বয়স ১০৯, আজও কলকাতার রাস্তায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এই 'অযান্ত্রিক'
প্রায়ই রবিবার মা উড়ালপুল, রেড রোড বা আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু রোডে একটি হুড খোলা পুরোনো দিনের গাড়ি দেখা যায়। সবুজ ও কালোর রঙমিলান্তিতে তৈরি। চালকের আসনে চোখে রোদ চশমা পরা এক ঝকমকে যুবক পাশে তাঁর স্ত্রী তাঁরও চোখে রোদ চশমা আর পিছনের সিটে ওঁদের কন্যা। গাড়িটি কাছে আসতেই অনেকে ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কেউ বলেন, 'দ্যাখ দ্যাখ এটা সেই ফোর্ড গাড়ি, কেমন চলছে।' আবার কেউ বলেন, 'না, না, এটা অস্টিন'।
আসুন গাড়ির সওয়ারিদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই। স্টিয়ারিং হাতে স্মার্ট যুবকটির নাম আনন্দ চৌধুরী; পাশে ওঁর স্ত্রী মৌমিতা আর পিছনের সিটে ওদের একমাত্র কন্যা আর্দশিনী। আর গাড়িটি ফোর্ড বা অস্টিন নয়। এটি ষ্টোয়ার আর গোটা পৃথিবীতে একমাত্র স্টোয়ার কোম্পানির চালু গাড়ি। গাড়িটির বয়স নয় নয় করে ১০৯ বছর। এখনও নিয়মিত কলকাতার রাস্তায় ওকে দেখা যায়। মাঝে মাঝে আনন্দ কলকাতা থেকে খড়গপুরে গাড়িটিকে নিয়ে যায়। রাস্তায় দেখলেই চালকেরা সমীহ করে জায়গা করে দেয় যাতে বৃদ্ধ প্রপিতামহ ধীরে সুস্থে তার নিজস্ব ছন্দে চলতে পারে।
বাবুর বাবু ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র চৌধুরী। পশ্চিম মেদিনীপুরে মলিঘাটি এস্টেটের জমিদার। ১৯০৩ কি ১৯০৪ সাল কলকাতাতে তখন প্রথম হাওয়া গাড়ি এসেছে। নানা কাজে ঈশ্বরচন্দ্রকে কলকাতাতে আসতে হয়। তিনি দেখেন বেশ সুন্দর গাড়ি কলকাতার রাস্তা দিয়ে চলেছে। রাস্তার দু-ধারে মানুষ দাঁড়িয়ে সেই গাড়ি যাওয়া অপক বিস্ময়ে দেখছে। গাড়ির যাত্রী বাবু-বিবিরা হাত নাড়ছেন জনতার উদ্দেশ্যে। মুখে গর্বের হাসি।
ঈশ্বরচন্দ্রের ইচ্ছা হল তিনিও গাড়ি কিনবেন। যেমন ভাবা তেমনি কাজ। ঈশ্বরচন্দ্র পাড়ি দিলেন জার্মানির উদ্দেশ্যে। পৌঁছলেন মার্সিডিজ কোম্পানির অফিসে। এক জার্মান ব্যবসায়ী, নাম কার্ল বেজ, তাঁর খুব শখ মোটর রেসিং-এর। তাঁর পছন্দের গাড়ি ডেমলার। ডেমলার গাড়ি চালিয়ে তিনি একের পর এক রেস জিতে চলেছেন। একদিন ডেমলার গাড়ির কর্তারা তাঁর বাড়িতে এসে বললেন, 'কার্ল সাহেব আপনার তো আমেরিকাতে ব্যবসা আছে তা আপনি আমাদের গাড়ি বিক্রি করুন না, মোটা কমিশন দেব।' কার্ল সাহেব রাজি হলেন তবে একটা শর্তে, গাড়িগুলির নাম তার বড় মেয়ে মার্সিডিজের নামে রাখতে হবে। ডেমলার কোম্পানির কর্তারা এই শর্ত মেনে নিলেন। মার্সিডিজ গাড়ির বিশ্বজয়ের গল্প সেই থেকে শুরু।
হিটলার এবং জেনারেল গোয়েরিং এর প্রিয় ছিল মার্সিডিজ গাড়ি। দুই বিখ্যাত শিল্পী ভীমসেন যোশী এবং মেহেদী হাসান খুব বন্ধু ছিলেন এবং তাঁদের পরস্পরের প্রতি টান শুধুমাত্র সঙ্গীত চর্চায় থেমে থাকেনি। এই টানের একটি বড় কারণ ছিল মার্সিডিজ গাড়ি। দু-জনেই গাড়ি চালাতে খুব ভালোবাসতেন এবং পরস্পরের দেখা হলে কুশল বিনিময়ের পরই শুরু হত গাড়ি নিয়ে আলোচনা। দু-জনেই গাড়ির সমঝদার এবং রসিক। যোশীজী হাসান সাহেবকে বললেন, 'দ্যাখ আমার গাড়ির কারাবোরেটারটা সমস্যা দিচ্ছে। তুমি পাকিস্তানে গাড়ি সারাবার লোক পাও?' হাসান সাহেব উত্তরে বললেন, 'তা পাই, কিন্তু আমার গাড়িটি বড্ড স্টার্টের সমস্যা করছে ইদানিং।' এইভাবেই দুই বন্ধুর কথা হত। একবার আলাপচারিতার সময় যোশীজী এই প্রতিবেদককে তাঁর মার্সিডিজ প্রেমের কথা শুনিয়েছিলেন।
এদিকে ঈশ্বরচন্দ্রকে পেয়ে খুব খুশি জার্মান সাহেবরা। তাঁরা ওঁকে গাড়ি করে নানা জায়গায় নিয়ে চললেন। কিন্তু, না, ঈশ্বরচন্দ্রের গাড়ি পছন্দ হল না। কারণ তাঁর মনে হল মেদিনীপুরের রাস্তায় এই শৌখিন গাড়ি চলবে না। মাঝে একটি নদী পার করে তবে মলিঘাটি গ্রামে পৌঁছতে হয়। গ্রীষ্মকালে নদীতে জল থাকে না কিন্তু বর্ষাকালে তা ফুলে ফেঁপে ওঠে। এমন গাড়ি তাঁকে খুঁজতে হবে যেটি সারা বছর জল কাদার রাস্তাতেও চলে।
খুঁজতে খুঁজতে ঈশ্বরচন্দ্র হাজির হলেন ষ্টোয়ার কোম্পানিতে। স্টোয়ার রোড রোলার, সাইকেল, টাইপ রাইটার বানাত। সাহেবরা ঈশ্বরচন্দ্রের কাছে সব শুনে বললেন তাঁরা গাড়ি বানিয়ে দেবেন। তবে হাতে তৈরি গাড়ি তাই বানাতে সময় লাগবে। ১৯০৮ সালে গাড়ির অর্ডার দিয়ে ঈশ্বরচন্দ্র কলকাতায় ফিরলেন। তখন তো যোগাযোগের মাধ্যম চিঠিপত্র। ঈশ্বরচন্দ্র চিঠি মারফত জানতে চান গাড়ি কবে আসবে আর জার্মান সাহেবরা বলেন, এ হয়ে গেল বলে। একটু ধৈর্য ধরুন আমরা গাড়ি পাঠাচ্ছি।
১৯১৩ সালের অক্টোবর মাসে কলকাতা বন্দরে ৪টি কাঠের বাক্সে করে স্টোয়ার এসে পৌঁছল। দাম ৩২৫০ টাকা। সঙ্গে দু'জন জার্মান মেকানিক যারা গাড়িটিকে assemble করবেন। ওয়েলিংটন স্কোয়ারে একটি গ্যারেজে স্টোয়ারের অ্যাসেম্বলিং এর কাজ শুরু হল।
নভেম্বর মাসে ঈশ্বরচন্দ্র নিজে চালিয়ে মলিঘাটিতে গাড়ি নিয়ে পৌঁছলেন। গ্রামে সেদিন উৎসব। জমিদারবাবু নতুন গাড়ি কিনেছেন। গ্রামের সবাই ভেঙে পড়ল চৌধুরী বাড়িতে গাড়ি দেখতে। শুধু মলিঘাটি নয় আশে পাশের গ্রাম থেকে বহু মানুষ আসতে লাগলেন। অবিভক্ত মেদিনীপুরে এটি প্রথম কোনও ব্যক্তিমালিকানার গাড়ি।
চার সিলিন্ডারের গাড়িটি ম্যাননেটের সাহায্যে স্টার্ট নেয়। হেড লাইট জ্বলে অ্যাসিটিলিন গ্যাসে আর সাইড লাইট জ্বালতে লাগে কেরোসিন। আগে কাঠের চাকা ছিল। কিন্তু কাঠের চাকা তৈরি করার মানুষ আর পাওয়া গেল না। এখন গাড়িটিতে স্পোকের রাবারের চাকা লাগানো হয়েছে।
ঈশ্বরচন্দ্রের মৃত্যুর পরে তাঁর স্ত্রী বিষ্ণুপ্রিয়া চৌধুরানী দীর্ঘদিন এই গাড়ি ব্যবহার করেছেন। গায়ে সুগন্ধি লাগিয়ে, গাড়ির হুড খুলে তিনি শিশুপুত্র শান্তিনাথকে নিয়ে প্রায়ই হাওয়া খেতে বেরোতেন। মেদিনীপুর ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিপ্লবী আন্দোলনের পীঠস্থান। এই গাড়ি করে বহু বিপ্লবী ছদ্মবেশে পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে গেছেন। জমিদারবাবুর গাড়ি তাই পুলিশ সার্চ করবে না, এইজন্য এই ব্যবস্থা করা হয়।
১৯৫০ সালে গাড়িটি বসে যায়। ১৯৯০ দশকে গাড়িটি চালু করে শান্তিনাথ চৌধুরীর একমাত্র পুত্র প্রতাপ। তিনি অত্যন্ত শৌখিন মানুষ ছিলেন আর ছিল পুরোনো গাড়ির শখ। প্রতাপবাবুর ঐকান্তিক চেষ্টাতে স্টোয়ার আবার পথে নামল। চল্লিশ বছরে কলকাতার চেহারা অনেক পালটেছে। গাড়ি বেড়েছে, মানুষের ট্রাফিক আইন ভাঙার প্রবণতা বেড়েছে কিন্তু তার মধ্যে স্টোয়ার নির্বিঘ্নে চলেছে। একটি দিনের জন্যও রাস্তায় খারাপ হয়নি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় স্টোয়ার কারখানাতে মিত্রবাহিনী বোমা ফেলে ক্ষতি করে। যুদ্ধ শেষ হলে আর কারখানা চালু করা যায়নি। মার্সিডিজ কোম্পানি ষ্টোয়ার খোলার চেষ্টা করে, শেষে ১৯৫২ সালে কারখানাটি চিরদিনের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়।
চৌধুরী পরিবার সেই ব্যতিক্রমী পরিবারগুলির মধ্যে একটি যেখানে চার পুরুষ ধরে একটি গাড়িকে তাঁরা ধরে রেখেছেন। ষ্টোয়ার কলকাতাতে এসেছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ঠিক আগে। তারপর দ্বিতীয় বিশ্বমহাযুদ্ধ, স্বাধীনতা সংগ্রাম, পঞ্চাশের দুর্ভিক্ষ, রায়ট, দেশভাগ – সবকিছুর সাক্ষী এই অযান্ত্রিক।
কলকাতার গাড়ির একটা ইতিহাস আছে। পুরোনো গাড়িগুলো সেই সময়ের ইতিহাসের সাক্ষী। নানা রকম গাড়ি ছিল কলকাতাতে। ইংল্যান্ড, জার্মানি, ফ্রান্স, জার্মান দেশের গাড়ি চলত কলকাতার রাস্তায়। তবে যত পুরোনো গাড়ি কলকাতাতে এসেছে তাদের রাজার রাজা ষ্টোয়ার – ঐতিহ্য, ইঞ্জিনিয়ারিং এবং আবেগের সংমিশ্রণ।