বন্যা বিপর্যস্ত দক্ষিণবঙ্গে আরও বৃষ্টির আশঙ্কা! ‘ম্যানমেড বন্যা’ কেন বলছেন মমতা?

West Bengal Flood Situation: পুজোর আগে এই ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতির জন্য ডিভিসির বিরুদ্ধেই তোপ দেগেছেন মুখ্যমন্ত্রী। একে 'ম্যান মেড বন্যা' আখ্যা দিয়েছেন তিনি।

পুজোর আর এক মাসও দেরি নেই। এই সময় ভাসল দক্ষিণবঙ্গের বিস্তীর্ণ অংশ। কার্যত বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে মেদিনীপুরের পাঁশকুড়া, পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটাল, হুগলি, হাওড়া এবং বীরভূমের বহু এলাকা। গত কয়েকদিনের লাগাতার বৃষ্টি, তার উপর ডিভিসির ছাড়া জল। মুখ্যমন্ত্রী এই বন্যাকে ম্যানমেড বন্যা বলেই ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন। তোপ দেগেছেন ডিভিসি-কেও। বৃহস্পতিবারও নতুন করে জল ছেড়েছে ডিভিসি। ডিভিসির ওয়েবসাইট থেকে পাওয়া খবর অনুযায়ী, পাঞ্চেত-মাইথন থেকে প্রায় ৫০ হাজার কিউসেক জল ছাড়া হয়েছে নতুন করে। যা বিপাক আরও বাড়িয়েছে।

প্লাবন পরিস্থিতিতে চরম দুর্ভোগে পাঁশকুড়া, খানাকুল, হাওড়ার উদয়নারায়ণপুর-সহ একাধিক এলাকার বাসিন্দারা। গত কয়েক দিন টানা বৃষ্টি এবং ডিভিসির ছাড়া জলে ভাসছিল হুগলি। এখন বৃষ্টি থামলেও খানাকুলে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। গতকাল রাত পর্যন্ত বেড়েছে জলস্তর। পরিস্থিতি এমনই যে, খানাকুল থানার সামনে চলছে নৌকা। একই দৃশ্য খানাকুল বাসস্ট্যান্ডেও। সেখানেও নৌকা চলছে। খানাকুল ১ নম্বর ও ২ নম্বর বিডিও অফিস, পোস্ট অফিস, ভূমি দফতরের অফিস— সর্বত্র জল থইথই। ইতিমধ্যেই খানাকুলের এক ও দুই নম্বর বিডিও অফিসে জল ঢুকেছে। খানাকুল থানার সামনেও জমে রয়েছে জল। পানীয় জলের হাহাকার পড়েছে। ত্রাণ নিয়ে ক্ষোভ-বিক্ষোভ লেগেই রয়েছে তার মধ্যে। রূপনারায়ণ, দ্বারকেশ্বর ও মুন্ডেশ্বরীতে একাধিক বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছে গ্রামের পর গ্রাম। প্রায় ৭০ শতাংশ কৃষি জমি জলের তলায় চলে গিয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। একতলা বাড়ি পর্যন্ত জলের তলায় ডুবে। খানাকুল ও পুরশুড়ার গ্রামীণ হাসপাতালেও জল ঢুকেছে। মুখ্যমন্ত্রী বুধবার আরামবাগ মহকুমায় পা রেখেছিলেন। ডিভিসির জল ছাড়া নিয়ে সেখানেও ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। এলাকার প্রবীণেরা জানাচ্ছেন ৭৮ সালের বন্যাও এমন ভয়াবহ আকার ধারণ করেনি সম্ভবত।

আরও পড়ুন: কর্মবিরতি তুলে বন্যা কবলিত স্থানে জুনিয়র ডাক্তাররা! আন্দোলন এবার কোন পথে?

প্লাবিত হুগলির বলাগড়ও। অতিবৃষ্টি ও ডিভিসির ছাড়া জলে ভাসছে বলাগড়ের জিরাট পঞ্চায়েতের চর খয়রামারি এলাকা। জোয়ারের জলে আগেই প্লাবিত হয়েছিল চর খয়রামারির বিস্তীর্ণ এলাকা। সঙ্গে এখন বাঁধের ছাড়া জলে ফুঁসছে গঙ্গা। কালভার্ট ভেঙে গ্রামে ঢুকছে বন্যার জল। গৃহবন্দি প্রায় কয়েকশো মানুষ। ওই এলাকায় প্রায় আড়াইশো পরিবারের বসবাস। তার মধ্যে ৬০টি পরিবারকে ইতিমধ্যেই অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তাঁরা এখন রয়েছেন স্থানীয় আশুতোষ নগর প্রাইমারি বিদ্যালয়ের অস্থায়ী ত্রাণশিবিরে। বৃহস্পতিবার ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যান সদর মহকুমা শাসক স্মিতা সান্যাল শুক্লা এবং বলাগড়ের বিডিও সুপর্ণা বিশ্বাস। প্রশাসনের তরফে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, ওই কালভার্টের জায়গায় নতুন কাঠের সেতু নির্মাণ করা হবে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে ত্রাণশিবিরে আশ্রয় নেওয়া সকলের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। শুধু চর খয়রামারিই নয়, জল ঢুকতে শুরু করেছে বলাগড়ের শ্রীপুরের বাবুচর, সিজা কামালপুর পঞ্চায়েতের বানেশ্বরপুর, আশ্রমঘাট-সহ বেশ কয়েকটি এলাকাতেও। কোথাও ডুবেছে কৃষিজমি। ফলে চাষেও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ফসল নষ্ট হওয়ার আশঙ্কায় মাথায় হাত চাষিদের।

বন্যায় বিধ্বস্ত আমতা-উদয়নারায়ণপুরও। ডিভিসি’র ছাড়া জলেই এই ভয়াবহ বন্যা বলে মনে করা হচ্ছে। স্থানীয় সূত্রে খবর, সবমিলিয়ে দশটি গ্রাম পঞ্চায়েত জলমগ্ন। এই পঞ্চায়েতগুলির মধ্যে ১১২টি গ্রামে ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি। বন্যার কবলে হাজার হাজার গ্রামবাসী। এই পর্যন্ত ৪০ হাজার গ্রামবাসী গৃহহীন। তাঁদের উদ্ধার করে অস্থায়ী ত্রাণ শিবিরে নিয়ে আসা হচ্ছে। ইতিমধ্যে জোরকদমে উদ্ধার কাজ শুরু করেছে বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী। বন্যা ভয়াবহ রূপ নিলেও দামোদরের পশ্চিম পাড়ের বাঁধ মেরামতির ফলে আরও বড় বিপদ থেকে রক্ষা পেয়েছে উদয়নারায়নপুরবাসী। ডিভিসি’র ছাড়া জলে প্লাবিত হাওড়া জেলার আমতা ও উদয়নারায়ণপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল। গ্রামের ভেতর দিয়ে বইছে ১০ থেকে ১২ ফুট উচ্চতায় নদীর জল। নতুন করে পরিস্থিতি আরও উদ্বেগের জায়গায় পৌঁছেছে। জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, বন্যা কবলিত গ্রাম থেকে বাসিন্দাদের উদ্ধার করে উদয়নারায়ণপুরের ফ্লাড সেন্টারে নিয়ে আসা হচ্ছে। এখনও পর্যন্ত দুই হাজার বাসিন্দা ফ্লাড সেন্টারে ঠাঁই পেয়েছেন। বাকিদের দ্রুত উদ্ধার করে ত্রাণ শিবিরে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। বুধবার রাত পর্যন্ত প্রায় তিন লক্ষ মানুষ বন্যাপীড়িত। উদয়নারায়ণপুরে ৬৮টি ত্রাণশিবিরে প্রায় দশ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন ইতিমধ্যেই। তাঁদের পানীয় জল খাবার ও ওষুধ দেওয়া হয়েছে। উদয়নারায়ণপুর স্টেট জেনারেল হাসপাতাল, বাস স্ট্যান্ড থেকে শুরু করে ব্লক অফিস এবং উদয়নারায়নপুর কলেজ ক্যাম্পাস জলে থৈথৈ। বুধবার উদয়নারায়ণপুরে বন্যা পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে আসেন ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প দফতরের সচিব রাজেশ পাণ্ডে। সঙ্গে ছিলেন জেলাশাসক দীপাপ্রিয়া পি-সহ জেলা প্রশাসনের আধিকারিকেরা। ত্রাণ ব্যবস্থার তদারকিতে ছিলেন মন্ত্রী পুলক রায়।

পুজোর আগে এই ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতির জন্য ডিভিসির বিরুদ্ধেই তোপ দেগেছেন মুখ্যমন্ত্রী। একে 'ম্যান মেড বন্যা' আখ্যা দিয়ে বৃহস্পতিবার পূর্ব মেদিনীপুরের পাঁশকুড়ায় ক্ষোভপ্রকাশ করেন মমতা। তাঁর কথায়, 'ডিভিসি-র জলধারণ ক্ষমতা এখন মাত্র ৩৬ শতাংশ এসেছে। ডিভিসি-র জলে কেন বাংলা ডুববে? আমরা কৈফিয়ত চাই। ফরাক্কা ড্রেজিং করে না, বাংলা ডোবে, বিহার ডোবে। আর ডিভিসি ড্রেজিং করে না, বাংলা ডোবে। ঝাড়খণ্ডকে বাঁচানোর জন্য জল ছাড়া হয়। ডিভিসি-র সঙ্গে আর সম্পর্ক রাখব কিনা, ভেবে দেখব।' মুখ্যমন্ত্রী আরও বলেছেন, 'ডিভিসি কেন্দ্রীয় সরকারের সংস্থা। ৪ লক্ষ কিউসেক জল ছেড়েছে। যা কোনও দিন হয়নি। আমরা ৫ লক্ষ পুকুর কেটেছি, কপালেশ্বর কোলাঘাট প্রকল্পের মাধ্যমে অনেক এলাকাকে রক্ষা করেছি, ঘাটাল মাস্টারপ্ল্যান, যেটা পড়ে রয়েছে ১০ বছর ধরে, সেটাও আমরা বিপিআর তৈরি করছি। আগামী ২ বছরের মধ্যে করে দেব। কিন্তু তা সত্ত্বেও যদি এই রেটে জল ছাড়া হয়, তাহলে সমস্যা। আজ যে জায়গায় জল ঢুকেছে সেগুলি সকালেও শুকনো ছিল। এত বার বলার পরেও জল ছাড়া বন্ধ করছে না ডিভিসি।” ক্ষুব্ধ মুখ্যমন্ত্রী এই পরিস্থিতিতে আন্তঃরাজ্য সীমান্ত সিল করার নির্দেশ দিয়ে জানিয়েছেন , বাংলা-ঝাড়খণ্ড সীমান্ত তিন দিনের জন্য বন্ধ থাকবে।

আরও পড়ুন:লাগাতার বৃষ্টিতে ব্যাপক জল ছাড়ছে ডিভিসি, পুজোর আগেই ভাসবে দক্ষিণবঙ্গ?

এদিকে এই বন্যা পরিস্থিতিকে আরও আশঙ্কাজনক করে তুলেছে আবহাওয়া দফতরের সতর্কতা। হাওয়া অফিস জানিয়েছে, ২৩ সেপ্টেম্বর উত্তর-পশ্চিম এবং সংলগ্ন মধ্য বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপ তৈরি হতে পারে। যার প্রভাবে বৃষ্টি হতে পারে দক্ষিণের জেলাগুলিতে। আর তেমনটা হলে বন্যাপরিস্থিতি যে আরও জটিল হতে চলেছে, তাতে সন্দেহ নেই। এদিকে, বন্যা পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে আরজি করের ঘটনার ধর্নামঞ্চ থেকে সাময়িক বিরতি নেওয়ার কথা জানিয়েছেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। আরজি কর-সহ রাজ্যের তিনটি মেডিক্যাল কলেজের দল যাচ্ছে বন্যাবিধ্বস্ত এলাকাগুলিতে। জল, ওষুধ, শুকনো খাবার নিয়ে তৈরি জুনিয়র ডাক্তারেরা। শুক্রবারই বিভিন্ন জেলার উদ্দেশে রওনা দেওয়ার কথা তাঁদের। বন্যাকবলিত এলাকায় অভয়া ক্লিনিক ও ক্যাম্প করার কথাও জানিয়েছেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। দুর্গতদের পরিষেবা দেওয়া হবে। বৃহস্পতিবার রাতেই ধর্নামঞ্চ থেকেই সেই ঘোষণা করা হয়েছিল। যদিও আংশিক কর্মবিরতি চলবে বলেই জানানো হয়েছে। জরুরি পরিষেবায় তাঁরা শনিবার থেকে যোগ দেবেন বলে জানিয়েছেন।

আরজি করের ডাক্তার মৃত্যু নিয়ে এখনও উত্তাল রাজ্য। সামনেই পুজোর মাস। তার আগে যেভাবে ভয়ঙ্কর বন্যা পরিস্থিতি এসে উপস্থিত হয়েছে বাংলা জুড়ে, তাতে কপালে ভাঁজ প্রশাসনের। কী ভাবে এই পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাবে, এর উপর নতুন করে বৃষ্টি নামলেই বা কী হবে, সেই চিন্তাতেই আপাতত ঘুম উড়েছে রাজ্য সরকারের। এই পরিস্থিতিতে কেন্দ্রশাসিত দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশনের উপরেই একরকম ভাবে বিপর্যয়ের দায় ঠেলেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। জরুরি ভিত্তিতে বিভিন্ন জায়গায় বৈঠক শুরু করেছে জেলাপ্রশাসন। খোলা হয়েছে ২৪ ঘণ্টার কন্ট্রোল রুমও।

More Articles