মণিপুর: পাহাড়ে স্বায়ত্ত্বশাসনই কি একমাত্র রাজনৈতিক সমাধান?
Manipur violence 2023: রাজ্যের প্রায় ৬০% মানুষের এই উপত্যকা শহরাঞ্চলে বাস। মেইতেইদের দাবি, ভূমি সমস্যার সমাধান করতে পাহাড়ে জমি কেনার ব্যাপারে তাদের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে হবে।
জনবিন্যাস ও জনসংখ্যা নিয়ে একটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মিথ্যাচার সারা দেশজুড়ে চলছে। বর্তমান মণিপুর নিয়েও এরকম এক কাল্পনিক তথ্য টিভি থেকে সোশাল মিডিয়া সর্বত্রই প্রচার করা হচ্ছে। ইম্ফল পশ্চিমের নির্দল বিধায়ক নিশিকান্ত সিং সাপাম টিভি ক্যামেরায় সটান বলে দিলেন, "মণিপুরের কুকি জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার দেখুন, ১৯০১-এ মণিপুরের কুকি জনজাতির মানুষ জনসংখ্যার ১% ছিল, বর্তমানে তারা প্রায় ২৯%!" অনুষ্ঠানের সঞ্চালক করণ থাপার অবশ্য দাবিটির সত্যতা নিয়ে তৎক্ষণাতই প্রশ্ন তোলেন। বলাই বাহুল্য, নিশিকান্ত সাপাম মেইতেই জাতীয়তাবাদের ধারক ও এন বীরেন সিংয়ের বিজেপি সরকারের সমর্থক। নিশিকান্তের স্পষ্ট ইঙ্গিত প্রতিবেশি দেশ মায়ানমারের চিন প্রদেশ থেকে মণিপুরের পাহাড় অঞ্চলে আশ্রয় নিচ্ছেন বহু 'বেআইনি অনুপ্রবেশকারী'। ইতিহাস অবশ্য বলছে অন্য কথা। ১৯০১-এর আদমশুমারি অনুসারে, মণিপুরে কুকি জনসংখ্যা ছিল মোটের ১৪.৪%, আর শেষ ২০১১ জনগণনা অনুসারে উত্তরপূর্বের রাজ্যে কুকিরা মোট জনসংখ্যার ১৬.০২%। অর্থাৎ গত ১১০ বছর ধরে মণিপুরে কুকি জনসংখ্যা মাত্র দেড় শতাংশ বৃদ্বি পেয়েছে! যদি গত পাঁচ ছ-দশক ধরে বা বর্তমান গৃহযুদ্ধের জেরে মায়ানমার থেকে কিছু জনজাতি গোষ্ঠীর মানুষ সীমান্ত পেরিয়েও থাকে, তা মণিপুরের জনসখ্যার বিচারে নিতান্তই নগণ্য। ঠিক যেমন ভারতবর্ষে সংখ্যালঘু মুসলিমদের জনসংখ্যা নিয়ে ভুল তথ্য পরিবেশন করে নানা বিভ্রান্তি তৈরি করেন প্রধানমন্ত্রী সহ নানা বিজেপি নেতারা এবং তাদের স্পষ্ট ইঙ্গিত থাকে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের 'বেআইনী অনুপ্রবেশকারীদের' দিকে।
একথা ঠিক, মায়ানমারে সামরিক জুন্টার সঙ্গে চলমান গৃহযুদ্ধের জেরে সীমান্ত প্রদেশগুলো থেকে মণিপুর বা মিজোরামে ঢুকে পড়ছেন কিছু কুকি-জোমি জনজাতির মানুষ। মণিপুরের সঙ্গে মায়ানমারের প্রায় ৪০০ কিলোমিটার সীমান্তরেখা রয়েছে। সংখ্যাটা আগামীদিনে আরও বাড়তে পারে। তাই, মিজোরাম সরকার এদের আলাদা কার্ড দিয়ে সাময়িক আশ্রয়ের বন্দোবস্ত করেছে। সীমান্ত বরাবর মায়ানমারের চিন প্রদেশে এই কুকিদের চিন বলা হয়, আবার মিজোরামে এই কুকিরা মিজো বলে পরিচিত। মিজোরামে অনুপ্রবেশই যদি সমস্যা হতো, তাহলে মণিপুরও একই ব্যবস্থা করতে পারত। কিন্তু এন বীরেন সিংয়ের সরকার তার ধার কাছ দিয়েও হাঁটেনি। তার রাজ্যে পাহাড়ি জনজাতিদের সঙ্গে আসল সমস্যাটা জটিল ও দীর্ঘকালীন। এই মে মাস থেকে যে ক্রমাগত হিংসাত্মক ঘটনা ঘটে চলেছে, যার জেরে ইতিমধ্যেই বলি হয়েছেন কয়েকশো মানুষ (হতাহতের সংখ্যা ঠিক কত তা নির্দিষ্ট নয় কোনও সূত্রেই), ঘরবাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়ায় পালাতে বাধ্য হয়েছে কয়েক হাজার মণিপুরবাসী, তা এই দীর্ঘ সমস্যারই ফল। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ চারদিনের মণিপুর সফর করছেন পরিস্থিতি খুঁটিয়ে দেখতে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিংসার পূর্ণ তদন্তের জন্য বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠনের সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করেন, যার নেতৃত্বে থাকবেন একজন হাইকোর্টের প্রাক্তন মুখ্য বিচারপতি। দিল্লির সামরিক আধিকারিক অনিল চৌহান জানিয়েছেন, মণিপুরে কোনও সরকার কোনও অভ্যুত্থান দমন করছে না, বরং ওই রাজ্যে দুই জনগোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষই বর্তমান অশান্তির কারণ; যা মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিংয়ের বক্তব্যের সম্পূর্ণ বিপরীত। মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী সংবাদমাধ্যমের কাছে বারবার দাবি করে চলেছেন,নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে চল্লিশ জন কুকি জঙ্গি নিহত হয়েছে! কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উপস্থিতিতে নিহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ বাবদ দশ লক্ষ টাকা ও সরকারি চাকরির দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। কুকিসহ জনজাতিদের বিরুদ্ধে একের পর এক ঘৃণাভাষ্য দিয়ে রাজ্যে হিংসায় প্ররোচনা দেওয়া, চূড়ান্ত প্রশাসনিক ব্যর্থতা সহ একাধিক অভিযোগে অভিষুক্ত বীরেন সিং ও তার সরকার এখন শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করছেন।
আরও পড়ুন- কয়েকশো বছর আগেই লুকিয়েছিল হিংসার বীজ! মণিপুর আদৌ কোনওদিন শান্ত হবে?
জটিল জমি-কেন্দ্রিক সমস্যাই মূলে:
ইম্ফল উপত্যকা মণিপুরের মাত্র ১০% ভূমি জুড়ে বিস্তৃত। রাজ্যের বাকি ৯০% জমি মূলত পাহাড় ও জঙ্গলে, যা জনজাতি ও জঙ্গল আইনে সংরক্ষিত। উপত্যকার ইম্ফল শহরে পরিকাঠামো ও সুযোগ-সুবিধে উন্নত হওয়ায় এই অঞ্চল ঘন জনবসতি পূর্ণ। সংখ্যাগুরু মেইতেইরা এখানে দীর্ঘদিন ধরে বসবাসকারী ও প্রভাবশালী। মেডিকাল কলেজ, ইঞ্জিনিয়রিং কলেজ, হাসপাতাল, সরকারি অফিস সবই এই অঞ্চলে হওয়ায়, পাহাড় থেকে বহু জনজাতির মানুষও বর্তমানে এই অঞ্চলের বাসিন্দা। রাজ্যের প্রায় ৬০% মানুষের এই উপত্যকা শহরাঞ্চলে বাস। মেইতেইদের দাবি, ভূমি সমস্যার সমাধান করতে পাহাড়ে জমি কেনার ব্যাপারে তাদের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে হবে। এই কারণেই তারা তপশিলি উপজাতি বা জনজাতির আওতাভুক্ত হওয়ার দাবি নিয়ে আদালতে যায়। মণিপুর হাইকোর্টও রায় দিয়ে সরকারকে নির্দেশ দেয় মেইতেইদের তপশিলি উপজাতির আওতাভুক্ত করার জন্য। যদিও ইতিমধ্যেই তারা ওবিসি ও তপশিলি জাতির আওতাভুক্ত। আদালতের এই রায় পাহাড়ে জনজাতিদের মধ্যে প্রবল ক্ষোভ ও নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করে। তাদের মতে, এই তকমার সুযোগে ধনী মেইতেইরা পাহাড়ে জমি কিনতে শুরু করবে। ইতিমধ্যেই মরেহ-র মতো মায়ানমার সীমান্তবর্তী শহরে বেনামে জমি কিনে বসবাস করছে বহু মেইতেই পরিবার। জনজাতি ছাত্র সংগঠনগুলি এর প্রতিবাদে একটি শান্তিপূর্ণ মিছিলের আয়োজন করে মেইতেইদের জনজাতির আওতাভুক্ত করার বিরুদ্ধে। কিন্তু সাংস্কৃতিক সংগঠনের নামে সাম্প্রতিক গজিয়ে ওঠা আরামবাগ তেঙ্গল নামক মেইতেই জাতীয়তাবাদী সংগঠনের কর্মীরা ওই মিছিলের ওপর চড়াও হন। এরপরই অশান্তির আগুন ছড়িয়ে পড়তে থাকে গোটা উত্তরপূর্ব রাজ্য জুড়ে।
পাহাড় ও উপত্যকাকে ঘিরে এই জমি সমস্যা দীর্ঘদিনের, তা কেন্দ্র করে মেইতেই ও পাহাড়ি জনজাতিদের সংঘাতও। অপরদিকে কুকি গণমোর্চার নেতা উইলসন এন হ্যাঙসিঙের বক্তব্যও ঠিক। পাহাড়ে রাজ্যের ৯০% ভূমি হলেও, তার ৯০% বাসযোগ্য নয়, অধিকাংশই চাষজমি, জঙ্গল সংরক্ষণ আইন ও অন্যান্য প্রাকৃতিক কারণেও সবটা আবাসযোগ্য নয়। তাই মেইতেইরা 'ভূমিপুত্র' হওয়া সত্ত্বেও বৃহৎ ভূমির অধিকার থেকে বঞ্চিত, এই তত্ত্বকে মান্যতা দেওয়া কঠিন। উপত্যকায় প্রায় ষাট শতাংশ জনসংখ্যার বসবাসের কারণ মূলত উন্নয়নের অসাম্য। পাহাড় অঞ্চলে সেভাবে পরিকাঠামোগত উন্নয়ন না হওয়ায় বহু কুকি-জোমি-নাগা ছাত্রছাত্রী ও চাকরিজীবী ইম্ফলে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন।
কিন্তু ৩ মে-র রাতের পর থেকে রাজ্যের জনবিন্যাস সম্পূর্ণ বদলে যেতে শুরু করে। কুকিরা উপত্যকা ছেড়ে, ও মেইতেইরা পাহাড় ছেড়ে পালাতে শুরু করেন। এমনকী ইম্ফলে এন বীরেন সিং ক্যাবিনটের এক কুকি মন্ত্রীর বাড়িও আগুনে ভস্মীভূত হয়ে যায়। পাহাড়ের পাদদেশে ৩২ টি কুকি গ্রাম জ্বালিয়ে দেয় মেইতেই জাতীতাবাদীরা, আংশিক বা পুরোপুরি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় ২৯৩ টি গির্জা। প্রায় একমাস ধরে এই সংঘর্ষ চলার পর বর্তমানে মেইতেই ও কুকিরা ভৌগোলিকভাবে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। পারস্পরিক অবিশ্বাস চরমে। এই পরিস্থিতিতে দশজন কুকি বিধায়ক (যার সাতজন বিজেপি), অমিত শাহের সঙ্গে দেখা করে অবিলম্বে রাষ্ট্রপতি শাসনের দাবি করেছেন। এছাড়াও কুকি বিধায়কদের কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে দাবি, পাহাড়ে স্বায়ত্তশাসন ঘোষণা করা হোক, যা আলাদা রাজ্য, কেন্দ্রীয় শাসিত অঞ্চল বা বিশেষ স্বায়ত্তশাসন ক্ষমতাসহ পার্বত্য পরিষদের মাধ্যমে করা সম্ভব। এর আগে পার্বত্য পরিষদ বিল বিধানসভায় আলোচনার জন্য আনেনি এন বীরেনের সরকার।
বিভাজন রেখে ধরে আরএসএসের সক্রিয়তা:
দেশের উত্তর পূর্ব অঞ্চলে বাজপেয়ী সরকারের আমল থেকে প্রায় দু’দশকের উপর প্রবল সক্রিয় সঙ্ঘ পরিবার। আঞ্চলিক বিভাজনের রেখাগুলিকে উস্কে দিয়ে যার ফসল নির্বাচনী রাজনীতিতে ষোলআনা তুলতে সক্ষম হয়েছে গৈরিক শিবির। বর্তমানে উত্তর পূর্বের সাতটি রাজ্যের ছ’টিতেই ক্ষমতায় এনডিএ শিবির। তাদের হাতে না থাকা একমাত্র খ্রিস্টান-প্রধান রাজ্য মিজোরামের শাসকদল মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্টও কেন্দ্রের এনডিএ সরকারের সমর্থক। এই রাজ্যগুলোয় জনজাতিগুলি খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী। আরএসএস আঞ্চলিক হিন্দু ও লোকজ ধর্ম বিশ্বাসীদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছে, খ্রিস্ট ধর্মালম্বী জনজাতিদের বাড়বাড়ন্তে তারা নিজরাজ্যে কোণঠাসা হয়ে পড়ছেন। মেঘালয়, মিজোরাম ও নাগাল্যান্ডে খ্রিস্ট ধর্মালম্বী জনজাতিরা সংখ্যাগুরু হওয়ায় সেভাবে সমস্যা হয়নি। কিন্তু মণিপুরের মেইতেইরা মূলত বৈষ্ণব ও কুকি-হমার-নাগা-জোমিরা খ্রিস্টান এবং হিন্দু-খ্রিস্টান দু'পক্ষর জনসংখ্যাই ৪১%র আশেপাশে। তাই সাম্প্রদায়িক তাস এখানের জাতিগত মেরুকরণ আরও তীব্র করেছে। আবার কুকিদের বিরুদ্ধে এই চক্রান্তে আরেক পাহাড়ি জনজাতি নাগাদের কাছে পেতে তাদের উপর কোনও আক্রমণ হানা হয়নি। বারবার স্মরণ করানো হচ্ছে, নব্বই দশকের মাঝামাঝি কুকি-নাগা গোষ্ঠী সংঘর্ষে নিহতের সংখ্যার কথা; যদিও সাম্প্রতিক অতীতে এই দুই গোষ্ঠীর বিবাদের কোনও খবর নেই। রাজ্যের জনসংখ্যার প্রায় ২৬% নাগা এবং তাদের বসতি মূলত পাহাড়ের উপরের দিকের জেলাগুলিতে। মণিপুরের কুকি গণমোর্চার নেতৃত্বও কেন্দ্রের এনডিএ সরকারের ঘোর সমর্থক, তাদের বিরোধ শুধু রাজ্যের বীরেন সিং সরকারের সঙ্গে, যাকে তারা মনে করছেন মেইতেই-জাতীয়তাবাদী সরকার। মণিপুরের কুকি নেতাদের অতীতের রাজনীতি পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, তারা ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে থাকাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন; সে কংগ্রেস হোক বা বিজেপি। এবার কুকি নেতারা হয়তো ভেবেছিলেন, পার্বত্য পরিষদ বিল পাশ করতে হয়তো কেন্দ্রের বিজেপি তাদের সহায়তা করবে কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। আরামবাই তেঙ্গোল বা মেইতেই লিপনের মতো মিলিশিয়ার গড়ে তুলে, রাষ্ট্রীয় মদতে কুকিদের ওপর এই আক্রমণকে 'এথনিক ক্লিনজিং' বা জাতিগত নির্মূলের ছক হিসেবে দেখছে বিভিন্ন রাজনৈতিক মহল।
রাজনৈতিক সমাধান ও ভবিষ্যত প্রসঙ্গে:
দীর্ঘকালীন এই সংঘাতের রাজনৈতিক সমাধান কীভাবে সম্ভব? কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আগামী ১৫ দিন শান্তি বজায় রাখার আবেদন জানিয়েছেন। জেএনইউয়ের আইন ও সরকারি নীতি বিভাগের অধ্যাপক থঙ্খোলাল হাওকিপের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি জানান, “পরিকল্পিতভাবে কুকিদের ওপর এই আক্রমণ শানানো হয়েছে। মার্চের শুরুতেও জনজাতি সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে একটি মিছিল সংগঠিত হয়, জনজাতি বস্তি-উচ্ছেদের বিরুদ্ধে। কিন্তু তখন কোনও আক্রমণের ঘটনা হয়নি। কারণ রাজ্যে তখন আফস্পা জারি ছিল। এরপর ২৪ মার্চ আফস্পা হঠাৎ তুলে নেওয়া হয়। আরাম্বাই তেঙ্গোলের মতো সংগঠিত মেইতেই মিলিশিয়া গত একবছরে তৈরি হয়েছে। পুলিশের সাহায্যে থানা থেকে অস্ত্র লুঠ করে একের পর এক কুকি গ্রাম ধ্বংস করা হয়। ব্রিটিশদের সঙ্গে কুকিদের যুদ্ধের ইতিহাস ভুলিয়ে দিয়ে, বেআইনি অনুপ্রবেশকারী সহ নানা অপপ্রচার চালিয়ে, কুকি সম্প্রদায়ের উপর 'এথনিক ক্লিনজিং'- এর প্রয়াস চালানো হয়েছে।” গত শতাব্দীর শুরুর দিকে অ্যাংলো-কুকি যুদ্ধ নিয়ে বিস্তারিত লেখালেখি করেছেন অধ্যাপক হাওকিপ। যেমন কেন্দ্রের এনডিএ সরকার টিপু সুলতানের নেতৃত্বে ব্রিটিশ-বিরোধী যুদ্ধের ইতিহাসকে মুছে ফেলার চেষ্টা করে, ঠিক একই কায়দায় কুকিদের ইংরেজ-বিরোধী লড়াইয়ের ইতিহাস ভুলিয়ে দিতে চাইছে বর্তমান মণিপুর সরকার।
আরও পড়ুন- দেশদ্রোহ গেলেও থাকছে ইউএপিএ, আসলে কি শাক দিয়ে মাছ ঢাকা হচ্ছে?
এই পরিস্থিতিতে কুকিদের পক্ষে মণিপুর আর নিরাপদ কি? হাওকিপের মতে, “রাজ্য সরকারের উপর ন্যূনতম আস্থা নেই কুকিদের। তারা অবিলম্বে রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করার দাবি জানিয়েছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে। তবে সমস্যার সমাধান করতে এর সঙ্গে রাজনৈতিক সমাধানও জরুরি, যা নিহিত রয়েছে পাহাড়ে পৃথক প্রশাসন বা স্বায়ত্তশাসন ক্ষমতার মধ্যে। আলাদা রাজ্য, কেন্দ্রীয় শাসিত অঞ্চল বা অন্য কোনও মডেল, যেমন জেলা-কাউন্সিলের মাধ্যমে এই পৃথক শাসন সম্ভব। পুরোটাই নির্ভর করছে কেন্দ্রের সঙ্গে চূড়ান্ত আলোচনার ওপর। একমাত্র পৃথক প্রশাসন দিয়েই জনজাতিদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত হতে পারে। গত একমাসের ঘটনার পর আর আগের রাজ্য প্রশাসন মডেলে সহবাস সম্ভব নয়!”
হাওকিপের এই বক্তব্য নিয়ে অবশ্য রাজনৈতিক দ্বিমত রয়েছে। সিপিএমের মণিপুর রাজ্য কমিটির সম্পাদক ক্ষেত্রিমায়ুম সান্তা পৃথক প্রশাসনের পক্ষে নন। তাঁর মতে, “এটা রাজ্যকে বিভাজনের দিকে নিয়ে যাবে, তাতে বিজেপি’র মেরুকরণ নীতিই কার্যকরী হবে; আমরা তা চাই না। কেন্দ্রের হস্তক্ষেপে রাজ্যে শান্তি ও শৃঙ্খলা ফেরানো, সমস্ত ঘরছাড়াদের সগৃহে ফিরিয়ে আনা ও যথাযথ ক্ষতিপূরণ দেওয়া, আমাদের মূল দাবি।” বিভিন্ন মহল থেকে পৃথক প্রশাসনকে পাহাড়ের জনজাতিদের রক্ষকবচ হিসেবে দেখানো হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে সান্তার বক্তব্য, “পাহাড়ে আমরা নতুন ভূমি-আইন প্রতিষ্ঠার পক্ষে। অর্থাৎ জনজাতির কৃষকদের চাষজমির পাট্টা দেওয়াই এক্ষেত্রে সমাধান সূত্র। তবে কৃষকরা সেই দাবি সমর্থন করলেও কুকি গোষ্ঠীনেতারা তা চান না। বর্তমান সংঘাত জাতিগত সংঘর্ষের চেহারা নেওয়ায় কৃষকদের ওপর গোষ্ঠীনেতাদের প্রভাব রয়েছে।” তবে সিপিএম নেতা মেনে নিলেন, রাজ্য তথা উত্তরপূর্ব অঞ্চলে আরএসএসের মদতে দাঙ্গা ছড়ানোর কথা, “বীরেশ শর্মা নামক এক স্থানীয় আরএসএস নেতার সক্রিয়তায় একাধিক কুকি গ্রামে আক্রমণ চালানো হয়, ঘরবাড়ি জ্বালানো হয়।” কুকি সহ বিভিন্ন জনজাতির মানুষদের বেআইনি অনুপ্রবেশকারী বলে প্রচার চালানোর জন্য রাজ্যের বিজেপি সরকারের সমালোচনা করে বাম নেতার ব্যাখ্যা, “আজ যখন অমিত শাহ আমাদের সমস্ত রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক করেন তখন আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করি, মায়ানমারের গৃহযুদ্ধ নিয়ে ভারত সরকারের নির্দিষ্ট কোনও নীতি আছি কিনা। তিনি কোনও জবাব দিতে পারেননি! গৃহযুদ্ধ দীর্ঘায়িত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেওয়া সত্ত্বেও কোনও মায়ানমার নীতি এখনও প্রণয়ন করেনি কেন্দ্রের এনডিএ সরকার; তাই অনুপ্রবেশ নিয়ে রাজ্য সরকারের কোনও বক্তব্য থাকতে পারে না।” আগামী লোকসভা ভোটে মণিপুরে কংগ্রেস, সিপিআই ও জনতা দল ইউনাইটেডের সঙ্গে জোট করে বিজেপিকে ঠেকানোর কৌশল নিচ্ছে সিপিএম।
মীরাবাই চানু, মেরি কম সহ রাজ্যের একাধিক আন্তর্জাতিক স্তরের ক্রীড়াবিদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে লিখিতভাবে জানান, অবিলম্বে কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপে যদি রাজ্যে শান্তি না ফেরানো হয়, তাহলে তারা তাদের যাবতীয় পদক ফিরিয়ে দেবেন। কুকি নেতা-নাগরিক সমাজ অনড় স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে। এই পরিস্থিতিতে সংখ্যাগুরুবাদী কেন্দ্রের এনডিএ সরকার রাজ্য বিভাজনের দিকে ঝোঁকে কিনা সেটাই দেখার। আগামীদিনে উত্তরপূর্বের রাজ্যগুলোর জন্য তবে কি অপেক্ষা করে রয়েছে আরও অশান্তির আগুন, পরিকল্পিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা আর সামাজিক ভাঙন?