এমন অবিবেচক মেয়েকেই চেয়েছিল বাংলা?

"শুনেছি মেয়েটার অ্যাফেয়ার ছিল। একে কি ধর্ষণ বলবেন?" রাজ্যের সংবাদ-সচেতন মানুষ টিভি-প্রিন্ট-ডিজিটাল মিডিয়ার কল্যাণে জেনে গিয়েছেন হাঁসখালির ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে এই উবাচ কার। তাঁকেই বছরখানেক আগে বিপুল ভোটে জিতিয়ে আনা হয়েছিল। বাংলার প্রতিটি বুথে ভোট হয়েছে তাঁর ভাবমূর্তিকে সামনে রেখে। তিনি 'নিজের মেয়ে' এই ধ্বনি অনুরণিত হয়েছে এ-রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠের মুখে। 'নিজের মেয়ে' এই শব্দটির মধ্যে নানাবিধ প্রত্যয় আছে। একদিকে বহিরাগতর হাতে কৃষ্টি-সংস্কৃতি তুলে না দেওয়ার শপথ আছে, অন্যদিকে ২৮টি রাজ্যের মধ্যে অনন্য নজির সৃষ্টি করে প্রশাসক হিসেবে একজন মহিলাকে বেছে নেওয়ার বিবেচনাও আছে।

পশ্চিমবঙ্গের জনগণের একটা বড় অংশের তাঁর কাছে প্রাথমিক প্রত্যাশা ছিল, একইরকম বিবেচনার বোধ। কিন্তু তিনি ক্ষমতার স্তম্ভে তৃতীয়বার আরোহণ করেই প্রমাণ করলেন, রাজ্যবাসীর যাবতীয় প্রত্যাশা মিথ্যে। সবচেয়ে বড় সত্য, শাসকের অসংবেদনশীলতা, অবিবেচনা, অতি অশ্লীল কুকথার বহমানতা।

রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর সাংস্কৃতিক গতায়াত ছিল। প্রেসিডেন্সি কলেজের বাংলার ছাত্র বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য নিরন্তর সাহিত্যচর্চায় মজে থেকেছেন। অনুবাদকর্মে নিয়োজিত থেকেছেন, নন্দনে বিকেল কাটিয়েছেন। বইমেলার ময়দানে গুন্টার গ্রাসের সঙ্গে খোশগল্প জুড়ে দিয়েছেন। তাঁর সাংস্কৃতিক পুঁজি ছিল পরিবারসূত্রে অর্জিত। সেই মূলধনকেই তিনি সংস্কৃতির নানা শাখায় বিনিয়োগ করেছেন। তাঁকে গদিচ্যুত করে ক্ষমতায় আসা তৃণমূল নেত্রী তথা রাজ্যের এখনকার প্রশাসনিক প্রধানের সেই পেডিগ্রি ছিল না। রাজ্যের মানুষ তাঁর থেকে সম্ভবত এমন কোনো প্রত্যাশাও রাখেনি। তারা একটা দীর্ঘ অরাজক পরিস্থিতি থেকে ক্রমমুক্তির পথ খুঁজছিল। কিন্তু সাংস্কৃতিক পুঁজির অভাবটাকে পুষিয়ে দিতে হবে, এই বোধটা সম্ভবত মমতার পিছু ছাড়েনি। ফলে ক্রমেই যে মানুষটি উদ্ভাসিত হল, তিনি কথায় কথায় সস্তা ছড়া কাটেন, সাংস্কৃতিক নানা ক্ষেত্রে নিজেকে কোনও না কোনও ভাবে গুঁজে দেন। মাঝে মাঝেই এমন 'ননসেন্স' শব্দচয়ন করেন, যা মুখ্যমন্ত্রীর মুখে শুনতে কোনও সুস্থ মানুষই চান না। তাঁর উত্তরণের পথকে সম্মান না করে উপায় নেই। কিন্তু তাঁর সার্বিক চলন-বলনকে মান্যতা দেওয়ার দায় নিয়েছেন যাঁরা, তাঁরা নিরন্তর বলে এসেছেন, এটাই নিম্নবর্গের ভাষা। এই নির্ঘোষ খুবই ভয়াবহ। নিম্নবর্গ মানেই চটুল সস্তা কথা, 'বিলো দ্য বেল্ট' আক্রমণ, অসংবেদনশীলতা- এমন প্রকরণ নির্মাণ যে সুস্থ সমাজের পক্ষে কত বড় অন্তরায়, তা কি তাঁরা ভেবেছেন? ভদ্রবিত্তকে আক্রমণের অছিলায় দুবৃত্তের ভাষাকে নীচুতলার ভাষা বলে দাগিয়ে দেওয়া আসলে অসংবেদন এবং অপরাধপ্রবণতাকেই প্রশ্রয় দেওয়া, একথা তাঁরা বোঝেননি বা বুঝতে চাননি  বলেই সুদে-মূলে বেড়েছে কু-কথা, প্রলাপ, দম্ভ। ভেঙেছে একের পর এক সীমা, বেএক্তিয়ার কথা বলা হয়ে গিয়েছে অবলীলায়। আর শেষমেশ মুখোশ খুলে যে মুখ বেরিয়ে পড়েছে, তাকে ঢাকা যাবে না কোনও চাদরে।

মুখ্যমন্ত্রী একদা আইন পড়েছেন বলে শোনা যায়। সেই ব্যক্তিই ১৮ বছরের কম বয়সি একটি মেয়েকে ধর্ষণের ঘটনার  প্রতিক্রিয়ায় 'লাভ অ্যাফেয়ার' জাতীয় শব্দবন্ধ এনে বুঝিয়ে দিলেন, পকসো আইন সম্পর্কে তাঁর ধারণাই নেই। বুঝিয়ে দিলেন ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স, অহরহ হিংসা-নির্যাতনের দিনলিপি সম্পর্কে তাঁর কোনও বোঝাপড়াই নেই। মনে তাই প্রশ্ন জাগে, বাংলা কি এমন অবিবেচক মেয়েকে চেয়েছিল, যে মেয়ে বোঝেন না, ভালবাসার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হলেও ধর্ষণ ধর্ষণই! এমনকী নাবালিকার সঙ্গে যৌনসম্পর্ক স্থাপন বিষয়টিও আইনগত ভাবে অপরাধ। মুখ্যমন্ত্রী যে স্রেফ ধর্ষণের অভিযোগের বিষয়টিকেই লঘু করে দিলেন তাই-ই নয়। ধর্ষণে অভিযুক্তও পক্ষান্তরে কিছুটা সুবিধে পেয়ে গেল। মুখ্যমন্ত্রীর এই মন্তব্য অবশ্য আমাদের সমাজের একাংশেরই ঝাঁকিদর্শন। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী তো স্রেফ একজন আমআদমি নন, রাজ্যের অভিভাবক হিসেবে তাঁর মন্তব্য আর পাঁচজনের চেয়ে বেশি ওজনদার। ফলে তাঁর দায়ও অনেক বেশি।

ধর্ষিতার প্রতি শাসকের উদাসীনতা এ-রাজ্য এই প্রথম দেখছে না। ১৯৯০ সালের ৩০ মে গোসাবা রাঙাবেড়িয়া থেকে ফেরার পথে বানতলা রোডে একদল দুষ্কৃতীর হাতে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের দুই মহিলা স্বাস্থ্য আধিকারিক ও একজন ইউনিসেফের আধিকারিক ধর্ষিতা হন। দুষ্কৃতীদের বাধা দিতে গিয়ে একজন আধিকারিক ও তাঁদের গাড়ির চালক নিহত হন। বিরোধী নেত্রী মমতা জোরালো প্রতিবাদ শানিয়েছিলেন সেদিন। ১৯৯৬ সালে এক ধর্ষিতা মূক-বধির কিশোরীকে নিয়ে রাইটার্স বিল্ডিংসে বিচার চাইতে গিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পুলিশ তাঁর চুলের মুঠি ধরে, লাথি মেরে, টেনেহিঁচড়ে বের করে দিয়েছিল৷ ২০০৩ সালে ধানতলায় মোট ৬ জনকে ধর্ষণ করা হয়। '৯০ সালে বানতলার সেই ঘটনার পর তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর প্রতিক্রিয়া চাওয়া হলে তিনি সপাটে বলেন, 'এরকম তো কত হয়েই থাকে!'

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি বাড়তি প্রত্যাশার কারণ এই যে, তিনি ক্ষমতায় এসেছেন এই সমস্ত ঘটনার প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে। অর্থাৎ, ধর্ষণের হিংসার বিপ্রতীপ অবস্থান তাঁর ভাবমূর্তি গড়ার পক্ষে সহায়ক হয়েছে। মহিলারাও তাঁকে দীর্ঘ এই লড়াইয়ের কারণে লিঙ্গ-সংবেদনশীল, লিঙ্গ নিরপেক্ষ ভেবেছেন। অন্য দিকে তিনিই কন্যাশ্রী-র মতো প্রকল্পের জন্মদাত্রী। লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের মতো পরিকল্পনার মাধ্যমে বহু মহিলার সুরাহার কথা ভেবেছেন। এই ধরনের প্রকল্প পুরুষ-মহিলা নির্বিশেষে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়েছে। কালিমা ঢাকা পড়ে অনুরাগ তৈরি হয়েছে। চড়চড় করে চড়েছে প্রত্যাশার পারদ। শাসকের কল্পতরু ভাবটা যে ভোটমুখী, আসলে অভিভাবকের জোব্বা পরা সব শাসকেরই মুখ একরকম, হিংস্র, অনুভূতিহীন- তা বুঝতে বোধহয় দেরি হয়ে গেল এই জন্যই। বোধসম্পন্ন, শিক্ষিত সুস্থ রুচির প্রতিটি পশ্চিমবঙ্গবাসীর জন্যই এই দিনটি গ্লানির, লজ্জার। 

মমতা অবশ্য এ কাণ্ড এই তৃতীয় দফাতেই প্রথম বার ঘটালেন, এমন নয়। অবধারিতভাবে মনে আসছে সুজেটের কথা। প্রথমবারের জন্য সরকার গড়েছেন তখন মমতা। বামেদের সরিয়ে ক্ষমতা দখলের ১১ মাসের মাথায়, ২০১২-র সেই রাতে পার্ক স্ট্রিটের একটি হোটেলের সামনে থেকে সুজেটকে গাড়িতে তোলে পাঁচ যুবক। চলন্ত গাড়িতে ধর্ষণ করে তাঁকে এক্সাইড মোড়ের কাছে ফেলে দেওয়া হয়। তিনদিন পরে পার্ক স্ট্রিট থানায় অভিযোগ জানালেও পুলিশ প্রথমে বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়নি। পরে বিষয়টি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হতেই নড়েচড়ে বসে লালবাজারের একাংশ।

মুখ্যমন্ত্রী একে ‘সাজানো ঘটনা’ বলেছিলেন। রাজ্য সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করতেই ঘটনাটি সাজানো হয়েছে বলেও মন্তব্য করেছিলেন তিনি। শুধু তাই নয়, এই ঘটনার প্রধান তদন্তকারী অফিসার দময়ন্তী সেনকে সেসময় বদলি করে দেওয়া হয়। মমতা জমানায় তেমন কোনো গুরুদায়িত্বই পাননি এই কৃতী অফিসার। পরিহাস এমনই, সেই দময়ন্তী সেনকেই রাজ্যের সাম্প্রতিক চারটি ধর্ষণ-কাণ্ডের তদন্তভার দিতে চাইছে হাই কোর্ট।

আরও পড়ুন-ঘুরে ঘুরে সাবান বিক্রি থেকে বারবার বিবাহবিচ্ছেদ: মহাশ্বেতা দেবীর জীবনে ছিল নানা চড়াই-উতরাই

এই দাঁত নখ বের করা আচরণে সাধারণ মানুষ দুঃখিত হয়েছে। কিন্তু ভোটবাক্সে তা জানান দেওয়ার কোনও রাস্তা ছিল না। রাস্তা আজও নেই। রাজ্যের একটা বড় অংশের মানুষ ভেবেছে, মমতা নির্বিকল্প। সেই কারণেই তিনি ক্ষমতায়। ক্ষমতাবান কিছু শিখবে না, মাথা নোয়াবে না, এমনটাই দস্তুর। ফলে এগারো বছর ক্ষমতায় থাকা মমতা অসংবেদনশীলতাতেও নির্বিকল্পই রয়ে গেলেন।

আমরা, পশ্চিমবঙ্গের আমজনতা তাঁর সমস্ত অবিবেচনার পরই বুদ্ধিজীবীরা কোথায়- এ প্রশ্নে কুম্ভীরাশ্রু বিসর্জন করি। লিঙ্গ-সচেতনতার পরিসর স্রেফ মগজ-কলম বন্ধক রাখা বুদ্ধিজীবীদের ওপর নির্ভর করে না। ভোট দেওয়া না-দেওয়ার আগে-পরেও নাগরিক সমাজের হাতে প্রতিবাদের সাংবিধানিক অধিকার থাকে, আমি তোমার অসংবেদনশীল আচরণকে ধিক্কার জানাই, একথা জানানোর নানা পথ খোলা থাকে, পথ খোলা থাকে প্রশ্ন করার। সচেতন মানুষ সেই অধিকারই প্রয়োগ করুন।

More Articles