ঠাঁই হল না বাংলায়, ইতিহাসের মরা গাঙ বেয়ে গুজরাতে পাড়ি দিল বঙ্গের হারিয়ে যাওয়া 'ছোট্'!
Chhot Boat of Bengal: এই নৌকোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটা ইংরেজি V-এর মতো দেখতে। চেহারার সুবিধার জন্য ‘ছোট্’ নৌকো সহজেই মোহনা ও খাঁড়ি এলাকায় জল কেটে এগিয়ে যেতে পারত।
“বারবার ফিরে এসেছি আমরা এই পৃথিবীর টানে/
কখনো গাঙুর, কখনো কোপাই, কপোতাক্ষের গানে।”
ফিরে এসেছে বাংলার হারিয়ে যাওয়া নৌকো ‘ছোট্’। ফিরে এসেছে তার জন্মভূমি রূপনারায়ণের কূলে। তাকে ফিরিয়ে আনার মূল কাণ্ডারি হলেন নৃতত্ত্ববিদ স্বরূপ ভট্টাচার্য। সেই তরণীর অভিযাত্রী হয়েই ফিরে আসছে নদীমাতৃক বাংলার নৌ-ঐতিহ্য ও তার কারিগরির ইতিহাস। বাঙালির ইতিহাস বিস্মৃতির সময়ে, এইভাবে ঐতিহ্যের ফিরে আসা, তাকে ফিরিয়ে আনার লড়াই অনেক সম্ভাবনাকেই উসকে দিচ্ছে। স্বরূপ ভট্টাচার্যের কথায়, “আমাদের দেশে যে ইতিহাস রয়েছে তার অনেকটাই জীবন্ত ইতিহাস। সেই সব ইতিহাস একপ্রকার জীবাশ্ম হয়ে রয়েছে। খুঁড়ে দেখলে তা আমাদের দেশের প্রাচীন কারিগরি দক্ষতা ও কর্মকুশলতার হদিশ দিতে পারে।” নৌকোপ্রেমী স্বরূপ ভট্টাচার্যের নৌ-কারিগরি ইতিহাস খুঁড়ে দেখার শুরু সেই ১৯৯৭ সাল থেকে। তাঁর কাছ থেকেই জানা, বাংলার মেড়লি, ভেদি, বেতনাই, সুলতানি, খোড়োকিস্তি- এসব নৌকো আজ অবলুপ্ত। এদের মধ্যে বেশ কিছু হয়তো দু’দশক আগেও বাংলার খাল-বিল, নদী ও খাঁড়ি অঞ্চলে ভেসে বেড়াত। কিন্তু, গত বিশ বছরে নদীর ভূ-প্রাকৃতিক পরিবর্তন, পণ্য পরিবহনের আধুনিক মাধ্যমের সহজলভ্যতা ইত্যাদির কারণে হারাতে বসেছে দেশজ নৌকা এবং নৌকো তৈরির কৌশল। অবলুপ্তির সঙ্গে সঙ্গেই বদলে যাচ্ছে জলযান-নির্ভর জীবন ও জীবিকার ছবি। বাংলার নৌ-নির্মাণ শিল্পের গৌরবময় অতীতকে ফিরে দেখা ও দেখানোর তাগিদেই দক্ষিণ বাংলার লুপ্তপ্রায় নৌকো ‘ছোট্’-কে সংরক্ষণ করার উদ্যোগ নিয়েছেন স্বরূপ ভট্টাচার্য। তিনি জানাচ্ছেন, বহির্বিশ্বের কাছে এই নৌকো এখনও অনেকটাই অজানা।
‘ছোট’ নৌকা রূপনারায়ণ, নিচ দামোদর ও গঙ্গার নিম্ন অববাহিকায় মাছ ধরার কাজে, আবার কখনও মাল বইবার কাজে ব্যবহার করা হতো। এই নৌকোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটা ইংরেজি V-এর মতো দেখতে। চেহারার সুবিধার জন্য ‘ছোট্’ নৌকো সহজেই মোহনা ও খাঁড়ি এলাকায় জল কেটে এগিয়ে যেতে পারত। একসময় গঙ্গা ও দামোদরের নিচ অববাহিকা জুড়ে মৎস্যজীবীদের মধ্যে বহুল ব্যবহার ছিল। গত শতকের ষাট-সত্তর দশক থেকে নিচ দামোদরের অববাহিকায় নদীর ওপর একের পর এক বাঁধ তৈরি হতে থাকলে নদ-নদীর স্বাভাবিক নাব্যতা কমতে শুরু করে। অতিরিক্ত পলি জমে নদীর বুকে চর জেগে ওঠে। V আকৃতির তীক্ষ্ণ তলদেশ বিশিষ্ট ‘ছোট’ নৌকা চর পড়া নদীতে চলাচলের পক্ষে একেবারেই অনুপযুক্ত। ফলে, তাদের ব্যবহার কমে। যান্ত্রিক সুবিধার কারণে মোটরবোট, ট্রলার ইত্যাদিও শতাব্দী প্রাচীন নৌকোদের বিকল্প হিসেবে উঠে আসে। সব মিলিয়ে ছোটের ব্যবহার প্রায় বন্ধ হয়। তবে, স্বরূপ জানালেন, দিঘা, জুনপুট, খেজুরি সহ পূর্ব মেদিনীপুরের উপকূলবর্তী অঞ্চল জুড়ে মৎস্যজীবীদের মধ্যে এখনও 'ছোট্'-র ব্যবহার বেশ কিছুটা রয়েছে। অর্থাৎ 'ছোট্' আদিভূমি হারালেও পরিযায়ী হয়ে টিকে আছে।
আরও পড়ুন- অবাক করা এই দুই চিড়িয়াখানা চিরতরে হারিয়ে গেল পশ্চিমবঙ্গ থেকে
পরিযায়ী ‘ছোট্’-কে আদিভূমিতে ফেরানোর পথ মোটেই সহজ ছিল না। এ বিষয়ে স্বরূপ প্রথম আলোচনা করেন সাউদাম্পটন ইউনিভার্সিটির সমুদ্র পুরাতত্ত্ব গবেষক জিশান আলি শেখের সঙ্গে। তারপর তাঁরা ইউনিভার্সিটি অব এক্সেটারের প্রফেসর জন পি. কুপারের মধ্যস্থতায় ব্রিটিশ সংস্থা ইএমকেপি-র (EMKP: Endangered Material Knowledge Programme) কাছে প্রস্তাব জমা দেন। ইএমকেপি এমন এক সংস্থা যারা পৃথিবীর অবলুপ্তপ্রায় যে কোনও জ্ঞান, দক্ষতা, কর্মকুশলতা সংরক্ষণের জন্য অর্থ সাহায্য দেয়। এই সংস্থা ‘ছোট’-কে নতুন করে তৈরি করা এবং তার সংরক্ষণের জন্য আর্থিক অনুদান অনুমোদন করে। শুরু হল ছোটের পুনর্জন্ম। তবে জন্মের পর এই নৌকার ঠাঁই হবে কোথায়? অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও বাংলার এই নৌকাকে বাংলাতে রাখা সম্ভব হল না যথেষ্ট সুযোগের অভাবে।
আরও পড়ুন- কত শিশু ঘুরছে ভারতের রাস্তায়? পৃথিবীর বৃহত্তম শিক্ষাব্যবস্থায় অবাক করবে যে তথ্য
নৃতাত্ত্বিক সংরক্ষণের লড়াই সাময়িক স্তিমিত হলেও, বিষাদসিন্ধু পেরিয়ে আশার আলো ফুটল যখন হরিয়ানা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটির প্রফেসর বসন্ত সিন্ধে প্রকল্প সম্পর্কে আগ্রহ দেখালেন। ইএমকেপি-র শর্ত অনুযায়ী, ছোট বানানো হলে সংরক্ষণের বরাত কোনও অলাভজনক সংস্থাকেই দিতে হবে। সেই কথা মতো, প্রফেসর সিন্ধের তৎপরতায় গুজরাতের লোথালে অবস্থিত সেন্ট্রাল মেরিটাইম মিউজিয়াম দায়িত্ব নিল বাংলার ‘ছোট্’ সংরক্ষণ করার।
শুরু হলো 'ছোট্' বানানোর কাজ। বেছে নেওয়া হলো তারই জন্মস্থান রূপনারায়ণের পূর্ব তীরবর্তী শ্যামপুর দু'নম্বর ব্লকের ডিহিমন্ডল ঘাট। ৭০ বছর বয়সী পঞ্চানন মণ্ডলের হাত ধরে শুরু হলো নতুন করে নৌকো তৈরির। প্রায় তিন দশক আগে তিনি শেষ ‘ছোট’ বানিয়ে ছিলেন। স্বরূপ বললেন, দায়িত্ব পেয়ে পঞ্চানন মণ্ডলের বার্ধক্যেও শিশুসুলভ চঞ্চলতা ফিরে এসেছে। নৌকা বানানোর কাজে তাঁকে সাহায্য করেছেন চার ছেলে- অমল, মণিমোহন, দিলীপ, দীপক। বড় ছেলে অমল ‘ছোট’ তৈরির কারিগরি কিছুটা জানে। বাকি ছেলেরা নৌকোর কাজ জানলেও, ছোট বানানোর দক্ষতা তাঁদের ছিল না। আজও পারম্পরিক জ্ঞান আশ্রয় করে দেশি নৌকো বানানোর চল রয়ে গেছে বঙ্গদেশে। রীতি মেনেই, পঞ্চানন মণ্ডল এবার সুযোগ পেলেন তাঁর ছেলেদের ছোট বানানোর খুঁটিনাটি শিখিয়ে দেওয়ার। অর্জুন, বাবলা জাতীয় গাছের কাঠ থেকে তৈরি হয় ছোট। নৌকো বানানোর কাজ শেষ হলে তার গায়ে গাব গাছের আঠা মাখিয়ে গাউনি করা হয়। শেষ পর্যন্ত, গত ১০ নভেম্বর নবনির্মিত ছোটকে রূপনারায়ণের জলে ভাসিয়ে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হলো। ছোট তৈরির সম্পূর্ণ কৌশল ও প্রক্রিয়া ফটোগ্রাফি, ভিডিওগ্রাফি, ইন্টারভিউ ইত্যাদির মাধ্যমে নথিভুক্ত করা হয়েছে। ভবিষ্যতে, এই কারিগরিকৌশল সংরক্ষিত হবে ব্রিটিশ মিউজিয়ামের আর্কাইভে। ডিজিটাল প্লাটফর্মেও তথ্য পাওয়া যাবে। আর, পূর্বশর্ত অনুযায়ী, ছোট্ চলে যাবে গুজরাতের লোথাল মেরিটাইম মিউজিয়ামে। দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে ছোট্কে বাঁচানোর যে লড়াই স্বরূপ লড়ছেন তা এবার সফল।
কবেই বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট চুকিয়ে কাজের সূত্রে স্বরূপের জড়িয়ে পড়া নৌ-নৃতত্ত্বের। তাঁকে আঁকড়ে ধরল নৌকো, তিনি নৌকোকে জড়িয়ে ধরলেন। যাতে বাকি জীবন সেই নিয়েই থাকতে পারেন। নৌকা নিয়েই যখন জীবন, বেঁচে থাকার, বাঁচিয়ে রাখার লড়াইময় সে জীবনে ওঠাপড়া, দোলাচল, অনিশ্চয়তা থাকবেই। স্বরূপের কথায়, “নৌকা নিয়ে পড়ে থাকা মানে আসলে জলে চলে যাওয়া। আমি জলে রয়েছি। হিসেব মতো আমার পায়ের তলায় মাটি নেই, শুধুই জল। কখনও কখনও ভাঁটাতে নেমে যাচ্ছি, আবার জোয়ারের জলে ভেসে উঠছি। এভাবেই চলছে।”