দশমীর সঙ্গে কেন জুড়ে রয়েছে 'বিজয়া'? বিজয়া দশমীর অজানা সব কাহিনি...
Bijaya Dashami 2022: যুদ্ধের পর কার সিঁথিতে সিঁদুর থাকবে আর কার সিঁথিতে সিঁদুর থাকবে না তার নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না। সেই কারণেই এই বিশেষ দিনে ক্ষত্রিয়দের স্ত্রীরা নিজেদের মধ্যে সিঁদুর খেলায় মেতে উঠতেন।
আজ দশমী। সকলের মনেই বিষাদের ছায়া। গত এক মাস ধরে যে উত্সবের প্রস্তুতি চলছিল, তার অবসান আজ। ‘পুজো আসছে’ এই অপেক্ষাটাই সেরা, পুজো এলেই তা কেমন চোখের নিমেষে হুট্ করে চলে যায়। বাপের বাড়িতে দশ দিন কাটিয়ে আজ শ্বশুর বাড়িতে ফিরছেন উমা। নিয়ম মেনে মহালয়া থেকে শুরু করে মহাষষ্ঠীতে বোধনের পর মহাসপ্তমী, মহাষ্টমী, মহানবমী পেরিয়ে আজ দুর্গাপুজো পদার্পণ করল মহাদশমী তিথিতে। বাঙালির সবচেয়ে বড় উৎসবের সমাপ্তি এই দিনেই হয়। দশমী মানেই দুর্গার কৈলাসে ফেরার পালা। আশ্বিন মাসের শুক্ল পক্ষের দশমী তিথিতে দেবী দুর্গা বা উমা শ্বশুরবাড়ি কৈলাসে পাড়ি দেন।
কিন্তু হাজারো মন খারাপের মাঝেও হাসিমুখে সিঁদুর খেলা ও মিষ্টিমুখের মাধ্যমে মহা আড়ম্বরে দুর্গাকে শ্বশুরবাড়ি পাঠাতে ব্যস্ত আপামর বাঙালি। মায়ের আগমনের জন্যে ফের একবছরের অপেক্ষা। স্বভাবতই মন খারাপ সকলের। সকলেই জানি, দুর্গাপুজোর এই শেষ দিনটিকে দশমী বা বিজয়া দশমী বলা হয়ে থাকে। কিন্তু দশমীকে ‘বিজয়া’ দশমী কেন বলা হয় ? আজ সেটিই জানার চেষ্টা করব আমরা।
দশমীর আগে যে ‘বিজয়া’ শব্দটির বসানো হয় সেই শব্দটির সম্পর্ক রয়েছে বিজয়ের সঙ্গে- পাপের উপর পুণ্যের বিজয়, অধর্মের উপর ধর্মের বিজয়, অসত্যের উপর সত্যের বিজয়, অশুভ শক্তির উপর শুভ শক্তির বিজয়। তবে এর প্রকৃত তাৎপর্য জানতে গেলে জানতে হবে বেশ কয়েকটি পৌরাণিক কাহিনি। পুরাণে কথিত আছে, মহিষাসুর নামক এক অসুর সুদীর্ঘকাল ব্রহ্মার আরাধনা করেন। অবশেষে ভক্তের ভক্তিতে তুষ্ট হয়ে তাঁকে দেখা দেন ব্রহ্মা। ব্রহ্মা তাঁকে বর দিয়েছিলেন যে, কোনও পুরুষ তাঁকে হত্যা করতে পারবেন না। এরপর প্রবল ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠেন মহিষাসুর। ক্রমে স্বর্গ, মর্ত্য, পাতাল দখল করেন তিনি। এমনকী দেবরাজ ইন্দ্রকেও স্বর্গচ্যুত করেন মহিষাসুর। তবে মহিষাসুর ভুলে গিয়েছিলেন যে, তাঁকে কোনও নারী বধ করতে পারবে না, এমন বর দেওয়া হয়নি। এবার মহিষাসুরকে পরাস্ত করতে একসঙ্গে মিলিত হলেন সব দেবতা। তাঁদের সম্মীলিত শক্তি থেকে আবির্ভূত হলেন দেবী দুর্গা। পুরাণে মহিষাসুর বধ কাহিনিতে লেখা রয়েছে, মহিষাসুরের সঙ্গে ৯ দিন ৯ রাত্রি যুদ্ধ করার পর দশম দিনে তাঁর বিরুদ্ধে জয়লাভ করেন দুর্গা। অশুভ শক্তির উপর শুভ শক্তির এই জয়লাভকেই 'বিজয়া' বলে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। আবার পুরাণে এও উল্লিখিত আছে যে, দেবী আবির্ভূত হন আশ্বিন মাসের কৃষ্ণাচতুর্দশীতে। মহিষাসুর বধ করেন শুক্লা দশমীতে। তাই দশমীতে এই বিজয়কেই চিহ্নিত করে বলা হয় ‘বিজয়া দশমী’।
আরও পড়ুন- ৩৭৯ দিনের অপেক্ষা! ২০২৩ সালের দুর্গাপুজো থেকে দীপাবলী এক নজরে
বাঙালিরা যখন দুর্গাপুজো পালন করেন, তখন অনুরূপভাবে ভারতের কোথাও কোথাও পালিত হয় দশেরা। দশেরা কোথাও কোথাও পরিচিত দশহরা বা দশাইন নামে। নবরাত্রির নবম দিন অর্থাৎ নবমীর পরদিন দশমীতে পালিত হয় দশহরা বা দশেরা। পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও ভারতের অনেক জায়গায় একে বিজয়া দশমী বলা হয়। মনে করা হয়, শ্রীরামচন্দ্র এই দিনে লঙ্কার রাজা দশানন রাবণকে হারিয়ে তাঁকে বধ করেছিলেন। দশ মানে দশানন রাবণ, আর হরা মানে হার বা পরাজয়। সুতরাং দশহরা বা দশেরা মানে হল দশাননের পরাজয়। দশেরায় ভারতের বিভিন্ন জায়গায় রাবণের পুতুল দহনের মাধ্যমে এই দিন পালন করা হয়। ভারতীয় সংস্কৃতির এই গুরুত্বপূর্ণ উৎসব দশহরা বা দশেরা আশ্বিন মাসের শুক্ল পক্ষের দশমী তিথিতে উদযাপিত হয়। কালিদাসের রঘুবংশ, তুলসীদাসের রামচরিত মানস কিংবা সমসাময়িক বিভিন্ন পুঁথিতে বা সাহিত্যে উল্লেখ করা রয়েছে যে রাবণ বধের পর আশ্বিন মাসের ৩০ তম দিনে অযোধ্যা প্রত্যাবর্তন করেন রাম। রাবণ বধ এবং রামচন্দ্রের অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তন উপলক্ষ্যে যথাক্রমে দশেরা ও দীপাবলি পালন করা হয়ে থাকে দেশজুড়ে।
বাংলায় যেরকম সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গাপুজো ঠিক তেমনই কর্ণাটকের মাইসোরের সবচেয়ে বড় উৎসব দশেরা। দশেরার সময় দেশ-বিদেশ থেকে মানুষ আসেন মাইসোরে। সেই সময় সারা শহর জুড়ে চারিদিকে দেখা যায় আলোর রোশনাই। পাশাপাশি রঙ-বেরঙের রাজকীয় সাজে সেজে ওঠে মাইসোরের রাজবাড়ি। দশেরা উপলক্ষ্যে পুরো এক মাস মাইসোর প্যালেসকে লক্ষাধিক আলো দিয়ে সাজানো হয়। এর পাশাপাশি হাতিদের সুন্দর করে সাজিয়ে মাইসোর প্যালেস থেকে এক বিরাট শোভাযাত্রা বের করা হয়। মাইসোরের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে রয়েছে ওয়াদিয়ার রাজাদের হাতে গড়া একাধিক দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্য। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য মাইসোর রাজপ্রাসাদ। প্রতিবছর মাইসোর রাজবংশের রাজদম্পতি চামুণ্ডি পাহাড়ের চামুণ্ডা মন্দিরে পুজো দেন। এর পরেই শহর জুড়ে শুরু হয় উৎসব। কথিত আছে, এই পাহাড়েই চামুণ্ডা দেবী মহিষাসুরকে বধ করেছিলেন। সেহেতু তিনিই রাজপরিবারের কুলদেবী।
আরও পড়ুন-কীভাবে বাংলায় এল জনপ্রিয় ক্যাপ বন্দুক! অবাক করবে দুর্গাপুজোর এই খেলনার ইতিহাস
বিজয়া দশমী হোক বা দশেরা, এর পৌরাণিক তাৎপর্য মানুষকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। বিজয়া দশমী পর্যন্ত চলে দুর্গার আরাধনা। মনে করা হয়, এই দিনেই দুর্গা বধ করেছিলেন মহিষাসুরকে এবং শ্রীরামচন্দ্র বধ করেছিলেন রাবণকে। এই দুই দোর্দণ্ডপ্রতাপ অসুর পরাজিত হয়েছিল এই দিনে, অর্থাৎ দুষ্টের দমন এবং শিষ্টের পালন। সত্যের জয়, মন্দের উপর ভালোর জয় ইত্যাদি নানাভাবেই বিজয়া দশমী কিংবা দশেরা দিনটি পালিত হয় সারা ভারতে। বিজয়া দশমীর বিশেষ তাৎপর্য উল্লেখিত আছে মহাভারতেও। মহাভারতে বলা হয়েছে ১২ বছর বনবাস এবং ১ বছর অজ্ঞাতবাসের পর আশ্বিন মাসের শুক্লা দশমীতে পাণ্ডবরা শমী বৃক্ষে লুকিয়ে রাখা তাঁদের অস্ত্র পুনরায় উদ্ধার করেন এবং ছদ্মবেশ মুক্ত হয়ে নিজেদের প্রকৃত পরিচয় ঘোষণা করেন। এর পরেই হয় সেই বিরাটের যুদ্ধ। আমরা সকলেই জানি সেই যুদ্ধে কীভাবে বৃহন্নলারূপী অর্জুন একা হাতে কুপোকাত করে দিয়েছিলেন কৌরব মহারথীদের।
তবে ঐতিহাসিকভাবেও দশেরা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। ঐতিহাসিকরা মনে করেন আগেকার দিনে ক্ষত্রিয়রা বিজয়া দশমীর দিন নিজেদের অস্ত্রের পুজো করতেন। তারপর দেবীর আশীর্বাদ নিয়ে তাঁরা যুদ্ধে যেতেন। যুদ্ধ যখন হবে তখন প্রাণহানি অবশ্যম্ভাবী। মানব সভ্যতার ইতিহাসে এমন যুদ্ধ বিরল যেখানে কোনও প্রাণহানি হয়নি। সুতরাং যুদ্ধের পর কার সিঁথিতে সিঁদুর থাকবে আর কার সিঁথিতে সিঁদুর থাকবে না তার নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না। সেই কারণেই এই বিশেষ দিনে ক্ষত্রিয়দের স্ত্রীরা নিজেদের মধ্যে সিঁদুর খেলায় মেতে উঠতেন। বিজয়া দশমীতে সিঁদুর খেলার মাধ্যমে স্ত্রীরা দেবীর কাছে প্রার্থনা করতেন যেন তাঁদের সিঁথির সিঁদুর অক্ষয় থাকে। আবার অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, বিজয়া দশমীর আসল নাম ছিল অশোক বিজয়া দশমী। কলিঙ্গ যুদ্ধে জয়ের পর ১০ দিন ধরে মৌর্য সম্রাট অশোক বিজয়োৎসব পালন করেছিলেন, সেটিই ‘অশোক বিজয়া দশমী’। যেহেতু শুক্লা দশমীতেই সম্রাট অশোক বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন তাই বৌদ্ধদের কাছেও এই বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে।
তবে পৌরাণিক এবং ঐতিহাসিক কারণে বিজয়া দশমী যতই আনন্দের হোক না কেন, আপামর বাঙালির কাছে তা দুঃখের। আজ দুর্গা ফিরে যাচ্ছেন কৈলাসে, আসবেন আবার এক বছর পর। আবার এক বছরের অপেক্ষা...