আকাশে ঝোলে ফ্লাইং সসার, আচমকা বন্ধ হয় গাড়ির ইঞ্জিন! রহস্যে মোড়া জোন অব সাইলেন্স

Zone of Silence: এখানকার দৈত্যাকার ক্যাকটাস গাছগুলো টকটকে লাল রঙের কিন্তু এই গাছই যখন এই এলাকার বাইরে নিয়ে যাওয়া হয় তখন তা সম্পুর্ণরূপে রং হারিয়ে ফেলে।

প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ এই পৃথিবীতে রহস্যের বিরাম নেই। বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গেই পৃথিবীর সর্বত্র মানুষের বিচরণ যেমন বেড়েছে, ঠিক তেমনই এখনও অনেক স্থান এমন রয়েছে যা রহস্যের ভাণ্ডার। আর এইসব স্থানে এমন কিছু ঘটে যার ব্যাখ্যা মানুষ বহু চেষ্টা করেও বের করতে পারেনি। সেরকমই একটি রহস্যময় এলাকা হল মেক্সিকোর জোন অব সাইলেন্স।

“দুর্গম গিরি কান্তার-মরু, দুস্তর পারাবার

লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশিথে, যাত্রীরা হুঁশিয়ার!”

নজরুল ইসলামের ‘কাণ্ডারি হুঁশিয়ার’ কবিতার এই অংশের সঙ্গে মেক্সিকোর জোন অব সাইলেন্সের অদ্ভুত মিল রয়েছে। পৃথিবীর বুকে এক অজানা রহস্য ভাণ্ডার এই জোন অব সাইলেন্স। কুখ্যাত বারমুডা ট্রায়াঙ্গাল আর জোন অব সাইলেন্স একই অক্ষাংশে অবস্থিত। সেন্ট্রাল মেক্সিকোর বোলসন দ্য মাপিমির ১০ বর্গমাইল এলাকা জুড়ে রয়েছে এই মরুভূমি। এখানে এমন কিছু ঘটনা ঘটে যা মনে মনে ভয়ের উদ্রেক ঘটাতে বাধ্য।

গায়ে কাঁটা দেওয়ার জন্য মানুষের ঠিক কী কী দরকার? ঘুটঘুটে অন্ধকার, ভূতুড়ে পরিবেশ, খুটখাট শব্দ, আগুনের বৃষ্টি– যথেষ্ট না কি তাতেও ভয় পাবেন না? আচ্ছা, ধরুন টেপ রেকর্ডার হঠাৎ বাজতে বাজতে থেমে গেল, চলন্ত গাড়ির স্টার্ট বন্ধ হয়ে গেল আচমকা, হাতের মোবাইল কাজ করছে না কোনওভাবেই– এবার কি ভয় লাগছে? জানা যায়, একবার ইউএস এয়ারফোর্স একটি মিসাইল ছুঁড়েছিল কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় দিক পরিবর্তন করে সেই মিসাইল এই মরুভূমিতে আছড়ে পড়ে এবং পরে তার আর কোনও খোঁজ মেলেনি।

আরও পড়ুন- রেস্তোরাঁর বিলে জন্ম নিল লতার প্রথম পুজোর গান! আশ্চর্য সেই ইতিহাস

মেক্সিকোর এই অঞ্চলে প্রথম বিভ্রান্তিকর ঘটনা ঘটে ১৯৩০ সালে। এক রিপোর্ট অনুযায়ী, ১৯৩০ সাল নাগাদ যখন পাইলট ফ্রান্সিস্কো সারাবিয়া অঞ্চলের ওপর দিয়ে তাঁর প্লেন উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন, তখনই এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। দেখা যায়, প্লেনের যন্ত্রপাতিগুলো আস্তে আস্তে কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে এবং রেডিওর যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। ফলত বাধ্য হয়ে তাঁকে ফ্লাইটের এমারজেন্সি ল্যান্ডিং করতে হয়। তবে ফ্রান্সিস্কো একা নন যার সঙ্গে এমন অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে। ১৯৬৬ সালে মেক্সিকোর জাতীয় তেল কোম্পানি পেমেক্স এক অনুসন্ধানকারী দলকে সেখানে মোতায়েন করে যাদের কাজ ছিল এটা খতিয়ে দেখা যে, এই অঞ্চলের ওপর দিয়ে আদৌ কোনও তেলের লাইন করা সম্ভব কিনা। কিন্তু পেমেক্সের এই অভিযান বিফলেই গিয়েছিল। এই অঞ্চলে প্রবেশ করার পর থেকে তাদের রেডিও সিগন্যাল কাজ করাই বন্ধ করে দিয়েছিল।

এই সমস্ত ঘটনার পর তাত্ত্বিকদের একাংশ দাবি করেন যে, এই অঞ্চলের চৌম্বক ক্ষেত্র অত্যন্ত তীব্রতর। যা আমাদের আধুনিক সিগন্যালের জন্য এক ‘ডার্ক জোন’ সৃষ্টি করেছে। বিজ্ঞানীরা বহু বছর ধরে এই ঘটনা অনুসন্ধানের চেষ্টা করছেন এবং সম্ভাব্য কারণ হিসেবে তাঁরা একটি বিষয়কে তুলে ধরেছেন। তাঁরা বলছেন, এই অঞ্চলের মাটির নীচে ম্যাগনেটাইট আর ইউরেনিয়ামের মতো বহু খনিজ আছে যা সিগন্যালের বাধার কারণ হতে পারে। এছাড়া এই অঞ্চলে প্রায়শই উল্কাপাতের ঘটনা ঘটে এবং এই উল্কার টুকরোগুলোতে লোহা এবং অন্যান্য ধাতু মিশে থাকে যা সিগন্যালের সমস্যাকে আরও তীব্র করে তোলে।

এই অঞ্চলকে ঘিরে গল্পেরও শেষ নেই। এখানকার দৈত্যাকার ক্যাকটাস গাছগুলো টকটকে লাল রঙের কিন্তু এই গাছই যখন এই এলাকার বাইরে নিয়ে যাওয়া হয় তখন তা সম্পুর্ণরূপে রং হারিয়ে ফেলে। এখানকার বেঁটে হরিণগুলোর শিং মানুষের কবজির মতো মোটা। আর বিছেগুলো কোনওটাই লম্বায় এক ফুটের কম নয়। এগুলোর মাথা টকটকে লাল। জোন অব সাইলেন্সে কোনও মানুষ বসতি গড়ার শখ পর্যন্ত করে না। মরুভূমির আশপাশের মানুষ প্রতি রাতে আকাশে অদ্ভুত এক ধরনের আলো এদিক ওদিক ছুটে চলতে দেখেন। এই মরুভূমির নিকটবর্তী শহর সেবালোসের কেউ কেউ এখানে ফ্লাইং সসার দেখেছেন বলে দাবিও করেছেন। পুলিশ চিফ ম্যানুয়েল শাপেরোর কথায়, “একদিন রাতে দেখলাম প্রকাণ্ড আকৃতির একটি এয়ারক্রাফট শহর থেকে ৫০ ফুট উচ্চতায় ঝুলে আছে। যানটি আয়তক্ষেত্রের মতো, ধাতুর তৈরি, ওর চারপাশে আলো জ্বলছিল আর গুনগুন করে শব্দ হচ্ছিল। মিনিট কয়েক যানটি ওভাবেই শূন্যে ভেসে রইল, তারপর ঘুড়ির মতো গোঁত্তা খেয়ে ছুটল জোন অব সাইলেন্সের দিকে।”

এই নীরব ভূমিতে এসব আজব ঘটনার পাশাপাশি রয়েছে আজব সব প্রাণীর আনাগোনা। এই মরুভূমির পোকার মাকড়গুলোও স্বাভাবিক পোকামাকড়ের চেয়ে দুই-তিনগুণ বড়। এখানে প্রায় নিয়মিতই রাতের বেলায় উল্কাপিণ্ড ছিটকে পড়ে। জোন অব সাইলেন্সের পাথরগুলোও এমন ভূতুড়ে যে কম্পাস পর্যন্ত নষ্ট হয়ে যায়। মেক্সিকোর এই মরু অঞ্চলের কচ্ছপ এক বিরল প্রজাতির প্রাণী। বলা হয়, এই গোফেরাস কচ্ছপ উত্তর আমেরিকার বৃহত্তম স্থলজ সরীসৃপ এবং এই সময়ে দাঁড়িয়ে তা বিপন্ন।

আরও পড়ুন- অস্তরঙ্গ, প্রজাপতি, নিভাতি… পুজোয় ঘুরে আসুন দেশের সেরা এই সব অফবিট বিচে

এতদিন পর্যন্ত এই মরু অঞ্চল শুধু খবরের শিরোনামেই জায়গা পেয়েছে। কিন্তু এতসব ঘটনার পর বহু মানুষ দূর দূরান্ত থেকে এই রহস্য অন্বেষণে ছুটে আসতে থাকায় কিছু স্থানীয় মানুষ একে পর্যটন কেন্দ্রে পর্যবসিত করেছেন। মিসাইল দুর্ঘটনার কিছু বছর পরে মেক্সিকোর সরকার এই অঞ্চলে মাপিমি বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ তৈরি করে। এখন এই রিজার্ভে বিশ্বের তাবড় তাবড় বিজ্ঞানীরা তাঁদের গবেষণার কাজ চালাচ্ছেন এবং সেই সঙ্গে কীভাবে এই মরু অঞ্চলের উদ্ভিদ ও প্রাণী একটু অস্বাভাবিক ধরনের তা নিয়েও গবেষণা করছেন।

এই অঞ্চলের উত্তর পূর্ব দিকে বিস্তৃত একটি এলাকা হল বোলসনের অংশ। মরুভূমির এই অংশে মাটি সবসময় আর্দ্র থাকে। বলা হয়, লক্ষ লক্ষ বছর আগে এই অংশ টেথিশ সাগরের নীচে ছিল, কারণ এখনও এই অঞ্চলে বিভিন্ন সামুদ্রিক প্রাণীর জীবাশ্মের দেখা মেলে। বিজ্ঞানীদের আরও দাবি, মরুভূমির এই অংশ সমুদ্রের নীচে থাকায় সেখানে লবণের ভাণ্ডারও গড়ে উঠেছে। স্থানীয় মানুষ একজোট হয়ে এই লবণ খননের কাজ করেন। এই অঞ্চলে কাউকেই একা প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না।

গবেষণা চালানো সত্ত্বেও সাইলেন্স জোনের রহস্য উদঘাটন করতে গবেষকরা এখনও সমর্থ হননি। ইউএফও, এলিয়েন প্রভৃতি বিভিন্ন রহস্যময় জিনিসের কথা এখানে উঠে এলেও তার কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে আশা করা যায়, ক্রমাগত গবেষণার মাধ্যমে একদিন হয়তো ঠিকই সাইলেন্স জোনের অজানা রহস্য উদঘাটন করা সম্ভব হবে।

কী কী করবেন

মেক্সিকোর এই অঞ্চলটি সত্যিই প্রত্যন্ত এলাকায় তাই অবশ্যই একজন গাইড ভাড়া করে জায়গাটি ঘুরে দেখা উচিত। এমন একজন গাইড হলেন প্যালিলিও যিনি ১২ বছর বয়স থেকে এই অঞ্চলে বসবাস করছেন এবং তাঁর ঝুলিতে রয়েছে এই মরু অঞ্চল নিয়ে অদ্ভুত আশ্চর্যজনক সব গল্প। জোন অব সাইলেন্স ও নানা রকম গুজব বাদ দিলে মেক্সিকোর এই মরু অঞ্চলে অনেক কিছুই দেখার আছে যা আপনাকে রীতিমতো অবাক করে দেবে।

কখন যাবেন

মেক্সিকোর জোন অব সাইলেন্স ভ্রমণের উপযুক্ত সময় হচ্ছে নভেম্বর থেকে মে মাস। এইসময় এখানকার আবহাওয়া শুষ্ক থাকায় মরুভূমির অভিজ্ঞতা আরও ভালো করে উপভোগ করতে পারবেন।

More Articles