একে একে একশো দিন, ইন্টারনেট নেই, মণিপুর যেমন আছে...

Manipur, Internet Ban: বহু ক্ষেত্রে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষের কণ্ঠও রোধ করা হচ্ছে ইন্টারনেট পরিষেবা ব্যবহারের সুযোগ না দিয়ে।

প্রায় তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে জ্বলছে মণিপুর। জাতিহিংসার নামে ছারখার আস্ত একটা রাজ্য। জ্বলছে বাড়ি, পুড়ছে ঘর। মেয়েদের বাড়ি থেকে বের করে এনে চলছে নির্বিচারে গণধর্ষণ। নগ্ন করে হাঁটানো হচ্ছে রাস্তায়। মর্গে জমছে শবদেহের পাহাড়। রাজ্য ছেড়ে প্রাণভয়ে পালাচ্ছেন বাসিন্দারা। প্রশাসন কী করছে? যা তারা করে থাকে সাধারণ ভাবে। যে কোনও অশান্তি, হিংসার পরিস্থিতি সামলানোর মোক্ষম অস্ত্র প্রশাসনের কাছে একটাই। ঠিকই বুঝেছেন, কার্ফু, ১৪৪ ধারা।

শীত এলে যেমন বসন্ত দূরে থাকতে পারে না, তেমনই কার্ফু এলে ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ না হলে পারে না। আর সেই নিয়ম মেনেই মণিপুরে বন্ধ ইন্টারনেট পরিষেবা। এই নিয়ে একশো দিনেরও বেশি সময় কেটে গিয়েছে। সমস্ত রকম আলোর থেকে দূরে উত্তর-পূর্বের ছোট্ট রাজ্যটি।

আরও পড়ুন: ভারতের ৭৬তম স্বাধীনতা দিবস! কিছুই কি বদলাবে মণিপুরে?

যে কোনও রকম হিংসা, উত্তেজনার পরিস্থিতিতে পুলিশ পৌঁছনোর আগে হাত পড়ে ইন্টারনেটের তারে। আর এ যেমন মণিপুরে ধ্রুব সত্য, তেমনই জম্মু-কাশ্মীরে কিংবা পশ্চিমবঙ্গের রিষড়া বা মুর্শিদাবাদের ক্ষেত্রেও একই রকম সত্য। কার্ফুর নামে নেটদুনিয়ার সমস্ত রকম আলো থেকে জম্মু-কাশ্মীরকে বঞ্চিত করা হয়ে এসেছে দীর্ঘ দিন ধরে। এবার পালা মণিপুরের।

মধ্যিখানে ইন্টারনেট সাময়িক ভাবে ফেরানোর নির্দেশ দিয়েছিল হাইকোর্ট। তারপর বিচ্ছিন্ন ভাবে রাজ্যের বেশ কিছু অংশে ফেরে ইন্টারনেট পরিষেবা। খাতায় কলমে ইন্টারনেট পরিষেবা ফিরলেও এত কম এলাকায় ফিরেছিল নেট পরিষেবা, তা যে তা নিয়ে যত কম কথা বলা যায় ততই ভালো।

সরকারের এ নিয়ে মাথাব্য়থা না থাকলেও বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে একাধিক মানবাধিকার সংগঠন। মণিপুরে ক্ষুন্ন হচ্ছে মানুষের মৌলিক অধিকারটুকুও। এমনই দাবি করেছে তাঁরা। সম্প্রতি ইন্টারনেট ফ্রিডম ফাউন্ডেশন এই মর্মে একটি বিবৃতিও জারি করেছে। তার পাল্টা দিয়েছে রিসার্চ অ্যান্ড অ্যাডভোকেসি অর্গানাইজেশনও। তাদের বর্কব্য, যাতে ভুয়ো খবর ছড়িয়ে হিংসা না-তৈরি হতে পারে, তার জন্যই বন্ধ করে রাখা হয়েছে নেটপরিষেবা।

তাদের দাবিকেও একেবারে অমূলক বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আমরা দেখেছি দিল্লির একটি মেয়ের শবদেহ ঘিরে ভুয়ো খবর ছড়িয়ে পড়েছিল মণিপুরে। সেই দেহটি মণিপুরের এক মেইতেই মেয়ের দেহ ভেবে প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলে উঠেছিল গোটা গ্রাম। নেটদুনিয়ায় ছড়িয়ে গিয়েছিল, ধর্ষণ করে খুন করা হয়েছিল মেয়েটিকে। তার বদলা নিতে কুকি মেয়েদের ঘর থেকে টেনে এনে চলে গণধর্ষণ, মারধর। পরে অবশ্য জানা যায়, সেই দেহটি আদতে এক দিল্লির কন্যার। সম্মান রক্ষার নামে পরিবারের হাতে প্রাণ গিয়েছিল যাঁর। কিন্তু ভাইরাল হওয়া ওই ছবিকে ঘিরে উত্তাল হয়ে উঠেছিল মণিপুর। ঝরে রক্ত, পড়ে লাশও।

আসলে নেটদুনিয়ার মাধ্যমে যেসব ছবি, বক্তব্য বা বিষয় আমাদের কাছে এসে পৌঁছয়, সেসব আমরা খতিয়ে দেখি না। তলিয়ে না দেখেই সেসব আমরা আরও কয়েকজনের কাছে পাঠিয়ে দিই, তাঁরা আরও কয়েকজনের কাছে। এভাবে ক্রমে সমগ্র সম্প্রোদায়ের কাছে পৌঁছে যায় একটা ভুয়ো ভুল তথ্য। যা এই ধরনের সঙ্কটজনক পরিস্থিতিতে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে।

তবে সেটা যেমন সত্যি, তেমনই সত্যি মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি। এখন আমরা এমন একটা সময়ে পৌঁছেছি, যেখানে পড়াশোনা, চাকরিবাকরির মতো বিভিন্ন জরুরি কাজেই ইন্টারনেট পরিষেবা একান্ত প্রয়োজনীয়। আর মণিপুরের মতো জায়গায় সেই সুবিধা তুলে নিয়ে আসলে সামাজিক ও বৌদ্ধিক বৃদ্ধিকে অনেকখানিই রুখে দেওয়া হচ্ছে, যাকে কোনও ভাবেই সমর্থন করা যায় না।

পাশাপাশি এ-ও এক কৌশল, যাতে মণিপুরের ভিতরে কী চলছে, সেই খবর এলাকার বাইরে না বেরোতে পারে। করোনা পরবর্তী বিশ্ব একান্ত ভাবেই নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে ইন্টারনেটের উপরে। ইন্টারনেট ছাড়া মোবাইল আজকের দিনে খেলনা ছাড়া কিছুই নয়। ফলে এই সময়ে বিভিন্ন রকম সাহায্য থেকেই বঞ্চিত হচ্ছেন বাসিন্দারা ইন্টারনেট পরিষেবার অভাবে। বহু ক্ষেত্রে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষের কণ্ঠও রোধ করা হচ্ছে ইন্টারনেট পরিষেবা ব্যবহারের সুযোগ না দিয়ে।

গত তিনমাসের হিংসায় ছারখার গোটা রাজ্যটাই। স্বাভাবিক ভাবেই বহু প্রয়োজনীয় সুযোগসুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন মানুষ। সে কথা বিশ্বের কাছে পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যম হতে পারত হয়তো নেটবিশ্ব। কিন্তু ইন্টারনেটের অভাবে সেই খবর বেরোচ্ছে না বাইরের দুনিয়ায়। আর তা পুরোপুরিই ডিজিটাল অধিকারের লঙ্ঘন বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞেরা।

আরও পড়ুন:  ‘ভারতমাতা খুন মণিপুরে’, কেন লোকসভায় সিংহগর্জন রাহুলের?

কিছু দিন আগে মণিপুরে কয়েকজন কুকি মহিলাকে নগ্ন করে প্যারেড করানোর অভিযোগ উঠেছিল। এভাবেই জাতিহিংসা, প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা হয়েছিল ছোট্ট রাজ্যটিতে। সেই ছবি ভাইরাল হয়ে গিয়েছিল নেটদুনিয়ায়। আর তাতেই টনক নড়েছিল সুপ্রিম কোর্টের। সুপ্রিম কোর্টের চাপের মুখে মুখ খুলতে বাধ্য হন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। শীর্ষ নেতৃত্বের ইশারা পেতেই মুখ খোলে রাজ্যের বিজেপি সরকার। দোষীদের শাস্তির আশ্বাস দেন মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিং। তিন মাসে প্রথম বার মণিপুর নিয়ে নড়চড়ে বসে দেশ। বিভিন্ন বিরোধী দলের নেতারা ছুটে যান মণিপুরে। গড়ে ওঠে বিক্ষোভ-প্রতিরোধ।

মৃতদেহ নিয়ে ভুয়ো খবর ছড়ানোটা যেমন সত্যি, তেমনই সত্যি নেটদুনিয়া মারফৎ গড়ে ওঠা এই বিক্ষোভ-প্রতিরোধও। কোন সত্যিটাকে নিয়ে মানুষ চলতে চাইবেন, সেটা আদতেই তাঁর নিজস্ব সিদ্ধান্ত। তবে মণিপুরে যে অবিলম্বে ইন্টারনেট পরিষেবা চালু হওয়া প্রয়োজন, তা নিয়ে দ্বিমত নেই মানবাধিকার সংগঠন ও ওয়াকিবহাল মহলের।

More Articles