মথুরা-বৃন্দাবন নয়, এই বাংলাতেই রয়েছে শ্রীকৃষ্ণের লীলাক্ষেত্র

একটি নারকেল তেল-সিঁদুর মাখিয়ে বালকদের মধ্যে ছেড়ে দেওয়া হয়‌। বালকরা কাড়াকাড়ি করে, তারপর যে দখল নিতে পারে, নারকেলটি তার হয়।

"হে কৃষ্ণ,করুণাসিন্ধু দীনবন্ধু জগৎপতে
গোপেশ গোপীকাকান্ত,রাধাকান্ত নমহস্তুতে"

শ্রীকৃষ্ণের লীলাকাহিনী এক অপার বিস্ময়। যার বিবরণ দেওয়া দুঃসাধ্য। কখনও তিনি বালগোপাল, কখনও তিনি ব্রজের রাখাল, কখনও তিনি শ্যামকিশোর আবার কখনও বংশীধারী মদনমোহন। অষ্টোত্তর শতনামের মতো একই অঙ্গে এত রূপ বর্ননা করা সাধারণ মানুষের ক্ষমতার বাইরে। পূর্ব বর্ধমানের কালনার আনাচকানাচে নানা দেবদেবীর মন্দির রয়েছে। কালনা শহর থেকে প্রায় কুড়ি কিলোমিটার দূরে বৈদ্যপুরের কাছে গোপালদাসপুর গ্রাম। এই গ্রামে রয়েছে প্রায় ৫০০ বছরের পুরনো একটি মন্দির। এই মন্দিরে শ্রীকৃষ্ণ, 'রাখালরাজা'-রূপে অবস্থান করছেন। আমরা জানি, মূলত 'মথুরা-বৃন্দাবন-দ্বারকা'- এই স্থানগুলিকে 'কৃষ্ণক্ষেত্র' বলা হয়। কিন্তু এই পশ্চিমবাংলাতেই শ্রীকৃষ্ণের এক নির্জন লীলাভূমি রয়েছে, যার খবর অনেকেরই অজানা। যার প্রচার প্রদীপের তলাতেই রয়ে গেছে। শহরের কোলাহলের বাইরে লোকচক্ষুর অন্তরালে রাখালরাজা যেন গোপনে প্রতিদিন তাঁর গোচারণভূমিতে বিচরণ করছেন।

আরও পড়ুন: নববধূর বেশে গঙ্গাস্নান করতেন স্বয়ং কালী! কালনার যে আখ্যান আজও অমলিন

'গোঠের রাখাল বলে দে রে
কোথায় বৃন্দাবন
যেথা রাখালরাজা গোপাল আমার
খেলে অনুক্ষণ'

কবি নজরুলের এই গানটি বারবার মনে পড়ে যায় এখানে এই মন্দির প্রাঙ্গণে দাঁড়ালে।

কথিত আছে, বর্ধমান জেলার খাটুন্দি (মতান্তরে খাতুন্দি) গ্রামের রামকানু গোস্বামী বর্গীদের ভয়ে এবং অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে (অনেকের মতে, পারিবারিক অশান্তিতে জেরবার হয়ে) তাঁর পরিবার এবং পরমারাধ্যা গোপীনাথকে সঙ্গে নিয়ে বৃন্দাবনের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লেন। তাঁর ছিল তিন পুত্র। নিমাই চাঁদ, বলদেব ও রাখাল। যাই হোক, তিন পুত্র ও স্ত্রী এবং গোপীনাথকে সঙ্গে নিয়ে বৃন্দাবনের উদ্দেশ্যে পথ চলতে লাগলেন রামকানু গোস্বামী। পথে পড়ল গভীর জঙ্গল। গোপীনাথের তখন খিদে পেয়েছে। তাই রামকানু ও তাঁর স্ত্রী ওই জঙ্গলেই ভোগ রান্না করে গোপীনাথকে নিবেদন করলেন। এরপর তিনি ওই জঙ্গলেরই খানিক অংশ পরিষ্কার করে সেখানে বসবাস শুরু করলেন। জনশ্রুতি শোনা যায়, তৎকালীন বাংলার নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ গোপীনাথের জন্য নিষ্কর জমি দান করেছিলেন। কথিত আছে, একদিন রামকানুর কনিষ্ঠ পুত্র রাখাল খেলতে গিয়ে একটি মাধবী গাছের ডালপালা সব ভেঙে ফেলে, সেদিন অন্যান্য ফুলের গাছেও ফুল ধরেনি। রামকানু সবাইকে জিজ্ঞেস করলেন, কে এই কাজ করেছে। কিন্তু কেউ স্বীকার করল না। দেবতার পুজোর ফুল কোথায় পাবেন, এই ভেবে রামকানু চিন্তায় পড়লেন এবং রাগ করে ছেলেদের বললেন, যে এই মাধবীলতা গাছটি নষ্ট করেছে, আজ রাত্রেই তার মৃত্যু হবে। পিতার অভিশাপে রাখালের মৃত্যু হল, ঘটনার আকস্মিকতায় হতবুদ্ধি রামকানু গোপীনাথের চরণ ধরে কান্নাকাটি করলেন। কিন্তু ফল কিছুই হল না। তিনি সেই দিনই স্বপ্নাদেশ পেলেন রাখালরাজার পুজো করার। স্বপ্নাদেশ অনুসারে রামকানু রাখালরাজার মূর্তিটি তৈরি করান। রাখালরাজার মূর্তিটি বড়ই মনোহারী। কৃষ্ণ রাখাল, ডানহাতে ধরা পাচন (গোচারণ লাঠি), বামহাতে ধরা ক্ষীরের নাড়ু। মূর্তিটির আর একটি বিশেষত্ব হল, এর ডান হাঁটুটি ভাঙা। মূর্তিটির দু'পাশে দু'টি সাদা গাভী। রাখালরাজার মূর্তির দু'পাশে রয়েছে অপেক্ষাকৃত ছোটো দু'টি মূর্তি। একটি রঘুনাথের এবং একটি গোপীনাথের।মন্দিরের পাশে একটি পুকুর আছে। পুকুরটি যমুনা নামে খ্যাত।সেই পুকুরে ভেসে ওঠা নিমকাঠ দিয়ে তৈরি হয় রাখালরাজার মূর্তি এবং স্বপ্নাদেশ অনুসারে মূর্তিটি তৈরি করে বাঘনাপাড়া গ্রামের একটি পাঁচ বছরের বালক, তার নাম মহাদেব। রাখালরাজার মূর্তিটি নীল রঙের। রঘুনাথের মূর্তিটি সবুজ বর্ণের।মাঘী পূর্নিমার তিনদিন আগে এই বালক মহাদেবের পরিবারের বংশধরেরা রাখালরাজাকে ভাঁড়ার ঘরের নিয়ে গিয়ে দ্বাররুদ্ধ করে অঙ্গরাগ করেন।আজও এই প্রথা বিদ্যমান।

সকালে রাখাল রাজা ঘুম থেকে উঠে, দাঁত মেজে, মুখ ধুয়ে মাখন, মিছরি, ক্ষীরের নাড়ু ও নারকেল নাড়ু- এইসব খান, এরপর সকাল ন'টায় ফলমূল, মিষ্টি ভোগ দেওয়া হয়। শীতের সময় বেলা ১১টায় একবার 'খিচুড়ি' বাল্যভোগ দেওয়া হয়।এরপর দুপুর ১২টায় মধ্যাহ্নভোজে দেওয়া হয় পাঁচ রকমের ভাজা, দু'রকমের ডাল, চার রকমের তরকারি, শুক্তো, চচ্চড়ি, পোলাও, চাটনি, পায়েস, ক্ষীর, দই, মিষ্টি। সন্ধ্যারতির পর রাখালরাজার ভোগ নিবেদন হয়ে গেলেই মন্দির বন্ধ করে সবাই চলে আসেন। তখন ওখানে আর কেউ থাকে না। রাতে রাখাল রাজা ওই গোচারণভূমিতে গরু চড়ান। এইসব লোককাহিনিতে স্থানীয় মানুষ ও ভক্তগণের অসীম বিশ্বাস। একবার একজন এই মন্দিরে ঢুকেছিল রাত কাটাবে বলে, কিন্তু মাঠে সাদা রঙের অনেক গরু চড়ে বেড়াচ্ছে আর কেউ একজন সুমধুর বাঁশি বাজাচ্ছে শুনে সে ভয়ে পালিয়ে যায়। পাঁচালিকার অজিতকুমার গোস্বামীর লেখা বই থেকেও এই মন্দির সম্পর্কে অনেক অলৌকিক কাহিনি জানা যায়। শোনা যায়, স্বয়ং রাখালরাজা কৃষকদের জমির ধান পাহারা দেন।

 

জন্মাষ্টমীতে এখানে খুব বড় করে উৎসব হয়। নানারকম খেলার মধ্য দিয়ে এই উৎসব পালিত হয়। একটি নারকেল তেল-সিঁদুর মাখিয়ে বালকদের মধ্যে ছেড়ে দেওয়া হয়‌। বালকরা কাড়াকাড়ি করে, তারপর যে দখল নিতে পারে, নারকেলটি তার হয়। শত শত বছর ধরে সাধুসন্ন্যাসী ও ভ্রমণপিপাসু মানুষ ভিড় করেছে এখানে।

জনশ্রুতি শোনা যায়, জমিদার গোপাল দাস শিকারে বেড়িয়ে একদিন গভীর জঙ্গলে ক্ষুধা-তৃষ্ণায় ক্লান্ত হয়ে পড়েন। হঠাৎ শুনতে পান, গভীর জঙ্গলের মধ্যে শঙ্খ-ঘণ্টাধ্বনি। সেই আওয়াজ অনুসরণ করে তিনি ও তাঁর সঙ্গীরা উপস্থিত হন রামকানুর রাখালরাজার মন্দিরে। গভীর জঙ্গলের মধ্যে এই দৃশ্য দেখে অবাক হন জমিদারমশাই। পুজো শেষ করে রামকানু গোস্বামী জমিদারমশাইকে প্রসাদ গ্রহণ করতে বলেন। কিন্তু এতগুলো মানুষের পেটভরা খাবার কী করে দেবেন এই গরিব ব্রাহ্মণ। অবাক হওয়ার আরও কিছু বাকি ছিল, তিনি দেখেন একটি ছোট্ট হাঁড়িতে ভোগ রয়েছে, কিন্তু এতগুলো মানুষ পেটভরে খেয়েও সেই ভোগের হাঁড়ি খালি হল না।

জমিদারমশাই এরপর এখানে সুন্দর একটি মন্দির স্থাপন করে দেন। ১৭৭৫ সালে গোচারণজমিসহ এই মন্দির রাখালরাজার নামে উৎসর্গ করেন তিনি। এই জমিদারের নামানুসারে এই গ্রামের নাম হয় গোপালপুর। লাল রঙের এই মন্দিরটিকে ঘিরে রয়েছে মানুষের অসীম বিশ্বাস।মন্দিরের গায়ে টেরাকোটার কারুকার্য মুগ্ধ করে। মন্দিরের পাশেই একটি বিশাল বট গাছ। গর্ভমন্দিরের সামনেই রয়েছে নাটমন্দির। শ্রীকৃষ্ণের বিভিন্ন লীলাখেলার বিবরণ রয়েছে সেখান। আজও গোস্বামীরা বংশপরম্পরায় সেবা করে আসছে রাখালরাজার। গোপালদাস পুরগ্রামের হৃদয়ের দেবতা উনি।প্রাণের ঠাকুর। বিশ্বাসের দেউল এই রাখালরাজা।

[তথ্যসূত্র: লোককাহিনি ও জনশ্রুতি]

More Articles