জঙ্গলমহলে নতুন করে মাওবাদী সক্রিয়তা?
তৃতীয়বার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার এক বছর পূর্ণ হতে চলেছে। তার আগে বাজেট পেশ করতে গিয়ে জঙ্গলমহলের প্রসঙ্গ উঠে এসেছিল মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখে। গর্বিত কণ্ঠে জানিয়েছিলেন, ২০১১ থেকে ২০২২, দীর্ঘ ১১ বছরে জঙ্গলমহলে হিংসা এখন বিস্মৃতপ্রায় শব্দ হয়ে উঠেছে। ছুটকোছাটকা কিছু ঘটনাকে বাদ দিলে মুখ্যমন্ত্রীর এই দাবির সঙ্গে সেভাবে দ্বিমত পোষণ করতে দেখা যায়নি কাউকেই। কিন্তু মার্চ পেরিয়ে এপ্রিল আসতে না আসতেই হিংসার সম্ভাবনা জোরালো হতে শুরু করেছে জঙ্গলমহলের জেলাগুলিতে। আর তার সঙ্গেই আতঙ্ক ছড়াতে শুরু করেছে রাজ্যের অন্যত্রও। নেপথ্যে পর পর কিছু ঘটনা, যা জঙ্গলমহলে মাওবাদীদের পুনরুত্থানের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
বিগত ১১ বছরে জঙ্গলমহলের ইতিউতি মাওবাদী নামাঙ্কিত পোস্টারের উদয় হয়েছে একাধিকবার। কিন্তু সম্প্রতি মাওবাদীদের ডাকা বন্ধ এবং তার আগে ও পরের ঘটনাক্রম উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনুন্নয়ন, দুর্নীতি, এবং মাওবাদীদের মূল স্রোতে ফেরানোর চাবিকাঠি হিসেবে ব্যবহৃত হোমগার্ডের চাকরিতে নিয়োগ-সংক্রান্ত অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে গত ৮ এপ্রিল বন্ধ ডাকা হয়। পুস্তিকা এবং পোস্টার ছাপিয়ে এমন বন্ধ ডাকার রেওয়াজ বহুদিনের। কিন্তু তাতে প্রায় সর্বাত্মক সাড়া মেলার যে ছবি সামনে এসেছে, তাতেই দুশ্চিন্তার মেঘ ঘনাতে শুরু করেছে। কারণ এক সময় অনুন্নয়নকে হাতিয়ার করেই জঙ্গলমহলে শক্তিবৃদ্ধি করেছিলেন মাওবাদীরা। তাঁদের ডাকা বন্ধকে সমর্থন করে জঙ্গলমহলের মানুষ সরকার বিরোধী অবস্থানেই সিলোমহর দিলেন বলে শুরু হয়েছে কানাঘুষো।
আরও পড়ুন-ভারত পাকিস্তানের চেয়ে ভাল, কেন মনে করছেন ইমরান খান?
এর বিরুদ্ধে যদিও নানা মত, যুক্তি উঠে আসছে। জঙ্গলমহলের উন্নয়নকে সামনে রেখে সেই বিরোধিতার সুরকে খারিজ করে দিতে চাইছেন কেউ কেউ। যুক্তি হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে, রাস্তাঘাটের উন্নয়ন, বিনামূল্যের রেশন, মহিলাদের আত্মনির্ভরতার প্রতি রাজ্য সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প এবং প্রতিশ্রুতিকে। কিন্তু তা একেবারেই যথেষ্ট নয়, বরং নামমাত্র উপঢৌকন, এমনটা জানাতে দ্বিধা করছেন না জঙ্গলমহলের বাসিন্দারাই। ক্ষোভের কারণ জানতে চাইলে সটান জানিয়ে দিচ্ছেন, বিনা পয়সার রেশন এবং মেয়েদের হাতে ৫০০-১০০০ টাকা তুলে দিলেই দায়মুক্ত হওয়া যায় না। বরং সব ক্ষেত্রে সমান অধিকার, সুযোগ-সুবিধা এবং নিরাপদ ভবিষ্যৎ সুনিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। খয়রাতি করে মানুষকে প্রাপ্য অধিকার থেকে অল্পে বঞ্চিত করে রাখা কখনও সুশাসন হতে পারে না বলে প্রকাশ্যেই ক্ষোভ উগরে দিচ্ছেন অনেকে।
২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনের আগেই বিনামূল্যে রেশন দেওয়ার ঘোষণা করেছিল রাজ্য সরকার। পরবর্তীতে সেই বিনামূল্যের রেশন উন্নীত হয় ‘দুয়ারে রেশন’-এ। কিন্তু রেশন তুলতে দোকানে যেতে না হলেই মানুষ হাতে চাঁদ পাবেন, এমন তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চেয়ে সরকার আসলে দায় এড়াচ্ছে বলেই অনুযোগের সুর শোনা যাচ্ছে জঙ্গলমহলের বাসিন্দাদের মধ্যে। তাই প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন তাঁরা, বিনামূল্যের রেশন না হয় পাওয়া গেল, সটান বাড়ির দোরগোড়াতেই না হয় চলে এল চাল। কিন্তু তার সঙ্গে খাওয়ার আলু জুটবে কোথা থেকে? ১০০ দিনের কাজ পেতে যেখানে বছর ঘুরে যাচ্ছে, সেখানে ৫০০-১০০০ টাকায় একটি পরিবারের চলবে কেমন করে, প্রশ্ন তুলছেন অনেকেই।
আর জঙ্গলমহলের সাধারণ মানুষের এই মন্তব্যের সঙ্গেই অতর্কিতে আবির্ভূত হওয়া মাওবাদী পোস্টারের ভাষার মিল খুঁজে পাচ্ছেন অনেকে। হোমগার্ডের চাকরি দিয়ে মাওবাদীদের মূলস্রোতে ফেরানোর নীতি নিয়েই চলে এসেছে রাজ্য সরকার। কিন্তু সেই হোমগার্ডের চাকরিতে ব্যাপক দুর্নীতি হচ্ছে বলে অভিযোগ তোলা হয়েছে মাওবাদী পোস্টারে। কোথাও নিয়োগের ক্ষেত্রে নিয়োগের সঠিক মাপকাঠি ধরে এগনো হচ্ছে না বলে অভিযোগ তোলা হয়েছে তাতে, কোথাও আবার জঙ্গল ফিরে পাওয়ার দাবি তোলা হয়েছে। বন্ধ পালন না করলে রক্ত ঝরবে, গুলি চলবে এবং ‘খেলা’ ঘুরে যাবে, এমন বাক্যের ব্যবহারও চোখে পড়েছে কোনও কোনও পোস্টারে। দেউচা পাঁচামিতে প্রস্তাবিত কয়লাখনির বিরুদ্ধে আদিবাসী আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়েও সামনে এসেছে পোস্টার। কোথাও আবার সরাসরি পোস্টারে কিষেণজি-র উল্লেখ রয়েছে। বন্ধের আগের দিন একটি ল্যান্ডমাইনও উদ্ধার হয় সারেঙ্গায়।
তাতে কাজও হয়েছে। অতীতের ভয়াবহতাকে স্মরণ করে দোকানপাট বন্ধ রেখে বন্ধ পালন করতে দেখা গিয়েছে জঙ্গলমহলের বাসিন্দাদের। বন্ধের দিন শুনশান থেকেছে ঝাড়গ্রাম, পশ্চিম মেদিনীপুরের বিস্তীর্ণ এলাকায়। বেলপাহাড়ি, লালগড়, বারিকুল, গড়বেতা, শালবনি, গোয়ালতোড়ে বন্ধের প্রভাব ছিল চোখে পড়ার মতো। বাঁকুড়ার রায়পুর-সারেঙ্গা, রানিবাঁধ এলাকায় যান চলাচল এবং দোকানপাট সম্পূর্ণ বন্ধ ছিল। বন্ধ মিটে যাওয়ার পরও সম্প্রতি পুরুলিয়ার ঝালদায় মাওবাদী পোস্টার সামনে আসে। তাতে সরাসরি তৃণমূল পরিচালিত ঝালদা পুরসভার চেয়ারম্যান সুরেশ আগরওয়ালকে নিশানা করা হয়।অবাঙালি চেয়ারম্যান থাকা চলবে না বলে সাফ লেখা হয় তাতে। সূত্রের খবর, মাওবাদী নেতা আকাশ এবং অজয় জঙ্গলমহলে নতুন করে সক্রিয় হয়েছেন। সেখানে সংগঠন বৃদ্ধির চেষ্টা চালাচ্ছেন তাঁরা। তাঁদের অনুগামীরাই এসব ঘটাচ্ছেন।
শুরুতে বিষয়টিকে গুরুত্ব দেননি জঙ্গলমহলে শাসকদলের নেতৃত্ব। মাওবাদীদের নাম করে আসলে বিরোধী শিবিরের লোকজন এমন পোস্টার লাগাচ্ছেন বলে দাবি করেন তাঁরা। বিজেপি ইচ্ছাকৃতভাবে জঙ্গলমহলের পরিস্থিতি তাতিয়ে তুলছে বলেও দাবি করা হয়। কিন্তু আড়ালে-আবডালে কিছু যে ঘটছে, তা টের পাওয়া যাচ্ছে শাসকদলের নেতাদের আচরণে। একের পর এক তৃণমূল নেতা নিরাপত্তা চেয়ে পুলিশের দ্বারস্থ হচ্ছেন। রানিবাঁধের পাঁচ তৃণমূল নেতা বাঁকুড়ার পুলিশ সুপারের দফতরে ব্যক্তিগত দেহরক্ষী চেয়ে লিখিত আবেদন জানিয়েছেন। বাঁকুড়া জেলা পরিষদের সদস্য চিত্তরঞ্জন মাহাতো তাঁর দেহরক্ষীর সংখ্যা বাড়ানোর আর্জি জানিয়েছিলেন ঢের আগেই। একে একে আরও অনেকে পুলিশি নিরাপত্তার দাবি নিয়ে থানায় হাজির হচ্ছেন।
সেই নিয়ে শাসক দলকে কটাক্ষ করেছে বিজেপি। সরকারি প্রকল্পে কাটমানি খাওয়াতেই তৃণমূল নেতাদের মাওবাদী আতঙ্ক তাড়া করে বেড়াচ্ছে বলে দাবি করে তারা। কিন্তু তৃণমূল নেতাদের এমন আর্তি আসলে আসন্ন বিপদের প্রস্তুতি বলেও মনে করছেন অনেকে। তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্ব যদি বিষয়টিকে তেমন আমল দিতে নারাজ। কিন্তু বিপদ আঁচ করে পুলিশ প্রশাসনের অন্দরে আগাম প্রস্তুতি চলছে। জঙ্গলমহলের জেলাগুলিতে মাওবাদীদের সক্রিয়তা নিয়ে ইতিমধ্যেই রাজ্য সরকারকে সতর্ক করেছেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা। তাতে জঙ্গলমহল জুড়ে ১৫ দিনের জন্য চূড়ান্ত সতর্কতা জারি হয়েছে। পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে অস্থিরতা তৈরি হতে পারে আশঙ্কা করে ল্যান্ডমাইন প্রতিরোধী গাড়ি ‘বজ্র’ নামানো হয়েছে, যাতে অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতে স্বয়ংক্রিয় বন্দুক, রবার বুলেট ছোড়ার বন্দুক, মাইকিং এবং সার্চলাইট প্রযুক্তি বসানো গাড়িটি কাজে লাগে।
এছাড়াও, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বেশ কিছু নেতাকে সতর্ক থাকতে বলেছে পুলিশ। বেশি রাত পর্যন্ত একা ঘোরাঘুরি না করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি যাঁরা নিরাপত্তারক্ষী পান, তাঁদের হঠাত্ করে রক্ষীদের ছেড়ে দেওয়া বা ছুটি না দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে পুলিশ। বারিকুলের মাঝগেড়িয়া জঙ্গলের মধ্যে চলছে নজরদারি। জঙ্গলের মধ্যে পেট্রলিং, ইনসাস হাতে জঙ্গলের মধ্যে নজরদারি স্ট্র্যোকো বাহিনীর। চলছে নাকা-তল্লাশিও। ঝাড়খণ্ড সীমানায় চলছে কড়া নজরদারি।জঙ্গলমহলজুড়ে জারি হয়েছে লাল সতর্কতা। বাঁকুড়া এবং পুরুলিয়ায় পুলিশ কর্তাদের সঙ্গে ইতিমধ্যেই বৈঠক করেছেন ডিজিপি মনোজ মালব্য। সূত্রের খবর, ছুটিও বাতিল করা হয়েছে পুলিশকর্মীদের। তাতেই জঙ্গলমহলে মাওবাদীরা নতুন করে সক্রিয় হয়ে উঠছে বলে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।