ট্রেন্ড আসে যায়, বিজয়িনী সেই শাড়িই! মলমলে লেগে কাশফুলের গন্ধ
Malmal Saree: যারা ট্রেন্ডি না হয়ে এই শরতে হতে চাইছে স্টাইলিশ, এই শরতে তাদের জন্য এমন অন্যরকম সাজের ভাবনা ভাবা যেতেই পারে।
আলসেমির রং কী হতে পারে? যে কোনও হালকা রংই হয়তো হতে পারে আলসেমির রং। ধরা যাক, সবুজ। ঠিক গাঢ় সবুজ নয়, হালকা। যেরকমটা শরতে কচি ঘাসের গায়ে রোদ পড়লে দেখা যায়, তেমন একটা নরম রং দেখতে পাই আমরা। সেই রং যদি দু'-মুঠো ছড়িয়ে নেওয়া যায় শাড়িতে! অবশ্য সেটা যে সে শাড়ি হলে হবে না। শাড়ি হতে হবে সুতির, মলমল কাপড়ের। মলমল সূক্ষ্ম সুতিবস্ত্র। অবন ঠাকুর লিখেছিলেন, "কারো গায়ে ফুলদার লক্ষ টাকার মলমলি চাদর।" একসময় বেশ চল ছিল মলমলের ধুতির– বঙ্কিমচন্দ্রর 'রজনী' উপন্যাসে রামসদয়বাবু মলমলের ধুতি পরতেন।
এসব পুরনো কথা থাক। মন ধরা দিক মলমলের শাড়িতে। তার আঁচল হতে হবে ফুরফুরে হাওয়ার মতো দস্যি। ব্লাউজখানি হোক না কাশফুলের মতো সাদা রাফল স্লিভ। বা হাকোবা ব্লাউজেও মন্দ লাগবে না। নরম রঙের তো এই এক মজা। তাকে ধারণ করতে হয়। আর ধারণ করতে পারলেই, ঝলমলে গাঢ় রঙের পোশাকের ভিড়ে, সে হয়ে উঠবে ভোরবেলার মতো আদুরে। নরম রং, তারও তো মায়া আছে। সবুজ শাড়ির আঁচলে বাতাস খেলা করে গেলে, মনে তো হবেই যেন কাশের বনে ঢেউ লেগেছে। অথচ এই সাজে যে হেঁটে যাবে, সে শুভঙ্করের নন্দিনী নয়, অমিত-র লাবণ্য নয়, সে বরং সুনীলের নীরা। ছটফটে, প্রাণবন্ত। ছেলেমানুষির আলস্য-রঙ তার পোশাকে, তার চলায়। যে যুবতী ছিল, অথচ কোন পুণ্যে ফের কিশোরী হলো, কেউ জানে না।
শিশির ভেজা ঘাসে তোমার চাঁপা রঙের পা
তোমার চোখে চোখ রেখেছে সদ্য ফোটা জুঁই
সেই মুহূর্তে নীরা তুমি টেরও পেলে না
ফুলকে ছেড়ে ভ্রমর বললো কিশোরীটিকে ছুঁই।
এই যে মায়ারং-এর কথা বললাম, সে রঙ কি খুব পরিপাটি? একদমই না। আলস্য আর মায়া, এই দুই-ই ভারি অগোছালো। শীতের বেড়ালের মতো এলোমেলো বসে মিঠে-রোদ পোহায়। শান্তিনিকেতনের মেয়েরা তেমন আলস্য জড়ায় শাড়িতে। এখানে শাড়ির প্লিট পরিপাটি আর ক'জনেরই বা থাকে! কাঁধের কাছে জড়ো হয়ে থাকা শাড়ির আঁচল দেখে মনে হতেও পারে কী তাড়াহুড়ো! যেন গুছিয়ে শাড়িটা পরার অবকাশটুকু পায়নি। অথচ, এ এখানকার নিজস্ব স্টাইল। কখনও খোলা চুল, কখনও আবার হাতখোঁপা থেকে উঁকি দেবে গুলঞ্চ, রঙ্গন, বা মধুমালতীরা। গয়নাগাটি পরলেও হয়, না পরলেও। জোরজার নেই কারও। শুধু কপালে টিপখানি, বিকেলের অস্তসূর্যের মতো চেয়ে থাকে যেন। একদা শান্তিনিকেতনের মেয়েরা কপালে খয়েরের টিপ পরত, কেউ পরত গুঁড়ো টিপ, কেউ বা শিউলিফুলের পাপড়ির রস দিয়ে কপাল রাঙাত। আজকাল প্রাকৃতিক টিপের চল কমেছে, তবে একেবারে উঠে যায়নি। এখনও শান্তিনিকেতনে কোনও কোনও মেয়ে, গুঁড়ো টিপে কপাল সাজিয়ে কোমরে সুতি শাড়ির আঁচলখানি গুঁজে সাইকেল চালিয়ে চলে যায় হুস করে। ঝরা শালের পাতার ওপর দিয়ে তাদের চলে যাওয়ার শব্দ মর্মরিয়ে ওঠে। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথের প্রিয় শান্তিনিকেতনের হরিচরণ 'বঙ্গীয় শব্দকোষ'-এ জানিয়েছেন, সংস্কৃত 'মর্মর' থেকে এসেছে মলমল। অর্থ, বস্ত্রধ্বনি। মলমলের শাড়ি পরে সাইকেলবিহারিণী যখন কোপাই নদীর পানে যায় তখন পুরুষের মনে ধ্বনি গুঞ্জরিয়া উঠে।
কিন্তু এই যে পোশাকের রং নিয়ে, ধরন নিয়ে এত ভাবছি, কেন ভাবছি- তা মনে হতেই পারে। আজকাল যে কোনও রঙ যে কোনও সময় যে কেউ পরতেই পারে। তাতে কোনও আপত্তি নেই। এটাই এখন ট্রেন্ডি। কিন্তু যারা ট্রেন্ডে গা না ভাসিয়ে হাঁটতে চাইছে একেবারে একার রাস্তায়, তারা? যেমন হাঁটতেন রবীন্দ্রনাথ। সব ঋতুতে সব রঙের সাজ যে চলে না এ-কথা মানতেন তিনি। রাণী চন্দর লেখায় আছে সে-সব কথা। রবীন্দ্রনাথের মতো যারা ট্রেন্ডি না হয়ে এই শরতে হতে চাইছে স্টাইলিশ, যারা একটু গুছিয়ে একটা অগোছালো মনকে দেখতে চাইছে, এই শরতে তাদের জন্য এমন অন্যরকম সাজের ভাবনা ভাবা যেতেই পারে। এই যে অলংকারবিহীন একটা সাজ, তাই বলে কি সত্যি সত্যিই কোনও অলংকার থাকবে না? থাকবে। তবে সেই অলংকার প্রকৃতির, রঙের, সৌন্দর্যের। সাজতে বসে নিজেকে ঢেকে ফেলে অন্য কেউ হয়ে ওঠা তো শান্তিনিকেতনের সাজ নয়। বরং নিজের ভেতর থেকে নিজেকে আরও বেশি করে টেনে বের করে আনাই হলো এখানকার সাজ। তার জন্য প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে যাওয়া চাই।
শান্তিনিকেতন তো এভাবেই প্রকৃতি আর মানুষকে মিলিয়ে দেওয়ার গল্প বলছে বহুকাল ধরে। ঋতু বদলে গেলেই এখানে বদলে যায় পোশাকের রঙ। কাজেই ঠিক সময়ে প্রকৃতি থেকে ঠিক রংটা বেছে নিতে হবে। এই শরতে ঘাসরঙা শাড়ি আর কাশরঙা ব্লাউজে মেয়েরা খুঁজে নিক নিজেকে।