দুঃখবিলাসী বাঙালি, বেদনাবিলাসী ফরাসিরা যেভাবে খোঁজে হেমন্তকে

Late Autumn in Bengali & French Poetry: বাঙালি ও ফরাসি কবিরা দুঃখের মেদুরতা বোঝাতে বারবার দ্বারস্থ হয়েছেন হেমন্ত ঋতুর কাছে।

মেলানকোলিয়া — নীরব দুঃখবোধের বিস্তার। ফরাসি এবং বাঙালি এই মেলানকোলিয়া রপ্ত করেছে অতুলনীয় দক্ষতায়। দুঃখবিলাসী বাঙালি আর ফরাসি নস্টালজিয়া, যা কিনা ঠিক ইংরিজি নস্টালজিয়া নয়। ফরাসি Nostalgie হলো ‘an unsatisfied longing’। এখানে স্মৃতি এবং রোমন্থন আছে বটে, আরও গুরুতরভাবে রয়েছে অতৃপ্তি এবং আকাঙ্খা। সুখস্মৃতি রোমন্থনকে এরা নস্টালজিয়া বলে না। বলে স্যুভেনির।

'দুঃখ'-র নাকি শ'খানেকের উপর প্রতিশব্দ রয়েছে ফরাসি অভিধানে। সোজাসাপ্টা দুঃখ, যেমন, দুর্ভোগ বা গদ্যময় ক্ষুধার রাজ্যে দৈনন্দিন বিপন্নতা বোঝানোর শব্দসংখ্যা সীমিত। বরং ব্যক্তিগত বিষণ্ণতা রাগ দুঃখ ইত্যাদি প্রকাশের বেলায় আবেগের নানা রঙের মতোই শব্দের বাহার। একে দুঃখবিলাস বলব না তো কী বলব? যদিও বাংলায় যাকে দুঃখবিলাসিতা বলে (কাকে বলে?), ফরাসিতে তার কোনও দোসর নেই। তবে দু'টি ভাষাতেই রয়েছে দুঃখ জাতীয় আবেগ ব্যক্ত করারা নানা শব্দ।

কোনও এক প্রবন্ধে পড়েছিলাম, রঙের শেড কার্ডের সঙ্গে ফরাসি দুঃখবিলাসের তুলনা। মনকেমন আর মনখারাপের পার্থক্য যেমন আমরা বাংলায় বুঝি, অন্য ভাষায় ততখানি বোঝাতে পারি না, La tristesse আর le chagrin তেমনই উচাটন মনের দু'টি রূপ (এদের কোনওটাই মনকেমন বা মনখারাপের প্রতিশব্দ নয়, আবার সময়বিশেষে তেমন হতেও পারে)। 'ভাল্লাগছে না' যেমন শুধুমাত্র 'ভালো লাগছে না'-এর রূপান্তর নয়। এর ফরাসি উপযুক্ত অনুবাদ পেয়েছি বলে মনে হয়— ennui। আক্ষরিক অর্থে ennui মানে বিরক্তি। তবে যে সব পরিস্থিতিতে বন্ধু-বান্ধবদের 'ennui' ব্যবহার করতে শুনেছি, তাতে মনে হয় ওই, 'ভাল্লাগছে না' দশা। দুখজাগানিয়া বললে তো সুখ দুঃখ সব একাকার হয়ে যায় (ফরাসি নস্টালজিয়া এই গোত্রের)। হাহাকার, হু-হু, খালি-খালি ভাব, কু-ডাকা, খাঁ-খাঁ, উড়ু-উড়ু, আরও কত ওনোম্যাটোপিয়া রিডুপ্লিকেশনের উদাহরণ বাংলা ভাষার প্রাণের 'পরে বসন্তের বাতাসটুকুর মতো বয়ে চলেছে। ফরাসিতে যেমন, 'কোনওরকমে চলে যাচ্ছে' বলতে বলা হয় ‘bof-bof’, সঙ্গে হালকা করে ব্যাঁকানো মুখভঙ্গি। বাঙালির আকুলিবিকুলি আনচানের বৈচিত্র্য ফরাসিতে এক বাক্যে বলা যায় 'আমার আরশোলা লাগছে'। এতে বুঝতে হবে ঈষৎ ম্যাজম্যাজে ভাব, যার সঙ্গে শরীর বিগড়ানোর কোনও সম্পর্কই নেই। যেমন, বসন্তের দুপুরে অসময়ে ঘুম ভাঙার পর দূরপাড়ার আমবাগান থেকে ভেসে আসা কোকিলের কুহুতানে মন উথালপাথাল, পাগলপারা অবস্থা, গলা বুজে আসে, অ্যালার্জি না কি কষ্টে, বোঝা যায় না। বিছানার কোল ঘেঁষে আধো মলিন গোধূলি আলোর দিকে চেয়ে থাকতে ইচ্ছা হয়, এই 'আরশোলা লাগছে' তার ফরাসি অনুবাদ। যাদের ভাষায় দুঃখের এত রঙ, তাদের কবিতা এক রকম না হয়ে উপায় নেই!

আরও পড়ুন- সালঁ, সেলুন আর খুর-কাঁচির কিসসা

ছোট থেকে শোনা 'বাঙালি-ফরাসির জাতিগত বৈশিষ্ট্যে' নাকি কবিতা; কবি ও কবিতার প্রতি রোমান্টিসিজম। কবিতা তো নানা দেশে লেখা হয় ভিন্ন ভিন্ন ভাষায়। হঠাৎ বাংলা-ফ্রান্স এই মেলানকোলিক নস্টালজিয়ার কুয়াশায় জুড়ে গেল কেন? উভয় পক্ষেই দুঃখবিলাসের রমরমার কী কারণ? দুঃখের প্রতি গভীর টান অনুভব করে তাকে অতিক্রম করতে চেষ্টা না করে বরং সযত্নে আঁকড়ে ধরতে চাই। দুই জাতির একই রেওয়াজ। এই প্রবণতাকে ফরাসি কবি এমিল অগিয়ে নাম দিয়েছিলেন la nostalgie de la boue — আক্ষরিক অর্থে 'কাঁদার জন্য নস্টালজিয়া'। ধারণাটি অপ্রকৃত, অকৃত্রিম কোনও জিনিসের প্রতি তীব্র আকাঙ্খা প্রকাশ করা বোঝায়, যা হয়তো কিছুটা ত্রুটিপূর্ণ বা দুঃখময়, তৎসত্ত্বেও সৎ এবং বাস্তব। এই অপ্রকৃতের প্রতি আসক্তি বাঙালিকে দিয়েছে 'বিরহ মধুর হলো আজি', আর ফরাসিরা একই সুরে গেয়েছে "Rien n’est plus douloureusement calme qu’un crépuscule d’automne"। হৈমন্তী গোধূলির মতো বেদনাপূর্ণ শান্ত আর কিছুই হয় না। এমিল জোলা-র কবিতার এই এক লাইন পড়ে মনে হলো, এ পংক্তি অনায়াসে হতে পারত কোনও বাঙালি কবির লেখা। হতে পারত জীবনানন্দের লেখা। লেখক-কবি সুমনা রায় একইরকম উপলব্ধির কথা লিখেছেন তাঁর ‘The Bengali Baudelaire’ প্রবন্ধে। বুদ্ধদেব বসু অনূদিত ফরাসি কবি শার্ল বোদলেয়ার-এর কবিতা পড়তে গিয়ে সুমনার মনে হয়েছিল;

"Though I could not imagine Buddhadeva Bose as Baudelaire, it was not hard for me to imagine Baudelaire speaking in Bangla at all."

আমি হেমন্ত ভালোবাসি। বাঙালি ও ফরাসি কবিরা দুঃখের মেদুরতা বোঝাতে বারবার দ্বারস্থ হয়েছেন হেমন্ত ঋতুর কাছে। তাদের লেখায় আমি বাংলার মফসসল আর ভারতের প্রত্যন্ত গ্রামে কাটানো আদিম জীবনের আভাস পাই, নিউ ইয়র্ক আর প্যারিসের হলুদ পাতা ঢাকা রাস্তা বরাবর হেঁটে যাওয়ার শব্দ শুনি পায়ের তলায়, নাকে লাগে ভেজা ভোরের গন্ধ। পূর্ব এবং পশ্চিমের হিমবাহী নস্টালজিয়া (ফরাসি, ইংরেজি নয়) আমার কাছে ধরা দেয় অ্যাবস্ট্র‍্যাক্ট, অশরীরি মন নিয়ে। জীবনানন্দের কাছে যাওয়ার মতো; হেমন্ত আমি অনুভব করি জোলা, ইয়ুগো, বোদলেয়ার-র visceral বর্ণনায়, যেন চোখ বন্ধ করে প্রেমিকের শরীরের স্পর্শে আগুনের আঁচ। ফরাসি কবিতায়, হেমন্তের দুঃখবিলাসিতা দেখি বাঙালির মুখ হয়ে ভেসে ওঠে কুয়াশার আড়ালে। সাধারণ মানুষ দুঃখবিলাস প্রকাশে প্রায়শই অক্ষম। কবিদের সে দুঃখ নেই। দুঃখকে তারা শব্দে, রূপকে, উপমায় ধরেছে অনায়াসে। হেমন্ত এমন এক হালকা হাতে আঁকা জলরঙের হ্যান্ডমেড কাগজ, যেখানে জলই মুখ্য, রং বাহুল্য। তার বর্ণনায় বেদনবিধুর শান্তি— এমন অপূর্ব বৈপরীত্য জুতসই। জোলা আর রবীন্দ্রনাথ বেদনা বা বিরহের পাশে স্বাভাবিকভাবে ভাবতে পেরেছেন শান্তি বা মধুরের মূর্ছনা। এ সবই হেমন্তের ষড়যন্ত্র।

আজকের এই লেখায় বিষয়গত তথ্য কম, সাবজেক্টিভ প্রয়োগ বেশি। ফরাসি-বাংলা কবিতার তুল্যমূল্য বিচার এখানে উদ্দেশ্য নয়। দুই দেশের কবির লেখায় হেমন্তের রূপ কী এবং কয় প্রকার বিষয়ে কোনও টীকা প্রবন্ধও এ লেখা নয়। এ সপ্তাহের লেখা এক কাব্য-অপুষ্ট পাঠকের নিরিবিলি চলাচল। ফরাসি কবিতায় হেমন্ত খুঁজে পেলে যে পাঠক বারবার অসহায় ফিরে যায় তাঁর নিজস্ব জীবনানন্দের কাছে। এর বাইরে তার আর যাওয়ার কেউ নেই, কোত্থাও নেই।

আরও পড়ুন-রেডিওর সুরে এক হয়ে যায় আজও ফরাসি আর বাঙালিরা?

হেমন্ত ঝরে পড়া পাতা আর ম্লান আলোর ঋতু। জীবনে ক্ষণস্থায়ী কোমল বিষণ্ণতার প্রতীক। ভিক্ত ইয়ূগো-র Les Feuilles d'automne (The Leaves of Autumn) কবিতা শুরু হচ্ছে:

"Puisque l'automne est triste,/Triste saison des pleurs,/Puisque la brise insiste/Sur la feuille qui meurt."
('Since autumn is sad, / Sad season of tears, / Since the breeze insists / On the dying leaf.')।

ঝরাপাতায় বাতাসের তীব্র স্পর্শ ক্ষণস্থায়ী। যেমন ক্ষণস্থায়ী জীবনানন্দের "ঘাসের ওপরে সব বিছানো পাতার/মুখে এই নিস্তব্ধতা কেমন যে - সন্ধ্যার আবছা অন্ধকার/ছড়িয়ে পড়েছে জলে; কিছুক্ষণ অঘ্রাণের অস্পষ্ট জগতে/ হাঁটলাম..."

প্রাকৃতিক কোনও দুরূহ টানে যেন আমাদের হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে শেখায় ইয়ুগো আর জীবনানন্দ। হেমন্তের এই অভিজ্ঞতার অপেক্ষায় থাকি আমরা, জ্বরের ঘোরে বিচরণের মতো, সুন্দর থেকে ঋতুকালীন ক্ষয় আর দুঃখ, অশ্রু, তীব্রতা, মৃত্যু, নিস্তব্ধ অন্ধকারের অবচ্ছা জল আঁকড়ে বাঁচতে চাই। মননশীল বিষণ্ণতার প্রতি ভালোবাসা, এ যে কোনও হতাশা নয়, তা আমরা শিখে নিই।

ফরাসি কবিদের বিষণ্ণতা শুধু একটি অনুভূতি নয়, বরং এক নান্দনিক অভিজ্ঞান। উনিশ শতকের ফ্রান্সে রোমান্টিক এবং প্রতীকী কবি শার্ল বোদলেয়ার এবং পল ভার্লেন ভগ্ন এবং ক্ষয়িষ্ণু সৌন্দর্য আবিষ্কারে প্রসিদ্ধ ছিলেন। বোদলেয়ার তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ Les Fleurs du Mal-এ লিখেছেন,

“Là, tout n'est qu'ordre et beauté, / Luxe, calme et volupté” ("There, everything is order and beauty/ Luxury, calm and voluptuous")

এই সব শব্দগুলির মধ্যে 'order' অর্থাৎ ‘পরিপাটি’ শব্দটি বসিয়ে গভীর বিষণ্ণতা মিশিয়েছেন বোদলেয়ার। এই প্রয়োগ ফরাসি "Fin de siècle" নান্দনিকতার ক্লাসিক দুঃখবাহী চিহ্ন। ফাঁ দ্য সিয়েক্ল যার অর্থ ‘শতাব্দীর শেষ,’ বা ‘শতাব্দীর মোড়’ একটি যুগের সমাপ্তি এবং আরেকটি যুগের সূচনার প্রতীক। নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপট ছাড়াই, এই শব্দটি সাধারণত ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিককে বোঝায়। এই সময়কালকে সাধারণত সামাজিক অবক্ষয়ের একটি যুগ হিসেবে ধরা হলেও তা একইসঙ্গে নতুন সূচনার প্রতীক। ফাঁ দ্য সিয়েক্ল-এর 'আত্মা' বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল ennui, নৈরাশ্য এবং এই বিশ্বাস যে, সভ্যতা শেষমেশ পতনের দিকেই নিয়ে যায়। জীবনানন্দ লিখেছিলেন, "হেমন্তে ঘাসে নীল ফুল ফোটে -/ হৃদয় কেন যে কাঁপে,/ ঘাসের ভিতরে নীল শাদা ফুল ফোটে হেমন্তরাগে"। ফুলটি অন্য কোনও রঙ না হয়ে নীল হলো কেন? দু'বার ফিরে এল কেন ’নীল’? হৃদয় কেন যে কেঁপে উঠল হেমন্তের রাগে! এ কি ফাঁ দ্য সিয়েক্ল এস্থেটিক্স নয়?

আরও পড়ুন-বাংলার কালীর সঙ্গে যেভাবে মিশে গেল ফ্রান্সের সারা-লা-কালী

ভার্লেনের “Chanson d’automne” কবিতায় 'বেহালার কান্না' যেমন হেমন্তের মৃদু গভীর আবেগকে ধারণ করে, জীবনানন্দের "নিঃসঙ্গ জলের রঙ তাকায় আছে" পড়ে হেমন্তের ক্ষীণ হয়ে আসা প্রাণশক্তি দেখি, এমন এক ঋতু যা স্মৃতিতে জীবিত, অথচ ধীরে ধীরে নিস্তব্ধতার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সেই স্তব্ধতা কাম্য, যাকে স্বাগত জানায় লামার্তিন,

 "Salut, bois couronnés d'un reste de verdure! /Feuillages jaunissants sur les gazons épars! /Salut, derniers beaux jours!" ('Greetings, woods crowned with the last of greenery! / Yellowing leaves scattered on the grass! / Greetings, last beautiful days!')

হেমন্ত গোধূলির ঋতু — ম্রিয়মান আলোর সময়। ফরাসি আর বাংলা কবিতায় এই আলোর ব্যবহার আবহ সৃষ্টির মতো। ভার্লেন এবং তাঁর সমসাময়িকদের কাছে এই আলো বাস্তব এবং প্রতীক, উভয়ই— জীবনের ঔজ্জ্বল্য থেকে ধীরে সরে যাওয়া। বোদলেয়ার ‘spleen’ কবিতায় হেমন্তের কোনও উল্লেখ না করেই কেবল আলোয় ঋতু নির্মাণ করেছেন;

"Quand le ciel bas et lourd pèse comme un couvercle/ Sur l'esprit gémissant en proie aux longs ennuis,/Et que de l’horizon embrassant tout le cercle /Il nous verse un jour noir plus triste que les nuits…" ('When the heavy, low sky weighs like a lid / On the groaning soul in its long ennui, / And from the whole horizon pressing down / Pours a day blacker than nights...")

জীবনানন্দ একই আলো দেখছেন গোধূলি ও ভোরে;

" …আকাশ চলে গেছে কোথায় আকাশে/অপরাজিতার মতো নীল হয়ে - আরো নীল-আরো নীল হয়ে/ আমি যে দেখতে চাই-সে আকাশ পাখনায় নিঙড়ায় নিয়ে/ কোথায় ভোরের বক মাছরাঙা উড়ে যায় অশ্বিনের মাসে "

অথবা,

"গোলাপাতা ছাউনির বুক চুমে নীল ধোঁয়া সকালে সন্ধ্যায়/ উড়ে যায় - মিশে যায় আমবনে কার্তিকের কুয়াশার সাথে"

আলো অন্ধকার কুয়াশার অভ্যন্তরে গিয়েম অ্যাপোলিনেয়ার দেখেছিলেন;

"Dans le brouillard s’en vont un paysan cagneux /Et son bœuf lentement dans le brouillard d’automne /Qui cache les hameaux pauvres et vergogneux…" ('Into the fog goes a stooping farmer / And his ox slowly into the autumn mist / That hides the poor, ashamed hamlets...')

আর জীবনানন্দ দেখেন

"….হিমের হাওয়া বিজন গাঁয়ের চাষা/হয়তো তার সুরটুকু বুকে গেঁথে, ফিরে যায় ঘরে"

শেষ একটি উদাহরণ দিয়ে আসল প্রশ্নে আসব। ইভস বোনফোয় তাঁর আইকনিক কবিতায় লিখেছিলেন,

"Il est des jours d’automne clairs, /Mais nés dans le deuil d’une clarté qui meurt…" ('There are clear autumn days, / But born in the mourning of a light that dies...')

জীবনানন্দের লেখায়,

"লালচে হলদে পাতা অনুসঙ্গে জাম বট অশত্থের শাখার ভিতরে।/অন্ধকারে নড়ে-চড়ে ঘাসের উপর ঝরে পড়ে;/তারপর সান্ত্বনায় থাকে চিরকাল"

হেমন্তে নিমগ্ন ফরাসি ও বাঙালি নীরব বিষণ্ণতায় দেখে জীবনের সমৃদ্ধি ও জটিলতার মধুর স্মারক। উদ্ধৃত কবিতাগুলিতে, তা ফরাসি বা বাংলা হোক, যে নাজুক, সুন্দর, তিক্ত-মধুর দুঃখী আবেগের অনুরণন পাই তা কি কেবল দুই ভাষায় দুঃখবোধের বিস্তারকে ধরতে পারার মিল? বাঙালি ও ফরাসির অনুভব কি অন্যদের চেয়ে বেশি নিবিড়? না কি, এ আসলে সাবজেক্টিভ এবং অবজেক্টিভের সক্রিয় সংশ্লেষণের ফলে এক objective chance, যা কিনা সাররিয়ালিজমের গোড়ার কথা। সাবজেক্টিভ আকাঙ্খা অবজেক্টিভ বাস্তবতায় প্রতিফলিত হলে তাকে বলা হয় objective chance। দেশ কাল ভাষা সময় নির্বিশেষে একই চিন্তার প্রতিফলন দেখা যায় বিভিন্ন শিল্প মাধ্যমে। তেমনটাই কি হয়েছে তবে ফরাসি আর বাংলা কবিতার হৈমন্তী বিরহে? প্রশ্ন থেকে যায়, সাদৃশ্য তবে এই দুই ভাষাতেই এত প্রবল কেন?

(পুনশ্চ: ফরাসি আইকনিক কবিতার কিছু পঙক্তি উদাহরণ হিসেবে নিয়েছি। এর বাইরে আরও কবিতা নিশ্চয়ই থাকতে পারে যা এখানে হয়তো প্রাসঙ্গিক। উদাহরণগুলির রেশ ধরে জীবনানন্দের কাছে ফিরে ফিরে আসা পাঠক হিসেবে আমার সীমাবদ্ধতা অথবা কনশাস বায়াস। মেলানকোলিয়া এখানে চলতি ভাষার শব্দ, ক্লিনিকাল নয়)

More Articles