হিন্দির বিরুদ্ধে, বাংলার পক্ষে রক্তঝরা আন্দোলন! যেভাবে জন্মেছিল পুরুলিয়া জেলা
Bengali Language Movement: সময়ের নিরিখে ইতিহাসের দীর্ঘতম ভাষা আন্দোলন মানভূমের মাতৃভাষা অধিকার আন্দোলন।
আমার বাংলা ভাষা প্রাণের ভাষা রে (ও ভাই) মারবি তোরা কে তারে! এই ভাষাতেই কাজ চলেছে সাত পুরুষের আমলে এই ভাষাতেই মায়ের কোলে মুখ ফুটেছে মা বলে!
-অরুণচন্দ্র ঘোষ
১৯০৫ সালের ১৯ জুলাই সরকারিভাবে বাংলা প্রেসিডেন্সি ভাগের বিজ্ঞপ্তি জারি করেন লর্ড কার্জন। ভাগ হয়ে যায় বাংলা। ঢাকা, রাজশাহি, চট্টগ্রাম, মালদহ পার্বত্য ত্রিপুরা ও অসমকে নিয়ে গঠিত হয় পূর্ববঙ্গ ও অসম, যার রাজধানী হয় ঢাকা। অবশিষ্ট বাংলা, বিহার উড়িষ্যাকে নিয়ে গঠিত হয় বাংলা প্রদেশ, যার রাজধানী হয় কলকাতা। ব্রিটিশ সরকারের এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে কলকাতা-সহ সংলগ্ন অঞ্চলের বাঙালি মধ্যবিত্ত ও সামন্তশ্রেণির একাংশ প্রতিবাদে উত্তাল হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কলমের মর্ম থেকে উঠে আসে, "বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু বাংলার ফল, পুণ্য হউক পুণ্য হউক পুণ্য হউক হে ভগবান।" রবীন্দ্রনাথের নেতৃত্বে পালিত হয় রাখিবন্ধন উৎসব, হিন্দু-মুসলিম বাঙালি জাতিসত্তা ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের বার্তা দেয়।
কিন্তু এত সবের পরেও একথা অস্বীকার করার জায়গা নেই যে, মূলত অর্থনৈতিক কারণেই পূর্ববঙ্গের তথাকথিত নিম্নবর্ণের মানুষ বঙ্গভঙ্গ রদের পক্ষে ছিলেন না। যাই হোক, অবশেষে ১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর দিল্লির দরবার উৎসবে ব্রিটিশ রাজা পঞ্চম জর্জ বাংলাভূমিকে ভাগের যে সিদ্ধান্ত সরকার নিয়েছিল, তা বাতিল করেন। কিন্তু একই দিনে তিনি এও ঘোষণা করেন, বাংলা প্রেসিডেন্সিকে দু'-ভাগে বিভাজন করে এক অংশ হবে পূর্ববঙ্গ, যার রাজধানী হবে কলকাতা এবং অপর অংশ হবে বিহার ও উড়িষ্যা প্রদেশ, যার রাজধানী হবে পাটনা। এবং এই বিহার-উড়িষ্যা প্রদেশের সঙ্গেই যুক্ত করে দেওয়া হয় বাংলাভাষী সমগ্র মানভূম ও ধলভূম অঞ্চলকে (৭০০০ বর্গকিমির অধিক অঞ্চল)। ইতিহাসে এই ঘটনাকে মহান বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলনের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে।
আরও পড়ুন: উগ্র হিন্দুত্বর বিরুদ্ধে জেহাদ! দলিত জাগরণের নেপথ্যের নায়ক পেরিয়ার
এখানে লক্ষণীয়, বাংলা ভাগ-বিরোধী কলকাতার তথাকথিত ভদ্রলোক শ্রেণি ব্রিটিশ সরকারের মানভূম, ধলভূমকে বিহারের সঙ্গে যুক্ত করার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করলেন না। ১৯১২-র এপ্রিল মাসে বাংলার নতুন সীমানা কার্যকর হলে মানভূম ও ধলভূমে এই অন্তর্ভুক্তির বিরুদ্ধে গণবিক্ষোভ শুরু হয়। কিন্তু স্বাধীনতা আন্দোলন অধিক গুরুত্বপূর্ণ, এই যুক্তি দিয়ে কংগ্রেসের বাবুশ্রেণির নেতারা এই আন্দোলনকে গুরুত্ব দেননি। যদিও কংগ্রেসের বিহার-নেতৃত্ব স্বীকার করে, "সমগ্র মানভূম জেলা এবং সিংভূম জেলার ধলভূম পরগনা বাংলাভাষী-অধ্যুষিত অঞ্চল, বাংলার সঙ্গেই তাদের সংযুক্ত করা উচিত।"
কংগ্রেসের এহেন ভূমিকা মানভূমের বাংলাভাষীদের দমাতে পারেনি। তারা গণস্বাক্ষর (Plebiscite) সংগ্রহ করে সরকারের কাছে মানভূম, ধলভূমের বঙ্গভুক্তির আবেদন জানালেন। ভাষা-বিদ্রোহীদের বক্তব্য ছিল, 'মানভূমের ভৌগোলিক ও জাতিগত অবস্থান ইতিহাস, ভাষা, আইনকানুন জমি ও শাসনব্যবস্থা সবকিছুই বঙ্গদেশের অনুরূপ'... তথাপি 'মানভূম ও ধলভূম অঞ্চল বাংলা সমতলভূমির সঙ্গে যুক্ত'। তাছাড়া জাতিগত এবং ভাষাগত পরিচয়ের দিক থেকে তারা বাঙালি, কাজেই তাদের বঙ্গদেশের অন্তর্ভুক্ত করা হোক। কিন্তু এই আন্দোলন আবেদন-নিবেদনের রাস্তা ধরায় ব্রিটিশ সরকার আন্দোলনকারীদের দাবিকে ততটা গুরুত্ব দেয়নি। এর আরেকটা কারণ ছিল, বারবার বিদ্রোহে শামিল হওয়া মানভূমের ওপর ব্রিটিশদের ক্রোধ ও হিংসাপরায়ণ মনোভাব ছিল মারাত্মকরকম।
১৯৩৫-এ 'ভারত শাসন আইন' কার্যকর হলে দ্বৈত-শাসন প্রণালী চালু হয় । ১৯৩৬-এ পৃথক উড়িষ্যা রাজ্য গঠিত হলেও মানভূমকে বিহারেই রেখে দেওয়া হয়। ড. রাজেন্দ্র প্রসাদের (১৮৮৪-১৯৬৩) নেতৃত্বে গড়ে ওঠে 'মানভূম বিহারি সমিতি'। তাঁদের আন্দোলনকে ভাঙার চক্রান্ত হচ্ছে বুঝে মানভূমের বাংলাভাষী নেতারা পাল্টা গড়ে তুললেন 'মানভূম বাঙালি সমিতি'। ১৯৩৭-এ বিহারে কংগ্রেস সরকার ক্ষমতায় আসে। কংগ্রেসের ধারণা ছিল, ভারতজুড়ে হিন্দি ভাষার প্রসার ঘটাতে পারলে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের বিস্তার ঘটবে। মানভূম বিহারি সমিতি হিন্দি স্কুল তৈরি করে হিন্দি ভাষার প্রচার শুরু করে। মানভূমের আদিবাসী, ভূমিজ-সহ সমস্ত বাংলাভাষীরাও পাল্টা বাংলা-স্কুল তৈরি করে হিন্দি ভাষা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। মানভূম বাঙালি সমিতি 'মুক্তি' নামে একটি মুখপত্র প্রকাশ করে। রাজ্যস্তরে তৈরি হয় 'বিহার বাঙালি সমিতি'। ক্ষিতিমোহন সেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মানভূমবাসীর এই ভাষা আন্দোলনকে সমর্থন জানান।
বিহারে কংগ্রেস সরকার তৈরি হলে বাংলাভাষীদের জন্য ডোমিসাইল শংসাপত্র দেখানো বাধ্যতামূলক করে। নাগরিক অধিকারে বৈষম্য-সৃষ্টিকারী এই আইন আদিবাসী ও বাঙালিদের প্রায় দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করে এবং বিভিন্ন সরকারি কাজে তাদের হিন্দিভাষীদের দ্বারা হেনস্তার স্বীকার হতে হয়। ১৯৩৮-এ কংগ্রেসের রঘুনাথপুর অধিবেশনে বাঙালি নেতৃত্ব মানভূমকে বঙ্গপ্রদেশে যুক্ত করার দাবি তোলে।
১৯৪৭-এর ১৫ অগাস্ট দেশভাগের মধ্য দিয়ে ভারত 'স্বাধীন' হয়। কলকাতার ভদ্রলোক শ্রেণি ও বাবু-নেতারা '৪৭-এর বাংলা ভাগের পক্ষে দাঁড়ান, কিন্তু পূর্ববঙ্গের মুসলমান ও নিম্নবর্ণের হিন্দুরা এই ভাগের পক্ষে ছিলেন না। অন্যদিকে মানভূমের অবস্থা হয় আরও খারাপ। মানভূম অঞ্চলের সমস্ত বাংলা-মাধ্যম স্কুল থেকে বাংলাভাষী পরিদর্শকদের সরিয়ে দেওয়া হয়। প্রতিটি স্কুলে হিন্দিতে স্কুলের নাম লেখা সাইনবোর্ড টাঙাতে হবে, এই মর্মে বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়। ১৯৪৮ থেকে মাধ্যমিক স্তরের সমস্ত বইপত্র বাংলায় ছাপা বন্ধ করে দেয় সরকারের শিক্ষাবিভাগ। আদিবাসী-সাঁওতাল ছেলেমেয়েরা, যাদের দ্বিতীয় ভাষা বাংলা, হঠাৎ করে হিন্দিতে পড়াশোনা চালাতে ব্যর্থ হয় এবং স্কুল ছাড়তে বাধ্য হয়। মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত পরীক্ষার খাতাপত্র হিন্দিতে লেখা না হলে সরকারি অনুমোদন স্থগিত অথবা বাতিল করে দেওয়া হতে থাকে। হিন্দিভাষী পরিদর্শকরা মানভূমের স্কুলগুলির পরিদর্শনে এসে স্কুলগুলিকে 'ভাটিখানা' এবং শিক্ষকদের 'অযোগ্য' ও 'মিথ্যেবাদী' বলে অপমান করতে থাকেন। হিন্দিতে কথা বলতে ও লিখতে না-পারা শিক্ষকদের তাঁরা অশিক্ষিত বলে হেনস্তা করতেন। বিহার সরকার শিক্ষকদের বাধ্যতামূলকভাবে হিন্দি শিখতে হবে, এই মর্মে ফতোয়া জারি করে। ৭২টি আদিবাসী স্কুলে হিন্দি ভাষায় পঠনপাঠন শুরু না হলে সরকারি অনুদান বন্ধ করে দেওয়া হবে বলে সার্কুলার পাঠানো হয়।
শুধু শিক্ষাক্ষেত্রই নয়, সরকারি বিভিন্ন দফতরে সমস্ত কাজ হিন্দিতে করতে বাধ্য করা শুরু হয়। সমস্ত আবেদনপত্র, দলিল-দস্তাবেজ এবং সরকারি আদেশ শুধুমাত্র হিন্দিতে লিখলেই গ্রাহ্য হবে বলে ফরমান জারি হয়। এমনকী, ঘোষণা করা হয়, ১৯ অগাস্ট, ১৯৪৮ থেকে বাংলায় লেখা জমির বা সম্পত্তির দলিল সরকারি দফতরে গৃহীত হবে না। মানভূমের মহকুমা শহর ধানবাদে বাংলা ভাষায় কথা বলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করাও সমস্যাজনক হয়ে ওঠে। বিহারিরা বাঙালিদের মানভূমে 'বহিরাগত' বলে অপপ্রচার চালাতে শুরু করেন। মানুষকে বিভ্রান্ত করতে তারা মানভূমের আদিভাষা 'খোট্টা ভাষা' বলে প্রচার চালান। আদিবাসী, ভূমিজ, মাহাতোদের ভাষিক পরিচয় বাংলা থেকে বের করে আনার চেষ্টাও করে বিহারি-সমিতি। একসময় পরিস্থিতি এমনই দাঁড়ায় যে, ভাষা আন্দোলনকারীরা বুঝতে পারেন, কংগ্রেসে থেকে ভাষা স্বাধিকারের দাবি অর্জন করা সম্ভব নয়। ১৯৪৮-এর ৩০ এপ্রিল মূলত এই কারণে কংগ্রেস ভেঙে তৈরি হয় 'লোকসেবক সংঘ' দল।
১৯৪৯-এ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শুরু হয় প্রবল প্রতিবাদ বিক্ষোভ। ১১ ফেব্রুয়ারি পুরুলিয়া শহরে ২৪ ঘণ্টার হরতাল ডাকে বাংলা-ভাষা সংগ্রামীরা। সমগ্র মহকুমায় প্রায় ৪০০০ ছাত্রছাত্রী হরতালে শামিল হয়। বিহার প্রশাসন নড়েচড়ে ওঠে, সাধারণ মানুষের ওপর নেমে আসে ভয়ানক নিপীড়ন। ১৯৪৯-এর এপ্রিল মাসে ভাষা-আন্দোলনকারীরা সত্যাগ্রহ শুরু করে। ১৯৫১ সালে বিহার সরকার হিন্দি ভাষাকে রাজ্যে বাধ্যতামূলক করতে বিজ্ঞপ্তি জারি করলে মানভূমের মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। মার্চ মাসজুড়ে লোকসেবক সংঘের নেতৃত্বে বাংলাভাষীরা মাসাধিকাল-ব্যাপী অনশন-সত্যাগ্রহ আন্দোলন শামিল হন। বহু জায়গায় পুলিশ এবং হিন্দি-মাসলম্যানরা আন্দোলনকারীদের ওপর সহিংস আক্রমণ নামিয়ে আনে।
১৯৫২-এর সাধারণ নির্বাচনে 'লোকসেবক সংঘ' দু'টি লোকসভা এবং ৭টি বিধানসভা আসনে জয় লাভ করে। লোকসভা আসনে জয়ী হন টুসু কবি ভজহরি মাহাতো। বিহারের হিন্দিবাদী নেতারা এরপর ষড়যন্ত্রের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেন। নানা মিথ্যে তথ্য দিয়ে তাঁরা 'মানভূম বিহারে থাকবে, বাংলায় যাবে না' এই মর্মে প্রচার চালাতে থাকেন। সাংসদ ভজহরি মাহাতো এই সময় লোকসভায় প্রথম ভাষণে বলেছিলেন, "আমি মানভূমের অধিবাসী, আমার ভাষা বাংলা, আমি ইংরেজি একেবারেই জানি না, হিন্দিও প্রায় জানি না... বিহার সরকার মানভূমের জনগণের ওপর যেভাবে উৎপীড়ন করিয়াছে, তাহাতে আমরা মানভূমবাসী ভারতীয় শাসন অধীনে যে-কোনও স্থানে থাকতে পারি, কিন্তু বিহার সরকারের শাসনাধীনে থাকিতে কখনই চাই না, আমরা মুক্তি চাই।"
মানভূম তার মাতৃভাষার মর্যাদা চাইছিল। ভাষার ভিত্তিতে রাজ্যগঠনের দাবি তুলছিল। বিহার বিধানসভায় শ্রীশ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, "বিহার সরকার প্রদেশের অ-হিন্দিভাষী জনগণের ভাষা-সংস্কৃতি নাগরিক অধিকার রক্ষার চেষ্টা করে নাই। সরকারের কঠোর দমননীতি, নগ্ন প্রাদেশিক বিদ্বেষ প্রচার ও হিন্দি সাম্রাজ্যবাদের অবাধ উৎপীড়ন চলিতেছে।" এভাবে লোকসভা, বিধানসভা দু'-জায়গাতেই বিহার সরকারের প্রকৃত স্বরূপ উন্মোচিত হয়। ১৯৫৪-তে মানভূমে মাতৃভাষা অধিকার রক্ষার দাবিতে শুরু হয় 'টুসু সত্যাগ্রহ'। একমাস ধরে চলা এই সত্যাগ্রহ এক জনজাগরণের রূপ নেয়। লোকগান, লোকনৃত্যে মাতৃভাষা বাংলাকে দমন করার চক্রান্তের কথা উঠে আসে। মুখে মুখে সেই গান ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। টুসুগানও বিহার সরকারের ঘুম কেড়ে নেয়। টুসুগান গাইলেই দলে দলে আন্দোলনকারীদের গ্রেফতার করা হয়। লোকসেবক সংঘের নেতা স্বাধীনতা সংগ্রামী অতুলচন্দ্র ঘোষকে গ্রেফতার করে সরকার। এই সময় ভজহরি মাহাতোর লেখা 'শুন বিহারী ভাই, তোরা রাখতে লারবি ডাঙ দেখাই, তোরা আপন তরে ভেদ বাড়ালি, বাংলা ভাষায় দিলি ছাই' মানভূমের বাংলাভাষীদের জাতীয় সংগীতে পরিণত হয়েছিল।"
এরপর বাংলা-বিহার সংযুক্তির প্রস্তাব আনেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় ও হিন্দিভাষী কংগ্রেস নেতা শ্রীকৃষ্ণ সিংহ। মানভূমবাসী বাংলা-বিহার সংযুক্তির তীব্র বিরোধিতা করে মিছিলে শামিল হয়। তারা অনুভব করে এই পরিকল্পনা বাস্তব রূপ পেলে বাংলা ভাষার অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। ২০ এপ্রিল, ১৯৫৬ মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদার দাবি নিয়ে পুরুলিয়ার পাকবিড়রা থেকে কলকাতার উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু করে ১০০৫ জন ভাষা-আন্দোলনকারী। দলে ছিলেন অসংখ্য নারী অ্যাক্টিভিস্ট। ৬ মে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার পথ পায়ে পায়ে অতিক্রম করে তাঁরা এসে পৌঁছন কলকাতায়। ডালহৌসি স্কোয়ারে পা রাখতেই তাঁদের গ্রেফতার করে বাংলার কংগ্রেস সরকার! দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়ার পরিশ্রমে অসুস্থও হয়ে পড়েন অনেকে।
মানভূমবাসীর এই ‘লং মার্চ’ ব্যর্থ হয়নি, ব্যর্থ হয়নি ইতিহাসের দীর্ঘতম ভাষা-স্বাধিকারের লড়াই। কলকাতাতেও মানভূম ভাষা আন্দোলনের সংহতিতে মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। ১২ দিন পরে মুক্ত হন আন্দোলনকারীরা। পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে একপ্রকার বাধ্য হয়েই বাংলা-বিহার সংযুক্তির প্রস্তাব রদ করে সরকার। দ্রুত পাশ হয় বঙ্গ-বিহার 'ভূমি হস্তান্তর আইন'। তারপর, সীমা কমিশনের রিপোর্টে সরকারি নানা স্তরের ফাঁস, ষড়যন্ত্র পেরিয়ে জন্ম নেয় পুরুলিয়া জেলা। দিনটা ছিল ১৯৫৬ সনের ১ নভেম্বর। মানভূমবাসীরা কয়েক দশক পরে আবার অন্তর্ভুক্ত হন পশ্চিমবঙ্গ বা বাংলায়। বাংলা ভাষায় কথা বলা, ভাবপ্রকাশ, শিক্ষালাভ- এককথায় বৃহৎ অর্থে জীবনচর্চার ভাষিক অধিকার পেলেন মানভূমবাসী। টুসু গান নিয়ে আবারও আনন্দে মাতোয়ারা হলেন তারা, ঠিক যেন মানভূমের স্বাধীনতা দিবস।
সময়ের নিরিখে ইতিহাসের দীর্ঘতম ভাষা আন্দোলন মানভূমের মাতৃভাষা অধিকার আন্দোলন। বাংলা ভাষাকে ঘিরে পরবর্তীকালে উত্তাল হয়েছে পূর্ববঙ্গ । জন্ম নিয়েছে বাংলাদেশ। বরাক উপত্যকায় প্রাণ দিয়েছেন ১১ জন বাংলা ভাষা আন্দোলনকারী। এইসবই মাতৃভাষায় জীবনযাপনের অধিকারের জন্য। মানভূম সেই ভাষা অধিকার সংগ্রামেরই এক আলোকোজ্জ্বল নাম। আজ যখন এক ভিন্ন বাস্তবতায় নিজের ঘরে ও বাইরে কোণঠাসা হচ্ছে বাংলা ভাষা, তখন এই আন্দোলনের শিক্ষা যেন ডাক পাঠাচ্ছে নতুন করে, নতুন প্রজন্মের কাছে। নিজের মাতৃভাষাকে ঘিরে নতুনভাবে বাঁচার ডাক, নিজের পরিচিতি ও সত্তাকে খুঁজে নেওয়ার ডাক, যে পরিচিতি হারিয়ে গেলে হারিয়ে যায় সমগ্র ভাষিক জীবন ও সংস্কৃতির কাঠামোটাই।
তথ্য সূত্র: মানভূমের ভাষা আন্দোলন ও পুরুলিয়ার বঙ্গভুক্তি: দিলীপকুমার গোস্বামী