এ পৃথিবী একবার পায় তারে

Shankhamala, Jibanananda Das: কোনো মানুষের চোখে কি কাঠজ্বলা আগুন দেখা যায়! তাহলে কি এই কবিতা জীবিত মৃতের সংলাপ!

প্রথম বয়সে মন থাকে কবিতাকে কাঁটাছেড়া করার, অর্থ খোঁজার দিকে। তারপর ক্রমে মন থিতিয়ে যায়, খাদের দিকে যায়, কবিতা নিজেই তখন সেই মনের পাশে এসে বসে। জ্বরের দিনে পাশে বসে থাকে। অর্থহীনতার পারাপরে নিয়ে যায়। নতুন অর্থের জানলা খুলে দেয় হঠাৎ করেই। জীবনানন্দের শঙ্খমালা কবিতার এই লাইনটার কথাই যদি ধরি,

'এ পৃথিবী একবার পায় তারে, পায় নাকো আর'

আগে যতবার পড়েছি মনে হয়েছে প্রেমিকার, কুহকিনী, অভিসারিকার কথাই তো বলা হচ্ছে, যার জন্যে ছুটে মরা, বেদনাপ্রধান ভালবাসার রুমালে মিছে ফুলতোলা। কিন্তু আজ, ইষৎ জ্বরের ঘোরে কবিতাটা যখন ফিরে পড়ছি, মনে হচ্ছে আরে মৃত্যু নয় কি এই নারী! যে ছিল দূরে কান্তারের পথে, সে আজ আমায় নিতে এসেছে, 'বলিল, তোমারে চাই'!

জীবনানন্দের কবিতায় সাধারণত যেমন দেখি, কবি একজন নারীকে খুঁজছেন, কবিতায় তাঁর অনুসন্ধান প্রবাহ ধরা থাকে। চট করে মনে করা যায়, বনলতা সেন।
তাঁকে খুঁজছে দেশকালের সীমা ভাঙা কবির ক্লান্ত হৃদয়।

"সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার-অশােকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরাে দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন"

কিন্ত এই কবিতায় কবি স্থবির, নারীটি এসেছেন, এসে বলছেন, 'তোমারে চাই'।


"কান্তারের পথ ছেড়ে সন্ধ্যার আঁধারে
সে কে এক নারী এসে ডাকিল আমারে,
বলিল, তোমারে চাই:
বেতের ফলের মতো নীলাভ ব্যথিত তোমার দুই চোখ
খুঁজেছি নক্ষত্রে আমি- কুয়াশার পাখনায়"

আরও পড়ুন: যে কবিতায় অন্ধকার নামে সহসা

বলছেন, নক্ষত্রে, কুয়াশার পাখনায় খুঁজে তবে আজ দেখা না দেখা মিশছে। মন আটকে থাকে কুয়াশার পাখনা শব্দবন্ধে। গ্রামবাংলায় শীতের সন্ধ্যে নামতে যারা দেখেছে তারা জানে, কুয়াশার পাখনা আসলে কী। দূরে একটা চাদর দেখা যায়, তা ক্রমে নিজেকে মেলে ধরতে থাকে, যেন কোনো পাখি, আসতে আসতে পাখনা মেলে দিচ্ছে। সেই সন্ধেয় খোঁজ চালিয়েছে সে, নির্জন পেঁচার মতো।

আরেকটু এগোই,

"সন্ধ্যার নদীর জলে নামে যে আলোক
জোনাকির দেহ হতে-খুজেছি তোমারে সেইখানে-
ধূসর পেচার মতো ডানা মেলে অঘ্রাণের অন্ধকারে
ধানসিড়ি বেয়ে-বেয়ে
সোনার সিঁড়ির মতো ধানে আর ধানে
তোমারে খুঁজছি আমি নির্জন পেঁচার মতো প্রাণে"

এখানে জীবনানন্দের একটা ছোট খোদকারি দেখে মন ভরে যায়। ধানে শব্দটি দু'বার পাশাপাশি ব্যবহার করে অনন্ত ধানক্ষেত এঁকে দিচ্ছেন কবি, সেই ধানক্ষেতে আঁধার নামছে। গ্রাম্য সান্ধ্য আবহ। বাংলার চিরনিজস্ব ছবি।

এই আবহেই কবির সঙ্গে তাঁর দেখা। আর এখানেই খটকা। এতক্ষণ যাকে মৃত্যু ভাবছিলাম সে কি স্রেফ মৃত্যু! গ্রামবাংলায় অন্ধকারে কে আসে! কার পদসঞ্চারে কুয়াশাবিছানো পথে মনে ভয় জাগে ঘনঘন! মনে পড়ছে 'হলুদ পোড়া', মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পে প্রতিটি মৃত্যুই সন্ধে নামছে যখন, তখন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বর্ণনায়-

"তখনো আকাশ থেকে আলোর শেষ আভাসটুকু মুছে যায়নি। দু'তিনটি তারা দেখা দিয়েছে। আরো কয়েকটি দেখা দিতে দিতে আবার হারিয়ে যাচ্ছে। এক মিনিট কি দু'মিনিটের মধ্যে রাত্রি শুরু হয়ে যাবে। জীবিতের সঙ্গে মৃতের সংযোগ স্থাপনের প্রশান্ত সময় সন্ধ্যা।"

এবার জীবনানন্দের কবিতাটির অংশবিশেষ আবার পড়া যাক-

"কান্তারের পথ ছেড়ে সন্ধ্যার আঁধারে
সে কে এক নারী এসে ডাকিল আমারে,
বলিল, তোমারে চাই:
বেতের ফলের মতো নীলাভ ব্যথিত তোমার দুই চোখ
খুঁজেছি নক্ষত্রে আমি- কুয়াশার পাখনায়-

সন্ধ্যার নদীর জলে নামে যে আলোক
জোনাকির দেহ হতে-খুজেছি তোমারে সেইখানে-
ধূসর পেচার মতো ডানা মেলে অঘ্রাণের অন্ধকারে
ধানসিড়ি বেয়ে-বেয়ে
সোনার সিঁড়ির মতো ধানে আর ধানে
তোমারে খুঁজছি আমি নির্জন পেঁচার মতো প্রাণে।"

আমার আর সংশয় থাকে না। এই পরিস্থিতিতেই তো চোরের মতো ভিটে থেকে নেমে ডোবার কাছে যায় হলুদপোড়ার ধীরেন, শুভ্রার দাদা। যে আমায় সন্ধেয় খুঁজতে এসেছে সে কেমন দেখতে? কবিতায় প্রথম ইঙ্গিত,

'কড়ির মতন সাদা মুখ তার;

দ্বিতীয় ইঙ্গিত

'দুইখানা হাত তার হিম;'

গ্রামবাংলার মেয়ে, সে হবে শ্যামলিমা মাখা, তার মুখ কেন কড়ির মতো সাদা! কেন তার হাত হিম! একবার এক বন্ধুর মৃতা মায়ের হাত ধরে দীর্ঘ পথ গিয়েছিলাম। সেই থেকে জানি, জীবিত মানুষের চেয়ে মৃতের হাত অনেক বেশি হিমেল।

শেষ ইঙ্গিত:

'চোখে তার হিজল কাঠের রক্তিম চিতা জলে:'

কোনো মানুষের চোখে কি কাঠজ্বলা আগুন দেখা যায়!
তাহলে কি এই কবিতা জীবিত মৃতের সংলাপ! জীবনানন্দই তো ১৯৪৬-৪৭-এ লিখবেন,


'মৃতেরা কোথাও নেই; আছে?
কোনো-কোনো অঘ্রাণের পথে পায়চারি-করা শান্ত মানুষের
হৃদয়ের পথে ছাড়া মৃতের কোথাও নেই বলে মনে হয়;'

সে-ই কি এসেছিল নারীর বেশে কান্তারের পথ ছেড়ে সন্ধের আঁধারে!

আমি আমার ব্যখ্যাটি সিদ্ধান্ত হিসেবে রাখছি না এখানে, কাউকে মেনেও নিতে বলছি না। শুধু বলছি কবিতা নিজেই নিজের সমস্ত গয়না খুলে ধরা দেয় অকস্মাৎ। এই কবিতাটিও আজ তেমন, আমার জ্বরের দিনে, নতুন ইশারা নিয়ে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সত্যিই তো যা মৃত্যুর মতো অনিবার্য তাকে একবারই পাওয়া যায়।

আবার একথাও ঠিক, এমন মানুষ আছেন, যাকে চকিতে একবারই দেখেছি কেবল। বড়জোর তাঁর চলে যাওয়ার পথটি মনে পড়ে। আছে এমন গানও। মাত্র একবার শোনা। আজ এ লেখার শিরোনামের সূত্র ধরে তেমন তিনটি গানের কথা বলেই এই পর্ব শেষ করব। প্রথম গানটির গল্প বলেছিলেন জয় গোস্বামী। কয়েক দশক আগে লোকাল ট্রেনে শুভ্রবসন পরা এক ফকিরকে গাইতে শুনেছিলেন তিনি। গানের কথা সুর সব তাঁর কাছে রয়ে গেছে, ফিকে হয়নি এতদিন পরেও। কথাগুলি এইরকম-

'ওরে চিকন কালা
তোমার আশ্চর্য লীলা,
নামের গুণে জলের 'পরে ভাসাইলা শিলা'


একবার পেয়েছেন, কিন্তু রেখে দিয়েছেন জয়।

দ্বিতীয় গানের কথা বলি। আমি যখন শুনি তখন আমি কলেজের প্রথম বছরে পা দিয়েছি সম্ভবত। বন্ধুদের সাথে শান্তিনিকেতন বেড়াতে গিয়েছি। এক গেরুয়াধারী বসে গান শোনাচ্ছেন অনেকক্ষণ। চেনা গান। আমি একটু উতলা, বললাম, একটা এমন গান গান না যেটা রোজ গাইতে হয় না। তিনি একটু অপ্রস্তুত হলেন আবদারে। চলে যাওয়ার আগে আমার কাছে এসে গুণগুণ করে গাইলেন,

"ফুলেরই ভ্রমরা, গিয়াছে উড়িয়া
না জানি কোন বাগানে ধরা পড়েছে
বন্ধু বিনে কমল বাসি হয়েছে
মধুমাখা দু'টি ফুল ফুটেছে"

এই গানটিও ওই একবারই, আর কখনও শুনিনি আমি। এমনকী এই ভদ্রলোকের সঙ্গে কয়েক বছর পর যখন দেখা হলো, তিনিও আর এই গানটি মনে করতে পারল না। আজ এখন এই গল্প বলতে বসে আমার মনে হচ্ছে,

'এ পৃথিবী একবার পায় তারে
পায় নাকো আর'

আরও পড়ুন: অন্যজনের রবীন্দ্রগান

আরেকবার, পাথরচাপুড়ি মেলায় এলোমেলো ঘুরছি। জাঁকজমক পেরিয়ে সবচেয়ে ম্লান আখরায় গিয়ে বসলাম। যিনি আখরাধারী তাঁর নাম আজও মনে আছে। শেখ আরজুল। বর্ধমানের ভাগচাষী। মাঠ থেকে ফিরে, রিডের রংচটা, ইঁদুরে পর্দা-কাটা হারমোনিয়ামে গান গান। একটা ঢোল নিয়ে সঙ্গত করেন গ্রামের আরেক ভাগচাষী। আমার আগ্রহ দেখে তিনি আমাকে লালনের একটি পদ শোনালেন, সে পদ আর কখনও কারও মুখে শুনিনি, শুনবও না বোধহয়। পদটি এমন-

"আছে দ্বীন দুনিয়ার অচিন মানুষ একজনা
কাজের বেলায় পরশমণি, আর সময় কেউ চেনে না।
নবী আলি এই দু'জনে
কলমা দাতা আরেফিনে
বেকলমায় সে অচিন জনে
পীরের পীর হয় সে জানো না
কাজের বেলায় পরশমণি আর সময় কেউ চেনে না"

জ্বরের সন্ধে। জীবনান্দের কবিতার একটি লাইন আমাকে নিয়ে যাচ্ছে এমন পথে, যে পথে আর কখনও যাব না। নিয়ে যাচ্ছে এমন বিষণ্ন-করুণ সন্ধের কাছে, যা একবারই আসে।

More Articles