'রসিকতা' ও উত্তরাধিকার: এক ছিন্নমূলের 'শো-অফ'
Milan Kundera: দেশ ও মাতৃভাষা দুই-ই যখন বদলে যায়, তখন শিকড় বলতে কী পড়ে থাকে? স্মৃতি? তাই কি স্মৃতি নিয়ে এত সংবেদনশীল কুন্দেরা?
১
“আমি এখানে কেন এলাম? আবেগের বশে তো নিশ্চয়ই নয়। গত পনেরো বছর ধরে আমি এখানে থাকি না। হাতে গোনা কয়েকজন বন্ধু আর পরিচিত (যাদের এড়িয়ে যেতে পারলে আমি খুশি-ই হই) বাদে এখানে আমার কেউ নেই। এবং, আমার মাকে এখানেই কোথাও একটা অপরিচিতদের ভিড়ে কবর দেওয়া হয়েছে। তা নিয়েও আমার সেভাবে কোনও আগ্রহ ছিল না। তবে, আমি হঠাৎ করেই বুঝতে পেরেছিলাম, আমি আসলে খুব একটা নিরাসক্ত নই। আমি এই দক্ষিণ মোরাভিয়া টাউনকে খুব জোরালোভাবে ঘৃণা করি। যে-শহরে আমি বেড়ে উঠেছি...”
‘দ্য জোক’-এর শুরু লুদভিগের মনোলগে। একটা উজ্জ্বল ও তীব্র ঘৃণাবোধে। অথচ, লুদভিগ গান ভালোবাসত। গান নিয়ে ভাবত। স্বপ্ন দেখত, তার জন্মভূমি, মোরাভিয়ার লোকসংগীত নতুন করে প্রাণ পাবে। তার বান্ধবী তাকে চিঠিতে লিখেছিল, মার্কসবাদের উজ্জ্বল স্বপ্নের কথা, আশাবাদের কথা। কে জানে কেন, লুদভিগের মনে হল এর উত্তরে একটু রসিকতা করা উচিত। প্রেমিকার সঙ্গে ব্যক্তিগত স্তরে ঠাট্টা। সে চিঠির উত্তরে লিখল, আশাবাদ মানবজাতির আফিম... ত্রৎস্কি জিন্দাবাদ। সে বোঝেনি, তার ঠাট্টা ব্যক্তিগত সম্পর্কের সীমা অতিক্রম করে মহান আদর্শের সীমা লঙ্ঘন করেছে। ‘ত্রৎস্কি জিন্দাবাদ!’ প্রেমিকা এই চিঠির কথা জানাল পার্টির ওপরমহলে। এমন ভয়ঙ্কর প্রতিক্রিয়াশীল অপরাধের জন্য লুদভিগের বিচার হল। শাস্তিও হল। কলেজ ও পার্টি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হল তাকে। তার জায়গা হল সেনাবাহিনীতে। নির্বাসন।
আরও পড়ুন: মাত্র একুশটা বছর, ফরাসি ও ইংরাজি সাহিত্যে অসাধারণ দৃষ্টান্ত ও ক্ষণজন্মা প্রতিভা তরু দত্ত
‘দ্য জোক’ উপন্যাস প্রকাশের পরের বছরেই, ১৯৬৮ সালে, চেকস্লোভাকিয়ার দখল নেয় সোভিয়েতের বাহিনী। চারশো জন চেক সাহিত্যিককে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়, তার মধ্যে অন্যতম মিলান কুন্দেরা। ‘দ্য জোক’ এবং ‘লাফেবল লাভস’-এর দেড় লক্ষাধিক কপি রাতারাতি বাজেয়াপ্ত করে নেওয়া হয়। এইসব তথ্য কমবেশি সকলেরই জানা। তারপরেও বছর সাতেক নিজের দেশে ছিলেন কুন্দেরা। তারপর চলে আসেন ফ্রান্সে। বলা যায়, সেই থেকে কুন্দেরা ছিন্নমূল।
একটা আদ্যন্ত ব্যক্তিগত অথবা আদ্যন্ত রাজনৈতিক রসিকতা লুদভিগের জীবন বদলে দিয়েছিল। আর তিতো রসিকতা, রাজনৈতিক শ্লেষ, সাহিত্য ঘিরে স্বাধিকারপ্রমত্ত-স্বভাব বদলে দিয়েছিল ঠোঁটকাটা মিলান কুন্দেরার জীবন। কমিউনিস্ট পার্টি থেকে তিনিও বহিষ্কৃত হয়েছেন। নিজের জন্মভূমিতে তাঁর বই ‘নিষিদ্ধ’ হয়েছে। তাঁর নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হয়েছে। ফ্রান্সে চলে আসার পর মোরাভিয়ায় আর ফেরেননি কুন্দেরা। অনেক পরে, চেক রাষ্ট্র তাঁকে নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দিলেও, ফেরেননি। শেষাবধি, নিজের পরিচয় দিতেন ফরাসি হিসেবে। ১৯৯৫ সাল থেকে তো লেখার ভাষাও বদলে নিলেন ফরাসিতে। দেশ ও মাতৃভাষা দুই-ই যখন বদলে যায়, তখন শিকড় বলতে কী পড়ে থাকে? স্মৃতি? তাই কি স্মৃতি নিয়ে এত সংবেদনশীল কুন্দেরা? আদতে ছিন্নমূল বলে? নাকি, লুদভিগের মতো তাঁরও তীব্র ঘৃণাবোধ জন্মেছিল নিজের জন্মভূমির প্রতি? একটা তিতকুটে রসিকতা যে-ঘৃণার অনিবার্য পোশাক?
কুন্দেরা অবশ্য ঘোষিতভাবে নিজেকে ছিন্নমূল মনে করতেন না। বলতেন, “ফ্রান্সকেই নিজের দেশ মনে করি।” একটা অতিকায় বহিষ্কার তাঁর একটা বিরাট নির্বাচনকে প্রভাবিত করেছিল। কেন জানি না মনে হয়, এই নির্বাচনও আসলে রাজনৈতিক। এবং এর ভিতরে নানা স্ববিরোধ ও দ্বন্দ্বের চাষ। চেক জাতীয়তা ও তার গৌরবের ইতিহাস নিয়ে খানিক পক্ষপাতদুষ্ট ও সরব কুন্দেরা কেন নিজের দেশকেই অস্বীকার করবেন পরে? তার পিছনে কি কোনও গূঢ় কারণ আছে? রাজনৈতিক পক্ষ-বাজার-জনপ্রিয়তার নানা সমীকরণ? যা নিয়ে অনেকেই ইঙ্গিত করেছেন, এখনও হয়তো করেন। নাকি, এই অবস্থান অভিমানসঞ্জাত একজাতের তীব্র নাকচ! সেই লঙ্কাও নেই, রাবণও নেই, সোভিয়েতও নেই, ‘কমিউনিজম’-এর আগ্রাসনও নেই। একটা ধারাবাহিক ইতিহাস চোখের সামনে প্রায় ভো-কাট্টা হয়ে গেল। অথচ কুন্দেরা দেশে ফিরলেন না। তাঁর অতীতের ভাষ্য থেকে নড়লেন না। তাঁর অবস্থান একটা ইতিহাসের স্মৃতিকে প্রাসঙ্গিক রেখে দিল আজও।
কুন্দেরা কি এটাই চেয়েছিলেন? স্মৃতিকে প্রতিহিংসার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে?
২
‘১৯৭১ সাল, এবং মিরেক বলল, ক্ষমতার বিরুদ্ধে মানুষের লড়াই আসলে বিস্মৃতির বিরুদ্ধে স্মৃতির সংঘাত।’
‘দ্য বুক অফ লাফটার অ্যান্ড ফরগেটিং’ যখন প্রকাশিত হচ্ছে কুন্দেরা তখন ফ্রান্সে। উপন্যাসের প্রথম অধ্যায়, ‘লস্ট লেটার্স’, শুরুই হয় একটা ঐতিহাসিক ফটোগ্রাফের অনুষঙ্গে। ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে, এক তীব্র শীতের দিনে কমিউনিস্ট নেতা ক্লেমেন্ট গটোয়াল্ড প্রাগের বারোক প্রাসাদের ব্যালকনি থেকে জনগণের উদ্দেশে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। তাঁর মাথায় টুপি ছিল না বলে, তাঁর ঠিক পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা কমরেড ক্লেমেন্টিস পরম মমতা আর শ্রদ্ধায় নিজের পশমের টুপিটি খুলে গটোয়াল্ডকে পরিয়ে দিয়েছিলেন। কমিউনিস্ট পার্টির প্রোপাগান্ডা বিভাগ এরপর পশমের টুপি পরিহিত গটোয়াল্ডের বক্তৃতা দেওয়ার হাজার হাজার ছবি ছাপিয়ে দেশ ছেয়ে ফেলে। এর বছর চারেক পরে ক্লেমেন্টিস বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগে অভিযুক্ত হন। তাঁর প্রাণদণ্ড হয়। রাতারাতি সেই ঐতিহাসিক ছবি থেকে হাওয়া হয়ে যান ক্লেমেন্টিস। ছবিতে বক্তৃতারত গটোয়াল্ডের মাথায় শুধু থেকে যায় ক্লেমেন্টিসের সেই টুপি।
একটা টুপি, একটা ঐতিহাসিক বিস্মৃতির সংকেত। এমন একটা বিস্মৃতি, যার পিছনের ইতিহাসকে আগ্রাসন হিসেবে চিহ্নিত করছেন কুন্দেরা। আর স্মৃতি হয়ে উঠছে তার উল্টোপিঠে একটা সচেতন লড়াই। এই রাজনৈতিক প্রেক্ষিতটাই এরপর ঢুকে পড়ছে উপন্যাসের শরীরে। যে-আখ্যান নির্মিত হচ্ছে, তার উপত্যকা জুড়ে খেলা করছে এক দার্শনিক সন্ধান। যে-সন্ধানের কেন্দ্রে স্মৃতি। যে-স্মৃতি চরিত্রগতভাবে দার্শনিক। এবং রাজনৈতিকও।
ফিলিপ রথকে দেওয়া একটা সাক্ষাৎকারে কুন্দেরা বলছেন-- “ফরগেটিং ইজ আ ফর্ম অফ ডেথ এভার প্রেজেন্ট উইথিন লাইফ।... আমার নায়িকার সংকট হল, সে জোর করে তার মৃত স্বামীর বিলীয়মান স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরতে চাইছে। কিন্তু বিস্মৃতি রাজনীতিরও একটা বিরাট সংকট। যখন একটা ক্ষমতাশালী অক্ষ ছোটো ছোটো দেশগুলোকে তাদের জাতীয় চৈতন্য থেকে বঞ্চিত করতে চায়, তখন তারা সংগঠিত বিস্মৃতিকে অস্ত্রের মতো ব্যবহার করে। যেটা এখন বোহামিয়াতে ঘটছে। কোনও সাম্প্রতিক চেক সাহিত্য প্রকাশিত হচ্ছে না গত বারো বছর ধরে। দুশোজন চেক সাহিত্যিককে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে, যাঁদের মধ্যে মৃত কাফকাও আছেন। ১৪৫ জন চেক সাহিত্যিককে তাঁদের পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। ইতিহাস বদলে ফেলা হচ্ছে, স্মৃতিস্তম্ভ ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। যে-দেশ নিজের অতীত সম্পর্কে অসচেতন, সে ধীরে ধীরে নিজেকেই হারিয়ে ফেলে। আর সেই কারণেই বিস্মৃতির এই রাজনৈতিক সংকট অত্যন্ত হিংস্রভাবে বিস্মৃতির সাধারণ দার্শনিক সংকটকে উস্কে দেয়। আমরা প্রতি মুহূর্তে, প্রতিদিন এর মুখোমুখি হই, কিন্তু সেভাবে খেয়াল করি না। রাজনীতি ব্যক্তিগত জীবনের অধিতত্ত্বকে বে-আব্রু করে, ব্যক্তিগত জীবনও রাজনীতির অধিতত্ত্বকে বে-আব্রু করে।”
এই অংশটুকু কুন্দেরার সন্ধান-দলিল। বিস্মৃতি ও হাস্য। বিস্মৃতি একজাতের অভাববোধ। উপন্যাসে তামিনা যেমন মারা যায় দেবদূতদের হাসির মধ্যে। মৃত্যু নামক আরেকটা অভাববোধ ঠিকরে বের করে আনে দৈব হাসি। কিন্তু হাসি কেন? হাসির বাচ্যার্থ এখানে তার অর্থ হারিয়ে ফেলে। যে-অদ্ভুত, অবাস্তব বাস্তবতার জন্ম হয়, তা পাঠককেও সংকটে ফেলে। বিপন্ন করে। তাকে টানতে থাকে কুন্দেরার কাঙ্ক্ষিত দার্শনিক প্রস্থানের দিকে। যে-প্রস্থান নিটোল নয়, নিরেট নয়। কুন্দেরার দেখা এখানে খানিক যেন অস্তিত্ববাদীও। যে-দেখায় স্মৃতি মাছের মতো জলের উপরিতলে গোঁত্তা মারে। যে-স্মৃতির অতলে কুন্দেরার রাজনৈতিক অবস্থান, উত্তরাধিকারের অবস্থান। উত্তরাধিকারের প্রশ্নটাই এই স্মৃতির অক্ষকে জায়মান রাখে। কিন্তু কোন উত্তরাধিকার? কীসের উত্তরাধিকার? কুন্দেরা যে-স্মৃতি আর ইতিহাসের কথা বারবার বলছেন, তার ভিতরেই কি এর সংকেত লুকনো? তাঁর উপন্যাসের ভিতরেও কি বহমান কোনও উত্তরাধিকারের স্রোত?
অথবা, তাঁর রাজনৈতিক অবস্থানের ভিতরে?
৩
“‘লাইফ ইজ এলসহোয়ার’ আদতে র্যাঁবোর একটা বিখ্যাত উক্তি। সাররিয়ালিস্ট মেনিফেস্টোর উপসংহারে যার উল্লেখ করেছিলেন আদ্রেঁ ব্রেতঁ। ১৯৬৮ সালের মে মাসে, প্যারিসের ছাত্রছাত্রীরা সোরবর্নের দেওয়াল ভরে দিয়েছিল এই স্লোগানে। কিন্তু আমার উপন্যাসের আসল শিরোনাম ছিল ‘দ্য লিরিক এজ’। প্রকাশকদের দুশ্চিন্তাগ্রস্থ মুখ দেখে শেষমুহূর্তে আমি নামটা বদলে দিলাম। তাঁরা ভয় পাচ্ছিলেন, এমন অ্যাবসার্ড নামের বই আদৌ কেউ কিনবে কি না!”
‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকার ডব্লু এল ওয়েব একবার পরিহাস-ছলে লিখেছিলেন, কুন্দেরা ‘শো-অফ’ পছন্দ করেন। তাঁর উপন্যাস, প্রবন্ধ, সাক্ষাৎকার জুড়ে থইথই করছে রেফারেন্স। মোজেস, সক্রেটিস, বোকাচ্চিও, রাবেলাই, সার্ভেন্তিস... এবং অবশ্যই কাফকা। চেক সাহিত্যের আরেক প্রবাদপুরুষ। কুন্দেরা বিশেষ করে কাফকার কথা বলেছেন বারবার। বলেছেন, কাফকার দার্শনিক জগৎ অনতিক্রম্য। এবং, সবটুকু দিয়ে কাফকাকে আত্মীকৃতও করেছেন, তারপর খুঁজে নিয়েছেন নিজের আলাদা গন্তব্য। সে ভিন্ন আলোচনার বিষয়। আপাতত প্রশ্নটা সহজ-- কুন্দেরার সাহিত্যে, কথায়, আলাপে এত এত সাহিত্যিকের অনুষঙ্গ কেন? কুন্দেরা সাহিত্য ও নন্দনতত্ত্বের ছাত্র। স্বদেশে থাকাকালীন কুন্দেরা বিশ্বসাহিত্য পড়াতেন কলেজে। ফ্রান্সে এসেও অধ্যাপনা করেছেন। ফলে, বিশ্বসাহিত্য তাঁর প্রিয় বিষয়। কিন্তু সেটাই কি কারণ? এসব কি পাণ্ডিত্যের শো-অফ? আখ্যানের ও গদ্যের নিজস্ব যে-ধরনটি ভেঙেচুরে তৈরি করতে চাইছেন কুন্দেরা, তার অবিচ্ছেদ্য সিগনেচার? নাকি এর ভিতরেই আদতে নিহিত আছে তাঁর দর্শনের কলজে? কোনও একজাতের শিকড়? যে-শিকড় তাঁকে ছিন্নমূল হয়েও হতে দেয় না। যে-শিকড় তাঁকে বহমান রাখে উত্তরাধিকারে...
‘লাইফ ইজ এলসহোয়ার’-এর মুখবন্ধেই এর খানিক উত্তর দিয়েছেন কুন্দেরা। লিখছেন, ‘লিরিক ইজ ইয়ুথ’। দান্তের কথা টেনে বোঝাতে চাইছেন ইউরোপিয়ান ইতিহাসে কবির ভূমিকা। কবিকে ‘ন্যাশনাল আইডেন্টিটি’ হিসেবে দেখার ইতিহাস সামনে আনছেন। এবং, এই সূত্রে খুঁচিয়ে তুলছেন একটা আবহমান ইতিহাসের পথ। এই অংশে যার কেন্দ্রে কবিতা। অন্যত্র হয়তো উপন্যাস। আদতে চৈতন্যের, জাতিগত গৌরবের, অস্তিত্বের এবং দার্শনিক উত্তরাধিকারের।
‘দ্য আর্ট অব দ্য নভেল’ বলে একটা বই লিখেছিলেন কুন্দেরা। পরে তা ক্রমে কলেবরে বড়ো হয়। এই বইতে কাফকার প্রসঙ্গ বিস্তারিতভাবে আছে, আছে রিচার্ডসন, জয়েসের কথা। এবং আছে সার্ভেন্তিসের কথা। ‘দ্য ডেপ্রিসিয়েটেড লেগাসি অফ সার্ভেন্তিস’। ‘সার্ভেন্তিসের অবমূল্যায়নের উত্তরাধিকার। এই বইয়ের প্রথম অংশ। অন্যতম গুরুত্বপূর্ণও।
কুন্দেরার ইতিহাসচেতনা ইউরো-কেন্দ্রিক। এই কথা সত্য। বলা ভালো অমোঘ। ইউরোপীয় রেনেসাঁর প্রতি তাঁর সমর্পণ অসংখ্য উল্লেখে ফিরে ফিরে এসেছে। সার্ভেন্সিতের অবমূল্যায়নের উত্তরাধিকার-কে সেই বহমানতার একজাতের দার্শনিক প্রকল্প বলা যায়। কুন্দেরা ‘লাইফ ইজ এলসহোয়ারে’ স্বভাবসিদ্ধ রসিকতায় লিখেছিলেন, কবির জন্ম হতে পারে রাতে কোনও এক পার্কের বেঞ্চিতে, বন্ধুর অ্যাপার্টমেন্টে বা প্রাগের বাইরে কোনও এক রোমান্টিক জায়গায়। এহেন কুন্দেরা উপন্যাসের জন্মকে দেখছেন স্বর্গচ্যুত মানবচৈতন্যের অনির্দিষ্ট পথচলার সন্ধানের ভিতরে। গ্যালিলিও,ডারউইন, শিল্পবিপ্লব মানুষকে তার কল্পনার স্বর্গ থেকে বাস্তবে নির্বাসন দিয়েছিল। মানুষ দেখল, পুরাণ মিথ্যা। দেখল, ‘অমৃতস্য পুত্রাঃ’ আদতে ভ্রম। রেনেসাঁ যুক্তিবাদের জন্ম দিল যে-গভীরতায়, সেই গভীরতাতেই মানুষ এরপর আত্মমগ্ন হয়ে খুঁজতে বেরোল অন্দরের ভিতরের দুনিয়া। বাইরের জগৎ থেকে রোজ কমে আসছে বিস্ময়, অনির্দেশ্যতা। ভেঙে পড়ছে কল্পনার সেতু। তাই তার কল্পনার, বিস্ময়ের যাত্রা শুরু হল তার নিজের চৈতন্যে। ‘ডন কিহোতে’-র মতো নাইটের ধড়াচুড়ো পরে সে আবিষ্কার করল এক বিচিত্র দুনিয়া। যে-দুনিয়া শব্দসংকেতে আর চিত্রকল্পে ঠাসা। যে-দুনিয়াই জন্ম দেবে উপন্যাসের। মানুষের নতুন ‘মেটান্যারেটিভের’। আধুনিক পুরাণের।
কুন্দেরা এই প্রসঙ্গে উদ্ধৃত করছেন হাইডেগারকে। ‘ফরগেটফুলনেস অব বিয়িং’-এর কথা বলছেন। বলছেন, উপন্যাস ‘উইসডম অব আনসার্টেনিটি’। যে-অনির্দিষ্টতার সংকেত বদলেছে যুগে-যুগে। বদলাতে বদলাতে এসে দাঁড়াচ্ছে ক্যামু ও কাফকার আপাত অর্থহীন, নিটোল অর্থ-বিহীন উপন্যাসের দুনিয়ায়। কুন্দেরা দেখাচ্ছেন, এই ‘অর্থহীনতা’-র মধ্যেও বহমান রেনেসাঁ-প্রসূত উপন্যাসের উত্তরাধিকার। হারিয়ে যাওয়া অনন্তের অনন্ত সন্ধান।
কুন্দেরা এই উত্তরাধিকারকেই বহন করতে চান। সার্ভেন্তিসের অবমূল্যায়নের উত্তরাধিকার। প্রত্যক্ষতা উপন্যাসকে মৃতপ্রায় করে তুলেছে। কুন্দেরার অন্যান্য ভাবনা, ভাষ্যের সঙ্গে মিলিয়ে পড়লে বোঝা যায়, তিনি বিশ্বাস করেন, নানাজাতের আরোপ, ক্ষমতা, নির্দেশ সাহিত্যের স্বাধীনতাকে সীমাবদ্ধ করছে। তাঁর চোখে এই আরোপের পোশাকটা সোভিয়েত কমিউনিজমের। আরোপসঞ্জাত সীমাবদ্ধতা একজাতের বোবাকাঠামো তৈরি করছে উপন্যাসের। কুন্দেরা এই কাঠামো ভাঙতে চান। তিনি চান গদ্যকে মুক্তি দিতে। তাঁর লেখায় রসিকতা তীক্ষ্ণ ও তিতো হবে, নারীর যৌনতা প্রথার আগল মানবে না। তা স্থানভেদে নির্মম হতে পারে, কিন্তু অশালীন নয়। কমিউনিস্ট শাসকদের নিয়ে তাঁর প্রতিবাদ ঠিক হোক, ভুল হোক, তা প্রোপাগান্ডায় পৌঁছবে না। তা আখ্যানের মুক্ত পরিসরেই খেলা করবে। তাঁর উপন্যাসের গড়নে বারবার উঠে আসবে সংগীতের সাতটি স্তর। কিন্তু সেই স্তরবদ্ধতাও আসলে তাঁর উপন্যাসকে মুক্ত করবে। বিমূর্ততা আখ্যানকে ভিন্ন জমি দেবে। আর, এইসবের মধ্যে দিয়ে তিনি আদতে হাঁটবেন সার্ভেন্তিসের দেখানো পথেই। যে-সার্ভেন্তিস কুন্দেরার চোখে গ্যালিলিওর সমতুল্য। কারণ, তিনিও ইউরোপীয় আধুনিকতার জন্মদাতা।
এই আধুনিকতার উত্তরাধিকারই হয়তো কুন্দেরা বয়ে বেড়াতে চেয়েছেন। এই উত্তরাধিকারই তাঁর লেখায় বারবার বয়ে এনেছে পাণ্ডিত্যের ‘রেফারেন্স’। এই ইতিহাসকে উজ্জ্বল রাখতে গিয়েই তিনি প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখেছেন সোভিয়েতের ‘আগ্রাসন’। দেখেছেন, দেশের ইতিহাস মুছে দেওয়া হচ্ছে। যে-ইতিহাসে রেনেসাঁর আলো লেপ্টে। চেকসাহিত্যের গৌরব মুছে যাচ্ছে। পূর্ব ইউরোপে সোভিয়েতের আধিপত্য রেনেসাঁর সেই গৌরবলীন উজ্জ্বলতার কাছে, স্মৃতির কাছে বিপদের হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এই আধিপত্যের বিরোধিতাই হয়তো তাঁকে এনে ফেলছে অস্তিত্ববাদের সামনে। তাঁর দার্শনিক বিমূর্ততা আদলে প্রতিবাদকে মূর্ত করতে চাইছে। সাহিত্যের ভিতরে দাঁড়িয়ে তিনি হাত বাড়াচ্ছেন সাহিত্য-অতিক্রান্ত একটা বিরোধিতার ভূখণ্ডে। যেখানে সাহিত্যের সঙ্গে জুড়ে যাচ্ছে সংস্কৃতির ঐতিহ্য, স্মৃতি, দেশের সমষ্টিবদ্ধ নানা মূর্ত আকাঙ্ক্ষা।
আরও পড়ুন:প্রেমে খুনই শেষ সত্য নয়, ‘রক্তকরবী’-র বিশু পাগল তার প্রমাণ
হয়তো, রসিক, শ্লেষাত্মক এবং ছিন্নমূল কুন্দেরার জীবনে এই উত্তরাধিকারই শেষাবধি জীবিত একমাত্র শিকড়। তাঁকে দেশ ছাড়তে হয়েছিল। নানা বিতর্ক তাঁকে সাহিত্যিক হিসেবে আরও জনপ্রিয় করেছে। তাঁর সমস্ত অবস্থান নিন্দেযোগ্যও হয়েছে একশ্রেণির কাছে। হয়তো তাঁর অবস্থানের অন্তরালে নিহিত ব্যক্তিস্বার্থ সত্যিই ছিল। কিন্তু তাতেও তাঁর অবস্থান নেওয়ার সাহস তো নাকচ হয়ে যায় না। যিনি দেশ ছাড়তে বাধ্য হন, তাঁর সংকট তো উধাও হয়ে যায় না। সেই সংকটকে ধারণ করেছেন বলেই হয়তো তিনি সমালোচনাকেও শ্লেষের চোখে দেখেছেন আজীবন। গায়ে মাখেননি। হয়তো মজাই পেয়েছেন। তাঁর ফরসি ভাষায় লেখা শুরুর আগেই সোভিয়েত ভেঙে গেছে। সেই রাশিয়া বদলেছে। চেনা দেশটাও ক্রমে বদলেছে। কিন্তু স্মৃতির রাজনীতি অপ্রাসঙ্গিক হয়নি। কুন্দেরা, এতদিন পরে, না থেকেও তাই হাসছেন। যাচাই করছেন, তাঁর এই বিতর্কিত বা ‘শো-অফ’-এর পথচলায় কারা থেকে গেল বিরোধিতার উত্তরাধিকারী হয়ে। তাঁদের বিরোধিতার মধ্যেও যে একটা দার্শনিক ফাঁদ পাতা আছে, তা কুন্দেরা জানেন। সেই ফাঁদ, স্বাধিকারের, স্মৃতির স্বাধীনতার।