়বে। প্রার্থীদের হয়ে প্রচারটুকু যদি গুরুত্বপূর্ণ ভোটের আগে চালাতে না পারে, তাহলে আদৌ লোকসভা ভোটে লড়ার স্বপ্নটুকু ধরে রাখতে পারবেন তো সেই সেই কেন্দ্রের প্রার্থীরা। দলের অন্দরেই ঘুরপাক খাচ্ছে সেই প্রশ্নটাই।