ফোন-ইন্টারনেট স্থগিত, রাজ্য জুড়ে কার্ফু! কেন ফের অশান্ত মণিপুর?
Manipur: মণিপুরের পাঁচ জেলায় আগামী পাঁচ দিনের জন্য সমস্ত রকম মোবাইল ও ইন্টারনেট পরিষেবা নিষিদ্ধ করেছে রাজ্য সরকার। ইম্ফলের দুই জেলায় জারি কার্ফু।
ফের অশান্ত মণিপুর। প্রায় ১৬ মাস কেটে গেলেও শান্তি ফিরল না উত্তরপূর্বের এই ছোট্ট রাজ্যটিতে। সেপ্টেম্বরের গোড়া থেকেই ফের নতুন করে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে মণিপুর। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে, মণিপুরের পাঁচ জেলায় আগামী পাঁচ দিনের জন্য সমস্ত রকম মোবাইল ও ইন্টারনেট পরিষেবা নিষিদ্ধ করেছে রাজ্য সরকার। ইম্ফলের দুই জেলায় অনির্দিষ্টকালের জন্য জারি করা হয়েছে কারফিউ। বন্ধ স্কুল-কলেজ।
২০২৩ সালের মে মাস নাগাদ হঠাৎ করেই জাতিহিংসায় অশান্ত হয়ে উঠেছিল মণিপুর। মণিপুরের মেইতেই ও কুকি সম্প্রদায়ের অশান্তিতে প্রাণ যায় অন্তত দু'শো জনের। জখম হন অসংখ্য। এখনও পর্যন্ত সেই অশান্তির জেরে বাস্তুচ্যুত হন হাজার হাজার মানুষ। তাদের মধ্যে অধিকাংশেরই এখনও বাড়ি ফেরা হয়নি। মণিপুর জুড়ে এখনও অসংখ্য অস্থায়ী শিবির, যেখানে কোনও মতে মানুষ মাথা গুঁজে রয়েছেন। মণিপুর নিয়ে কেন্দ্র সরকারের ঔদাসিন্য় নিয়ে বারবার বিরোধীদের সমালোচনার মুখে পড়েছে মোদি সরকার। লোকসভা ভোটের অঙ্কে স্থানীয়দের সেই ক্ষোভ ভালো মতোই চোখে পড়েছে। যদিও ভোট আসতেই বিজেপি শিবির দাবি করেছে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তথা অমিত শাহের মন্ত্রকের হস্তক্ষেপে শান্তি ফিরেছে মণিপুরে। বারবার সেখানে নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন হয়েছে। তবে শান্তি এখনও দূরের দ্বীপ।
ছাই চাপা আগুনের মতোই অশান্তির আঁচটা ধিকি ধিকি করে জ্বলছিলই। কুকি আর মেইতেইদের অশান্তি যেন লেগেই রয়েছে ভিতরে ভিতরে। শোনা যাচ্ছে, দুই সম্প্রদায়ের কাছেই এখনও যথেষ্ট অস্ত্রশস্ত্র মজুত রয়েছে। এমনকী দুই সম্প্রদায়ই পাহাড় ও উপত্যকায় বাঙ্কার তৈরি করেছে। সেপ্টেম্বরের গোড়া থেকেই উত্তাপ বাড়তে থাকে উত্তর-পূর্বের এই রাজ্যে। গত এক সপ্তাহে একাধিক নাশকতার ঘটনা ঘটেছে মণিপুরে। প্রথমে ড্রোন হামলা, তার পরে ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে হামলা। স্বাভাবিক ভাবেই হঠাৎ করে এই নাশকতার এই জেগে ওঠা ঘুম কেড়েছে কেন্দ্রীয় বাহিনী। জঙ্গিদের খোঁজে দিন কয়েক ধরেই এলাকায় চিরুণি তল্লাশি শুরু করেছে মণিপুর পুলিশ ও কেন্দ্রীয় বাহিনী। সম্প্রতি ধ্বংসও করা হয় জঙ্গিদের তিনটি বাঙ্কার।
আরও পড়ুন: মণিপুরের বুকে এখনও জমাট চাপ চাপ অন্ধকার
এদিকে, এই পরিস্থিতিতে দোষারোপের ধারা রয়েছে অব্যহত। মেইতেইরা বলছে, কুকিরাই ওই ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে। কুকিরা পাল্টা ভিডিও প্রকাশ করে জানিয়েছে, মেইতেই সশস্ত্র বাহিনী আরাম্বাই টেঙ্গলের যোদ্ধাদের ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে মেইতেই এলাকায় আছড়ে পড়ে। এদিকে পুলিশ বলছে, ওই ক্ষেপণাস্ত্র স্থানীয় ভাবে তৈরি হলেও তা যথেষ্ট উন্নত প্রযুক্তির, যা ৩ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে আঘাত হানতে পারে। এই হামলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে নতুন করে উত্তেজনা শুরু হয়েছে মণিপুরে। মণিপুরের মেইতেই ও কুকি জনগোষ্ঠীর মধ্যে শুরু হয়েছে নতুন সংঘর্ষ। সম্প্রতি কংপোকপি এবং পশ্চিম ইম্ফলের দুটি জায়গায় ড্রোন হামলাকে কেন্দ্র করে আরও উত্তপ্ত হয় পরিস্থিতি। দুটি হামলাই অবশ্য হয়েছিল মেইতেই জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত এলাকায়। সেপ্টেম্বর মাসে এখনও পর্যন্ত আট জনের মৃত্যুর খবর মিলেছে।
এদিকে এই অশান্ত পরিস্থিতিতে রাজ্যের সর্বোচ্চ ক্ষমতা ফের নিজেদের হাতে রাখতে চাইছে বিজেপি-শাসিত মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী এন বিরেন সিংহ। সম্প্রতি নিজের সব বিধায়ককে সঙ্গে নিয়ে রাজ্যপাল লক্ষ্মণ আচার্যের সঙ্গে দেখা করেন তিনি। বিজেপি শাসিত সরকার কি তবে খোদ কেন্দ্রের উপরেই ভরসা রাখতে পারছে না আর? সূত্রের খবর, মুখ্যমন্ত্রী চাইছেন, রাজ্য সরকারের হাতেই থাক মণিপুরের দায়িত্ব। রবিবার বীরেন শাসক জোটের সব দলের সঙ্গে জরুরি বৈঠক করেন। তার পর বিধায়কদের নিয়ে রাজভবনে যান। সেখানেই রাজ্যপালের কাছে কিছু দাবি জানান।
এদিকের ইম্ফলে জারি করা কারফিউ অমান্য করে রাজধানীতে বিক্ষোভ দেখান হাজার খানেক পড়ুয়া। সোম ও মঙ্গল দু'দিনই চলছে বিক্ষোভ। ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলার বিরুদ্ধেই এই বিক্ষোভ। ছাত্রবিক্ষোভ দমাতে কাঁদানে গ্যাস ও গুলি ছোড়ে পুলিশ। তবে কার্যত বিক্ষোভ বশে আনা যায়নি। ইতিমধ্যেই রাজ্যপালের সঙ্গে গিয়ে দেখা করেছেন পড়ুয়ারাও। তাঁরাও তাঁদের ৬ দফা দাবি পেশ করে এসেছেন গিয়ে রাজ্যপালের কাছে। সূত্রের খবর, কেন্দ্র ও রাজ্য়ের সঙ্গে পড়ুয়াদের দাবির বিষয়ে আলোচনা করার আশ্বাস দিয়েছেন রাজ্যপাল। ইতিমধ্যেই পরিস্থিতি মোকাবিলায় আরও দুই ব্যাটেলিয়ন সিআরপিএফ পাঠিয়েছে কেন্দ্র। অতিরিক্ত ২০০০ সেনা মোতায়েন করা হচ্ছে হিংসাদীর্ণ মণিপুরে।
রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রকের তরফে নির্দেশিকা দিয়ে জানানো হয়েছে, উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে বন্ধ থাকবে সমস্ত সরকারি ও বেসরকারি কলেজ ও তার সহায়তাপ্রাপ্ত সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিও। মণিপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থগিত করা হয়েছে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর স্তরের সমস্ত পরীক্ষা কর্মসূচী। আর সরকারের এই পদক্ষেপ বিরাট ক্ষোভ তৈরি করেছে পড়ুয়ামহলে। জঙ্গিদের খোঁজে রাজ্য জুড়ে শুরু হয়েছে জোর তল্লাশি। সেনাবাহিনী, অসম রাইফেলস ও অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীরা বিভিন্ন জেলা জুড়ে যৌথ অভিযান শুরু করেছে। উদ্ধার হয়েছে প্রচুর পরিমাণে অস্ত্র ও গোলাবারুদ। এই জোড়া হামলার তদন্তভার সিবিআইয়ের হাতে হস্তান্তরিত করার কথা হলেছে রাজ্যপুলিশ। উদ্ধার হওয়া বোমার টুকরোগুলি ফরেন্সিক ল্যাবে পাঠানো হয়েছে ইতিমধ্যেই।
আরও পড়ুন: মণিপুর অসুস্থ, রোগের খোঁজ রাখে না ভারতবর্ষ
দীর্ঘদিন ধরেই তফসিলি উপজাতি বিভাগের অন্তর্ভুক্ত হতে চায় মেইতেইরা। যাতে আপত্তি কুকিদের। অন্য দিকে, কুকিরা চায় নিজেদের জন্য মণিপুর থেকে আলাদা একটি প্রশাসন। কার্যত মেইতেইদের সঙ্গে সম্পদ ও ক্ষমতার ভাগাভাগি একেবারেই পছন্দ নয় তাঁদের। সেখান থেকেই সমস্যার সূত্রেপাত। একদিকে, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যখন মণিপুরের শাসন রাজ্য়সরকারের হাতে রাখতে উদগ্রীব, রাজ্যপালের কাছে আবেদনও করেছেন তিনি, সেই সময়েই তলে তলে ইম্ফল থেকে পালানোর পরিকল্পনা আঁটছেন মণিপুরের রাজ্যপাল লক্ষ্মণ আচার্য। গুয়াহাটি পৌঁছনোর জন্য বিমানের টিকিটও কনফার্ম তাঁর। রাজ্যের যখন এই ভয়াবহ পরিস্থিতি, সে সময় কেন মণিপুর ছাড়তে চাইছেন রাজ্যপাল? সব মিলিয়ে ক্রমশ জটিল হচ্ছে মণিপুরে। কবে শান্তি ফিরবে হিংসাদীর্ণ রাজ্যটিতে। সে প্রশ্নের উত্তর অধরা এখনও।