বাজারের আলো, ভাগাড়ের অন্ধকার! যে জীবন দেখায় 'মায়ার জঞ্জাল'
Mayar Jonjal Movie Review: যে অভিনেতাদের সঙ্গে নিয়েছেন ইন্দ্রনীল, তাঁরা সকলেই এই চরিত্রে, জীবনছবিতে মিশে গেছেন।
'কেন লিখি?'-তে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, ছোটগল্প লেখার এক আশ্চর্য রোমাঞ্চ আছে। সেই রোমাঞ্চ কীভাবে বেড়ে ওঠে জীবনের আলোবাতাসে, তা পাঠকের সঞ্চয়। একইভাবে, সেই ছোট ছোট দুঃখ, ছোট ব্যথার জীবন আসলে যে মহাকাব্যিক ব্যপ্তি নিয়ে অপেক্ষা করে, তা যদি চলচ্চিত্রভাষায় ছড়িয়ে পড়ে, তবেই ছবি দেখার তৃপ্তি, সিনেমার জাদুঘরের ছোঁয়া।
ইন্দ্রনীল রায়চৌধুরীর ছবির জন্য আমাদের অপেক্ষা থাকে। আমরা ভালবেসে চেয়ে থাকি তাঁর ফ্রেমের দিকে, অস্বস্তি নিয়ে চাই তাঁর আখ্যান ও চলচ্চিত্র সম্পাদনার শরীরে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'বিষাক্ত প্রেম' ও 'সুবালা' নিয়ে তাঁর ছবি 'মায়ার জঞ্জাল'। এই ছবির নামের সঙ্গে ঘর করা যায়। এই ছবির আলো-অন্ধকার, কালার থেকে কাটাকুটি, অভিনয় থেকে চিত্রনাট্যের সমতা, নির্মাণ সবকিছুই বিহ্বল করে রেখেছে। চাঁদুর রাগ, গ্রহদোষ কাটার নিশ্চিন্ত রাতঘুম রয়েছে এই ছবির শরীরে, রয়েছে সোমার স্বপ্ন, যা বড়লোকের ফ্রাইং প্যানে কাবাবের মতো ভাসিয়ে রাখে সমুদ্রের বুকে সংসার-আকাঙ্খার স্মৃতিকে, লাফিং ক্লাবের হাহাহিহিহোহো-র মাঝে সেই স্বপ্নের জাল বোনে সত্যি হাসি, যা এক লহমায় ব্যঙ্গের শিকার হয়। সত্যর না-বলা প্রেম রয়েছে, যা ঈর্ষায়-লোভে মাখামাখি হয়ে পৌঁছে যাবেই হিংসায়, রয়েছে বিউটির হাততালিতে জ্বলে ওঠা মায়া-আলো, তার তলায় চাপা পড়ে থাকা আঁধার-জঞ্জাল। যে বাবুটি ওই আলোর ঝিকিমিকি দেখে বলে উঠল, 'আইশ্ শালা', সে আসলে আলোর বিস্ময়ে চাপা দেয় সেই ভয়ের অন্ধকারকেই। গণশা মাছের গন্ধের মাঝে মহাভারতের অন্য শুরুর কথা ভাবে। সে খুঁজে নেয় প্রাচীন গাড়িতে শতাব্দী পেরনো এক অন্য জীবন, যে জীবন হয়তো সাধকের, যে জীবন ফড়িংয়ের দোয়েলের। খিটখিটে সুধাময় তার বয়সের শেষাংশে দাঁড়িয়ে গুলিয়ে ফেলে নৈতিকতার পেন্ডুলামের চলন, স্টিফেন হকিংয়ের ধ্বংসবার্তাকে সে বিশ্বাস করে কি? লেবুদার পরিচ্ছন্নতা-বোধ আর নির্লিপ্ত অপরাধী মনের সংঘর্ষ, পেলে-র পাপপুণ্যের ঊর্ধ্বে ওঠা যাপনচিন্তাকে পড়তে অসুবিধে হবে কি ভদ্রবিত্তর? এই দ্বান্দ্বিক বাস্তবের মধ্যেই হেঁটে যাবে সেই জঞ্জালকুড়ুনি, ভোরের রাস্তায়, একটু একটু করে আবর্জনার গাদা থেকে কুড়িয়ে নেবে মায়া।
যে অভিনেতাদের সঙ্গে নিয়েছেন ইন্দ্রনীল, তাঁরা সকলেই এই চরিত্রে, জীবনছবিতে মিশে গেছেন। ঋত্বিক চক্রবর্তী আসলে জানেন, কীভাবে কাঁদলে, কীভাবে তাকালে, কতটা আস্তে কথা শুরু করলে, কতটা চোখ নামালে অভিনয় সুরেলা হয়। অভিনয়ে কখনও মালকোশ, কখনও বা ভৈরবী স্পষ্ট হয়। যখন বিস্ময়ের সঙ্গে মেশাচ্ছেন রাগ, যখন জ্যোতিষীর সামনে বিশ্বাসকে অবিশ্বাস ও বৈষয়িক বুদ্ধির মাঝে খেলিয়ে দিচ্ছেন, কে বলবে, ওই প্রায় না-অভিনয়ের মধ্যে লুকিয়ে এক গোপন, গম্ভীর সাংগীতিক চলন। ছেলের খাওয়ার দিকে চেয়ে থাকার মধ্যে লেগে থাকে অভাবীর আশ্চর্য ফ্যান্টাসি। অপি করিম প্রতিপলে একটু একটু করে গড়েন সোমাকে, তাকে স্বপ্ন দেখান, তাকে কর্কশ করেন, তাকে ভেঙে ফেলেন, আবার ছেলের খাওয়ার দিকে তারও উৎসুক চেয়ে থাকা। 'আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে'-র প্রশান্তি কী দৃশ্যমান সেখানে! গণেশ তো মাতৃস্নেহে দ্রব হওয়া জ্বর-দুপুরের হারিয়ে যাওয়া বোঝে। অন্য সময়রেখায় ছিল তার মায়ের মতো কেউ, সেই সময়কে সে বারবার পিছু ডাকে। মা কালীর সামনে 'দেখো মা' বলার আকুতি তার চেয়ে আলাদা। দীর্ঘশ্বাস ও হাহাকারের মাঝে জীবনের জলে যখন ভাল মাছ ওঠে, গণেশ হাসে। ব্রাত্য বসু সেই হাসির ব্যাকরণ জানেন। ব্রাত্য বোঝেন, শূন্য দৃষ্টিতে অপার যন্ত্রণা কীভাবে তিলে তিলে ভাঙে দর্শকের ভেতরকে। তাঁকে দেখে মায়ার হদিশ পাওয়া যায়, তাঁর অভিনয়েই আবার সেই মায়ায় নিহিত জঞ্জালের আনত সহবাস।
আরও পড়ুন- ‘বল্লভপুরের রূপকথা’ ফিরিয়ে আনল বাংলা সিনেমার হারিয়ে যাওয়া ‘ভূত’
চান্দ্রেয়ী ঘোষ একফোঁটা উচ্চারণে বারবার ধরেছেন ছিন্নমূল, বিক্রি হয়ে যাওয়া সেই মেয়েটিকে। 'একদিন প্রতিদিন' দেখে মৃণাল সেনকে সেই যে মেয়েটি বলেছিল, আমি কিন্তু ফিরতে পারিনি, জানেন! বলে হেসে উঠেছিল। সেই মেয়েটির হাসি বিউটির সমস্ত অভিনয়ের কোশে ঝলমল করেছে। পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায় আবেগকে বর্জন করে অনুভূতির সাত সুর ধরতে জানেন। তিনি জানেন, এক রঙের অভিনয়ের ক্যানভাসেই থাকতে পারে চরিত্রের রামধনু। সোহেল মণ্ডল ততটাই সজল ও শুষ্ক, যাতে 'কলকেতার তলায়' থাকা ছেলেটাকে চেনা যায়। শাঁওলী চট্টোপাধ্যায় অল্প পরিসরে কী অসম্ভব স্বচ্ছ! মাঝে মাঝে এক-একটি দৃশ্যে এসে যে চমক দিয়েছেন অমিত সাহা ও দীপক হালদার, তা অভাবনীয়! যে অভিনয়ের দিকে চেয়ে থাকা যায়, ইদানীন্তনের বাংলা ছবিতে সেই অভিনয়কে ফিরিয়ে এনেছেন এই ছবির সব অভিনেতা। ইন্দ্রনীল রায়চৌধুরী ও সুগত সিনহার চিত্রনাট্য, এই অভিনয়ে, ইন্দ্রনীল মুখোপাধ্যায়ের নির্মম ক্যামেরায়, সুমিত ঘোষের নির্মোহ সম্পাদনায় এক অন্য উচ্চতা পেয়েছে, যেখানে শুধুই 'স্বাভাবিক' সংলাপ, 'স্বাভাবিকতাবাদী' অভিনয় নেই, যেখানে সিনেমা রয়েছে তার যাবতীয় মহত্ত্ব নিয়ে, তার যাবতীয় আনোখা চমক নিয়ে। কোনও ফাঁকিবাজিকে সিনেমা বলে চালানোর চালবাজি ইন্দ্রনীল রায়চৌধুরীর ছবির কোথাও নেই।
যে ব্যান্ডপার্টিকে আমরা ফিরে যেতে দেখি ভোরাই শহরে, জমকদার পোশাকে পায়ের নিচে স্যাক্সোফোন রেখে ঘুমিয়ে পড়ে যে বাজনদার, অন্ধ সাজা যে ভিখিরির বুকে ঝোলা গামছার তলায় তারস্বরে বাজে ঈশ্বরের গান, যে শিশুটি অভ্র কুড়িয়ে আনন্দ পায় হিরে আবিষ্কারের- আমাদের মায়া তারাই, আমাদের জঞ্জাল তারাই। তারা কোথাও পৌঁছয় না। তাদের স্বপ্নভঙ্গের কাব্য লেখা হয় অন্য সুরে। ব্রাত্য বসুর 'দর্জিপাড়ার মর্জিনারা' নাটকে নট শেষে এক গল্প বলে। কৃষ্ণনগরের ঘূর্ণির যে কারিগর কাঁচা পুতুল একশোগুণ বেশি দামেও বেচতে রাজি হয় না, তার গল্প। তার উল্টোদিকে এই শহরের বাজার, এই নাগরিক বিকিকিনি। 'মায়ার জঞ্জাল' এই বিক্রিবাটার জীবনকে চেনায়, চেনায় আমাদের ঝুটো আলোকে।