প্রেম আসলে নিষ্ঠুর, আদিম! মানিক, বনফুল, তারাশঙ্করের না-ভালোবাসার তিন আখ্যান
Love in Literature: ভিখু একদিন রাতে অদম্য-রমণীক্ষুধায় পাঁচীকে দখল করবে বলে বসিরকে খুন করে। তখন কী করল পাঁচী!
দুই বন্দ্যোপাধ্যায় আর এক মুখোপাধ্যায়। তারাশঙ্কর, মানিক আর বলাইচাঁদ। বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় নামটা যদি অচেনা লাগে তাহলে বনফুল বললেই চলবে – চেনা চেনা লাগবে। তিনজনেই উচ্চবর্ণ হিন্দু, তারাশঙ্কর আর বনফুলের বিত্ত-প্রতিষ্ঠা দুই যথেষ্ট। মানিক অবশ্য অর্থকষ্টে দিন কাটাতেন। তিনজনের লেখা তিনটে গল্প – ভালোবাসার অথবা না-ভালোবাসার।
ভালোবাসার সঙ্গে টাকা-পয়সার যোগ আছে বুঝি? আছে, আছে।
পয়সাওয়ালাদের প্রেম করার প্রকাশ-পদ্ধতি গরিব গুর্বোদের থেকে আলাদা। প্রেমকে চিরায়ত করে রাখার জন্য বড়লোকি চিহ্নের নানারকম নমুনা এদেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। তাজমহলের শিল্পমূল্য নিয়ে প্রশ্ন তুলছি না, কিন্তু তা যে বড়লোকের প্রেমের নমুনা সে কথা অস্বীকার করি কী করে! বলাইচাঁদ অস্বীকার করেননি, ডাক্তার মানুষ– কেটে-কুটে দেখা তাঁর স্বভাব। বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় বনফুল নামে যখন গল্প-উপন্যাস লিখতে বসেন তখন বড়লোকি প্রেমের চালকে দু' কথা শোনাতে ভোলেন না। তাঁর ‘তাজমহল’ গল্পের গোড়াতেই তাজমহলপ্রেমীদের মুখে ঝামা ঘষে দিয়েছেন।
"দূর থেকে দিনের আলোয় তাজমহল দেখে দমে গেলাম। চুনকাম করা সাধারণ একটা মসজিদের মতো – ওই তাজমহল! তবু নির্নিমেষে চেয়ে রইলাম! হাজার হোক তাজমহল।"
বনফুলের গল্পটা বড়লোকের তাজমহল নিয়ে নয়, গরিবের তাজমহল নিয়ে। গল্পের কথক আগ্রায় এসেছেন দাতব্য চিকিৎসালয়ের ডাক্তার হয়ে। তাজমহল সম্বন্ধে তাঁর মোহ কেটে গেছে। তার বদলে অন্য এক তাজমহল গড়ে উঠতে দেখলেন তিনি। বাউলের মতো বৃদ্ধ। সাদা ধবধবে দাড়ি। মুখে চোস্ত উর্দু। পরেছেন আলখাল্লা। খুবই গরিব। স্ত্রীকে নিয়ে এসেছেন দাতব্য চিকিৎসালয়ে। মুখের আধখানা পচে গেছে তাঁর। ডান দিকের গালটা নেই। দুর্গন্ধে পাশে দাঁড়ানো যায় না। ক্যাংক্রাম্ অরিস। রোগীদের আপত্তিতে হাসপাতালে রাখা গেল না তাঁকে– কম্পাউন্ডার, ড্রেসার, মেথর কেউ আসে না মহিলার কাছে। কাছেই গাছতলায় বেগমকে নিয়ে বুড়ো আশ্রয় নিলেন। ডাক্তারের কাছ থেকে ওষুধ নিয়ে আসেন, সেবা করেন বেগমের। বৃষ্টি এলে গাছের ডালে চাদরের দুটো খুঁট বেঁধে অন্য খুঁটদুটো ধরে থাকেন হাতে। বেগমসাহেবা আপাদমস্তক ভিজে যান। ঠকঠক করে কাঁপেন। মুখে তাঁর বীভৎস হাসি। বেগম থাকলেন না, চলে গেলেন। ডাক্তারবাবু ঝাঁ ঝাঁ দুপুরে একদিন ফিরছেন, মিঞা সাহেবের সঙ্গে দেখা। বুড়ো কী যেন গাঁথছেন! কী গাঁথছেন? গাঁথছেন বেগমের কবর। ডাক্তারবাবু জানতে পারলেন আগ্রার আশেপাশে ভিক্ষে করেন তিনি– নাম তাঁর ফকির শা-জাহান। গল্পের শেষে কথক ডাক্তারবাবু নির্বাক– বুঝতে অসুবিধে হয় না বড়লোক শাহজাহানের প্রেমের গল্পকে ম্লান করে দিল গরিব ফকির শা-জাহানের নিজের হাতে গড়া কবর। সে কবরের কথা কেউ জানবে না, তবু রয়ে গেল।
আরও পড়ুন- প্রেমে খুনই শেষ সত্য নয়, ‘রক্তকরবী’-র বিশু পাগল তার প্রমাণ
দরিদ্ররা কি সবাই ফকির? দারিদ্র্য কি মহান করে কেবল? দারিদ্র্য ভেতরের পশুকে বাইরে আনে না! সে প্রেমের রূপ আরেক রকম। প্রেম না অপ্রেম?
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘প্রাগৈতিহাসিক’ আর তারাশঙ্করের ‘তারিণী মাঝি’ গল্প দু'টি পাশাপাশি রাখতে ইচ্ছে করে। বনফুলের গল্পের ফকির ভিখিরি। ভিখিরিরা কেবল ফকিরই হন না, ভিখিরিরা তাঁদের শরীরের ক্ষত খুঁচিয়ে তুলে ভিক্ষের বাজার জিইয়ে রাখেন। মানিকের ‘প্রাগৈতিহাসিক’ গল্পের পাঁচী তাই করত। তার পায়ের ঘা-টি তার ভিক্ষার উপায়। কামনাপরবশ, রমণীপরায়ণ ভিখু ডাকাত ডাকাতি করতে গিয়ে আহত হয়ে চলে আসে ভিক্ষের লাইনে। ভিখিরি হলেও তার ভেতরের বন্যদাপট যাওয়ার নয়। পেটে খাবার পড়লে শরীর রমণী চায়। পাঁচীকে চেয়েছিল সে, ঘা নিরাময় করে ওষুধ লাগিয়ে রমণীয় হয়ে পাঁচী তার হবে এই ছিল সাধ। পাঁচী জানে আত্মরক্ষার উপায় হারিয়ে ফেলতে নেই, তার পায়ের জেগে থাকা ঘা তার আত্মরক্ষার উপায়। ওই ঘা দেখেই তো করুণাপরবশ হয়ে অনেকে ভিক্ষে দেয় তাকে। তাকে নিতে হলে তার স্বাবলম্বনের উপায় ওই ঘা-টিকেও নিতে হবে। ভিখুর ঘা সম্বন্ধে দ্বিধা ছিল বলে পাঁচী বসিরের হয়ে যায়। ভিখু একদিন রাতে অদম্য-রমণীক্ষুধায় পাঁচীকে দখল করবে বলে বসিরকে খুন করে। তখন কী করল পাঁচী! যখন বুঝল ভিখু তাকে পেতে চায় বলেই বসিরকে খুন করল তখন নিহত বসিরের সঞ্চিত টাকা নিয়ে ভিখুর সঙ্গে চলে যায় সে। ভিখুর সঙ্গে চলেছে পাঁচী। তার পায়ের ঘা চলতে বাজে। তখন কী করল ভিখু? পিঠে চাপায় পাঁচীকে। "ভিখুর গলা জড়াইয়া ধরিয়া পাঁচী তাহার পিঠের উপর ঝুলিয়া রহিল।" আকাশে তখন নবমীর চাঁদ। ভিখু-পাঁচীর এই ভালোবাসার কিম্বা না-ভালোবাসার পারস্পরিকতা বনফুলের গল্পের ভিখিরি ফকির কি বুঝতে পারবে?
সে না পারুক বুঝতে বোধহয় পারবে তারিণী মাঝি। তারাশঙ্করের তারিণী। মাঝি হিসেবে যেমন তার পরিচিতি তেমন পরিচিতি জলে ডোবা মানুষ বাঁচানোর কাজে। মানুষ বাঁচানোর কাজ সে অবশ্য এমনি এমনি করে না। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জলে ঝাঁপায়, মানুষটিকে তোলে, তারপর পুরস্কার চেয়ে নেয়। ঘোষ মশাইয়ের বধূটিকে বাঁচানোর পর তারিণী শেষে বলেছিল, "ফাঁদি লত একখানা ঘোষমশাই।" এই সব উপার্জন তার সুখীর জন্য। সুখী তার বউ। তন্বী, সুশ্রী, উজ্জ্বল, শ্যামবর্ণা। এ শরীর জলদাস তারিণীকে টানে, মত্ত হয়ে ঘরে ফিরে এ শরীরে তার আশ্রয়। এ শরীরের জন্য জলমগ্ন মানুষদের উদ্ধার করে তার উপার্জন।
আরও পড়ুন- গুরুপত্নীর প্রেমপত্র শিষ্যকে! কেন বীরাঙ্গনা কাব্য বিদ্যাসাগরকেই উৎসর্গ করলেন মধুসূদন?
প্রকৃতি মানুষের চেয়ে বড়। তারাশঙ্কর জানেন এই প্রকৃতি মানুষকে চালায়। কখনও প্রাকৃতিক আত্মরক্ষার প্রবৃত্তিকে অতিক্রম করে মানবিকতা বড় হয়ে ওঠে কখনও বা আত্মরক্ষার একক জৈবপ্রবৃত্তিই মুখ্য। তারিণী তো সুখীর জন্য, সুখীর সঙ্গে সুরতের জন্য দুর্দম ভাবে বেঁচে ছিল। অথচ খরার পর যখন হঠাৎ বন্যা এল, ভেঙে গেল জলে তাদের বাড়ি তখন প্রকৃতি তারিণীকে দাঁড় করাল কঠিন এক মুহূর্তের মুখোমুখি। জলের মধ্যে সুখীকে পিঠে নিয়ে চলেছে তারিণী। মানিকের ভিখু-পাঁচীর দৃশ্যের মতোই। বলে সে, "নদীতেই বা পড়লাম সুখী। পিঠ ছেড়ে আমার কোমরের কাপড় ধরে ভেসে থাক।" কিন্তু তারপর হঠাৎ ঘূর্ণির মুখোমুখি তারা। ঘূর্ণিতে পড়ে ভেসে যাবে নাকি দু'জনে? দু'জনের সলিল সমাধি লিখে তারাশঙ্কর জিতিয়ে দেবেন তারিণীর ভেতরের আত্মত্যাগী মানুষকে? না।
"তারিণী সুখীর দৃঢ় বন্ধন শিথিল করিবার চেষ্টা করিল। কিন্তু সে আরও জোরে জড়াইয়া ধরিল। বাতাস – বাতাস! যন্ত্রণায় তারিণী জল খামচাইয়া ধরিতে লাগিল। পর-মুহূর্তে হাত পড়িল সুখীর গলায়। দুই হাতে প্রবল আক্রোশে সে সুখীর গলা পেষণ করিয়া ধরিল! ... যে বিপুল ভারটা পাথরের মতো টানে তাহাকে অতলে টানিয়া লইয়া চলিয়াছিল। সেটা খসিয়া গেল, সঙ্গে সঙ্গে সে জলের উপরে ভাসিয়া উঠিল। আঃ আঃ – বুক ভরিয়া বাতাস টানিয়া লইয়া আকুল ভাবে সে কামনা করিল, আলো ও মাটি।"
আলো ও মাটির আদিম কামনায় কি ভালোবাসার আত্মত্যাগ হেরে যায়? ভিখু আর পাঁচী কী বলবে তারিণীকে? আর শা-জাহান? কী বলবেন ফকির শা-জাহান?
উত্তর মেলে না। অথবা উত্তর দু'রকম সম্ভাবনায় ঘুরপাক খায়।
ভালোবাসার কথা শেষ, ভালোবাসার কথা শুরু।