সলিল-সমাধি রুখতে সমুদ্রের ওপর শহর, মালদ্বীপের এই উদ্ভাবন যে পথ দেখাচ্ছে

হঠাৎ মালদ্বীপ এই প্রকল্পে হাত দিল কেন? কারণ ১,১৯০টি দ্বীপ নিয়ে তৈরি এই রাষ্ট্র জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে একেবারে বিপদসীমায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। আশঙ্কা রয়েছে, আগামী কয়েক দশকের মধ্যে পুরো দেশটাই একেবারে সমুদ্রের জলের তলায় চলে য...

'Necessity is the mother of innovation', কথাটা বলেছিলেন গ্রিক দার্শনিক প্লেটো। মানবজাতির যা যা যুগান্তকারী আবিষ্কার, উদ্ভাবন, সবই চলতি ভাষায় বলা যায়, ঠেকায় পড়ে। নিজের দায়ে। প্রয়োজনে। আগুন জ্বালিয়ে ফেলা দুর্ঘটনা ছিল বটে, কিন্তু সেও ছিল নিজেকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টার ফল। লক্ষাধিক বছর কেটে গেছে সেই দিনের। আজ পৃথিবী দেখছে মানবজাতির চূড়ান্ত উন্নতি। প্রযুক্তির বলে বলীয়ান হয়ে মানুষ জয় করেছে এই গ্রহকে। না, ভুল হলো। সমস্ত প্রাণীদের ছাপিয়ে আধিপত্য বিস্তার করেছে এই গ্রহের ওপর। কিন্তু জয়? না।

উত্তর খুবই সোজা। শিল্পবিপ্লব এবং তার ফলস্বরূপ জীবাস্ম জ্বালানি দহন করে শক্তি উৎপাদন, এবং এই গ্রহের বাতাসকে দূষিত করা, উত্তপ্ত করা। এবার পালা প্রকৃতির প্রতিশোধ নেওয়ার। সেই প্রতিশোধস্পৃহা থেকে নিজেকে রক্ষা করাই এখন মানবজাতির 'Necessity'।

বিশ্ব উষ্ণায়ন এবং তার ফলে হওয়া জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রের জলস্তর বাড়ছে। যত দিন যাচ্ছে, ততই দ্বীপরাষ্ট্রগুলি সলিল-সমাধিস্থ হওয়ার পথে এগিয়ে যাচ্ছে। সেই বাড়তে থাকা জলস্তর মোকাবিলায় এক নতুন, খুবই অভিনব এবং গুরুত্বপূর্ণ এক প্রযুক্তির আবিষ্কার করে ফেলেছে মানুষ। সমুদ্রের রোষ থেকে বাঁচতে একেবারে সমুদ্রের ওপরেই শহর নির্মাণ করা শুরু করে দিয়েছে তারা।

আরও পড়ুন: পরিবেশ রক্ষার মার্কশিটে ডাহা ফেল, কেন এই অবস্থা ভারতের?

অবাক হলেন? হওয়ারই কথা। এরকমই একটি ভাসমান শহর নির্মিত হতে চলেছে মালদ্বীপের রাজধানী মালে থেকে নৌকো-পথে ঠিক দশ মিনিটের দূরত্বে। যেখানে বাস করবেন কুড়ি হাজার মানুষ। ৫০০০টি ভাসমান পাটাতনের ওপর তৈরি হবে সেই শহর। যেখানে থাকবে বাড়ি, বিদ্যালয়, রেস্তোরাঁ, দোকান বাজার। এই ৫০০০টি পাটাতন যুক্ত থাকবে খালের মাধ্যমে। মালদ্বীপ সরকার এবং ডাচ ডকল্যান্ড নামক এক সংস্থার এই যৌথ প্রকল্পের কাজ ২০২৭ সালে সম্পূর্ণ হওয়ার কথা।

কিন্তু হঠাৎ মালদ্বীপ এই প্রকল্পে হাত দিল কেন? কারণ ১,১৯০টি দ্বীপ নিয়ে তৈরি এই রাষ্ট্র জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে একেবারে বিপদসীমায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। আশঙ্কা রয়েছে, আগামী কয়েক দশকের মধ্যে পুরো দেশটাই একেবারে সমুদ্রের জলের তলায় চলে যাবে। কিন্তু যদি এরম কোনও শহর তৈরি করা সম্ভব হয়, যা সমুদ্রের জলস্তরেই ভাসবে, তাহলে তার জলের তলায় চলে যাওয়ার কোনও সম্ভাবনাই থাকে না, কারণ জলস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধি পেলে সেই শহরেরও উচ্চতা বাড়বে। সহজ ভাষায় শহরের উচ্চতা বৃদ্ধির হার সমুদ্রের জলের স্তর বৃদ্ধির হারের সমানুপতিক।

ভাসমান শহরের এই ভাবনা শুরু হয়ে গেছে অনেক আগে থেকেই। নিউ ইয়র্কে রাষ্ট্রপুঞ্জের প্রধান দপ্তরে উদ্বোধন করা হয়েছে বিশ্বের প্রথম ভাসমান শহর। দক্ষিণ কোরিয়ার বুসান শহরে ২০২৫ সালের মধ্যে 'ওশিয়ানিক্স' নামক এক সংস্থা ভাসমান শহর গড়ে তুলতে চলেছে। তার ঠিক পরেই রয়েছে মালদ্বীপের এই শহর।

তবে এই ভাসমান শহর নিয়ে যে আন্দোলন, তার কেন্দ্রে রয়েছে নেদারল্যান্ডস। সেই দেশের এক সংস্থা এই শহরের নকশা তৈরি করেছে, আর এক সংস্থা নির্মাণ কাজ করবে। নেদারল্যান্ডসও সমুদ্রস্তর থেকে খুব সামান্য উচ্চতায় রয়েছে। যে কারণে বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে, এতগুলি সংস্থার জন্ম দিয়েছে তারা, যারা সমুদ্রের ওপর শহর বানানোর জন্য গবেষণা করছে বা নির্মাণ করছে।

এবার প্রশ্ন উঠতে পারে, যে ঠিক কীভাবে এই ধরনের শহরগুলিকে সুরক্ষিত রাখা সম্ভব? সুনামি, ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষেত্রে কী হবে?

নির্মাতারা জানাচ্ছেন, এমনভাবেই নকশা বানানো হচ্ছে, যাতে সবরকম বিপর্যয়েই এই ধরনের শহর সুরক্ষিত থাকবে। তারা সব ধরনের প্রয়োজন, যেমন বিদ্যুৎ, খাদ্য, পানীয় জল সব দিক দিয়েই আত্মনির্ভর হবে। একই সঙ্গে এটাও নির্মাতারা জানাচ্ছেন, যে, কোনওরকম সামুদ্রিক প্রাণী বা প্রবাল প্রাচীর ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। হ্যাঁ, এটা ঠিকই, যে শুরুতে এই শহরগুলিতে থাকা যথেষ্ট ব্যয়বহুল হবে। কিন্তু আগামী দিনে এই শহরগুলি হয়ে উঠবে সাধারণের। বাড়তে থাকা জলস্তরের বিরুদ্ধে সবথেকে শক্তিশালী হাতিয়ার হয়ে উঠবে ভাসমান শহরগুলি।

এই কঠিন সময়ে এই ধরনের উদ্ভাবন যথেষ্ট আশাব্যঞ্জক। শুধু প্রয়োজন, যত দ্রুত সম্ভব, এই পরিষেবাকে সাধারণের আয়ত্তে এনে ফেলা। অনেক মানুষ সেক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উদ্বাস্তু হওয়ার হাত থেকে নিষ্কৃতি পাবেন।

More Articles