মীনাক্ষীকে ঘিরে বাম যুবদের উৎসাহের সীমা নেই, তবু অতীতই ভবিষ্যতের অন্তরায়

CPIM New Leaders: মীনাক্ষীদের ভবিষ্যতের সবচেয়ে বড় শত্রু হল তাঁদের অতীত। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ এখনও তৃণমূল-বিজেপির বিকল্প হিসেবে বামেদের ভাবতে পারছেন না।

২০১৯ লোকসভা নির্বাচনের পরে যখন প্রথম বার দেখা গেল যে পশ্চিমবঙ্গ থেকে কোনও বাম প্রার্থী সাংসদে যেতে পারলেন না, তখন এক শীর্ষ বাম নেতার সঙ্গে দলের ভরাডুবি নিয়ে কথা হচ্ছিল। কথা প্রসঙ্গে দ্বিতীয় প্রজন্মের নেতৃত্বের প্রশ্ন উঠতেই তিনি একজনের নাম নিয়েছিলেন — মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়। তাঁর দাবি ছিল যে মীনাক্ষী খুব ভাল বক্তা এবং লম্বা রেসের ঘোড়া। অভিযোগ ছিল মীনাক্ষীকে মিডিয়া তাদের আলোর তলায় আনছে না।

তখন মিডিয়ার আলো মীনাক্ষীর উপর পড়ার কথাও ছিল না। কারণ তখনও তিনি নন্দীগ্রামের মতো হাই-প্রোফাইল আসনে প্রার্থী হননি। নবান্ন অভিযানে নেতৃত্ব দেননি। আন্দোলন করতে গিয়ে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়ে জেল খাটেননি। ভাল বক্তা হিসেবে তাঁকে নিয়ে বর্ধমান-আসানসোলের সিপিআইএম দলে বা শীর্ষ নেতৃত্বের আলোচনায় এলেও, মিডিয়ার প্রচারের আলোয় আসার কথা ছিল না।

আজ পাঁচ বছর পরে বাম নেতাদের মধ্যে মীনাক্ষীই প্রচারের আলো শুষে নিচ্ছেন রাজ্য জুড়ে। তার নাম দিয়ে ইউটিউবে সার্চ করলে কয়েশ' ভিডিও উঠে আসে আজ। রাজ্য জুড়ে ৫০ দিনের ইনসাফ যাত্রা শেষ করার পর তাঁর নেতৃত্বেই ব্রিগেড সমাবেশ হচ্ছে। পাড়ায় পাড়ায় দেওয়াল লিখনে প্রধান বক্তার নাম মীনাক্ষীই।

আরও পড়ুন : অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে মাঠে বামেরা, ছাত্র-যুবদের মন কি পেল ইনসাফ যাত্রা?

আলঙ্কারিক পদটি হল ভারতের গণতান্ত্রিক যুব ফেডারেশনের রাজ্য কমিটির সাধারণ সম্পাদক। কিন্তু রাজ্যের বাম সমর্থকদের মধ্যে বেশির ভাগই মীনাক্ষীকেই নিজেদের 'ক্যাপ্টেন' বলে ধরে নিচ্ছেন। কেউ কেউ তাঁকে ভবিষ্যতের মুখ্যমন্ত্রীও মনে করছেন। বাম-বিরোধীরা একে একটু বাড়াবাড়ি মনে করতেই পারেন। এ যেন খানিকটা গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল!

কিন্তু বামপন্থী পরিবারে বড় হয়ে ওঠা মীনাক্ষীর ইউএসপি হল তাঁর সাধারণ ইমেজ। মুখে সাধারণের মতোই বুলি। একটি অদ্ভুত কথার টান। বৃন্দা কারাতদের মতো এলিটিজম তাঁর মধ্যে নেই। তাই ইনসাফ যাত্রার ভিডিওগুলোতে চোখ বোলালেই দেখা যাবে কোনও অশীতিপর বামপন্থী মহিলা সমর্থক মীনাক্ষীকে দেখার আশায় রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকেন দীর্ঘক্ষণ। কাছে এলে মীনাক্ষীকে জড়িয়ে ধরেন ঘরের মেয়ের আদরে। চোখে জল এসে যায় বৃদ্ধার।

এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বাম যুবদের মধ্যে যেমন তিনি উৎসাহের জোয়ার এনেছেন, তেমন প্রবীণদের মনেও আশার আলো দেখাচ্ছেন তিনি। মূল সিপিআইএম নেতারাও মীনাক্ষীকে জায়গা দিচ্ছেন। সুযোগ দিচ্ছেন বাম যুব আন্দোলনের মুখ হয়ে ওঠার। সেই ব্রতীন সেনগুপ্ত থেকে শুরু করে ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় হয়ে শতরূপ ঘোষ পর্যন্ত যুব নেতাদের নিয়ে অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন বামেরা। একটি পরীক্ষাও সফল হয়নি। এবার মীনাক্ষীকে নিয়েও একই ধরনের পরীক্ষা চালাচ্ছেন তাঁরা।

এখনও পর্যন্ত ছাত্র যুবদের পড়াশোনা আর কাজের অধিকারকেই স্বাভাবিক ভাবে তাঁর প্রচারে বা রাজনীতিতে প্রাধান্য দিচ্ছেন মীনাক্ষী। তৃণমূলকে এই ইস্যুতে রাজ্যে আক্রমণ করার সুবিধাও রয়েছে। বিজেপির বিরুদ্ধেও আক্রমণ শানাচ্ছেন তিনি। আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কথা বলছেন নিজের সমর্থক ও সাংবাদিকদের সঙ্গে। একটি ভাবলেশহীন মুখে কড়া কড়া কথা শুনতে ভালও লাগছে অনেকের।

মীনাক্ষীর সুবিধে যে তাঁর টিমে তিনি সেই সব যুবদের পেয়েছেন যাঁরা বামফ্রন্ট সরকারের সুখের সময়টিতে হয় জন্মাননি বা জন্মালেও ক্ষমতার সুখলাভের জ্ঞান হয়নি তাঁদের। ফলে বিরোধী ভূমিকায় নামা এই প্রজন্মের জন্য সহজ। অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার স্লোগান তাঁদের জীবনের সঙ্গে মিলে যায়। এঁদের বেশিরভাগই কিন্তু বামপন্থী পরিবারে বা আবহে বড় হয়েছেন।

কিন্তু মীনাক্ষীদের ভবিষ্যতের সবচেয়ে বড় শত্রু হল তাঁদের অতীত। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ এখনও তৃণমূল-বিজেপির বিকল্প হিসেবে বামেদের ভাবতে পারছেন না। যাঁরা বামেদের আর ভোট দেন না, তাঁরা বামেদের প্রতি বিশ্বাস হারিয়েছেন বা নতুন ক্ষমতার স্বাদ পেয়েছেন।

আরও পড়ুন : মীনাক্ষীকে কেন উপনির্বাচনে প্রার্থী করল না সিপিএম?

বিকল্প না ভাবার একটি বড় কারণ হল সেই জনগণ তিন দশকের বামফ্রন্ট সরকারের স্মৃতি ভুলতে পারেনি। তাদের ঔদ্ধত্যকে এখনও বাম বিরোধী জনগণ সহজে ভুলে যেতে পারে না। এখনও পুরনো বামপন্থী নেতারাই ভাবতে পারেন না যে তাঁরা ক্ষমতার বাইরে রয়েছেন গত বারো বছর হয়ে গেল। অনেক জায়গাতেই স্থানীয় স্তরে তাঁদের ঔদ্ধত্য ও উন্নাসিকতা এখনও অমলিন।

মীনাক্ষীদের ইনসাফ যাত্রা বা ব্রিগেড সমাবেশ দেখে তাঁদের অনেকেরই রক্ত গরম হয়ে উঠবে ঠিকই। বিধানসভাতে বিধায়ক-শূন্য হয়েও অনেকেই মনে করবেন পরের নির্বাচনে তাঁরাই আবার বামফ্রন্ট সরকার গড়বেন। কিন্তু বাম আন্দোলনে নতুন রক্ত না বইলে তাঁদের জন্য কাজের কাজ কিছুই হবে না। অথচ পুরনো রক্তই এখনও বামপন্থীদের বেশিরভাগের শিরা-ধমনীতে বয়ে চলেছে।

কেন যে ২০১১ নির্বাচনে ভরাডুবি হল, কেন ২০১৯-এ বাম ভোটে রামে গিয়ে নোঙর ফেলল, কেনই ২০২১-এ এসে বিধানসভায় কোনও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি তাঁরা পাঠাতে পারলেন না—এ'সব নিয়ে যথাযথ পর্যালোচনাই সিপিআইএম নেতারা করলেন না। যেটুকু করলেন তার প্রেক্ষিতে ব্যবস্থাও নিলেন না। তাই কংগ্রেসকে গলায় জড়িয়ে ধরতে হল বা আব্বাসকে মঞ্চে তুলে ধরতে হল। নিজেদের রাজনীতি ডুবে গেল গড্ডালিকায়।

কাজের দাবি যে কোনও যুবক-যুবতীর মনের কথা। বামপন্থীরা ধর্ম ও পরিচয়ের রাজনীতি ছেড়ে অর্থনৈতিক দাবির রাজনীতি করবেন এটাও স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু ভারতবর্ষের রাজনীতি গত এক দশকে তার রং পাল্টেছে খুব দ্রুত। ধর্ম ও পরিচয়ের রাজনীতি মূলধারার রাজনীতিতে জায়গা করে নিয়েছে। মন জয় করেছে শিক্ষিত যুবক-যুবতীরও।

এই পরিস্থিতিতে মীনাক্ষীদের বিকল্প রাজনীতির আলেখ্য তৈরি করতে হবে। শুধুমাত্র বামপন্থী পরিবারে বা আবহে বেড়ে ওঠা যুবক-যুবতী নয়, তৃণমূল-বিজেপিতে আকৃ্ষ্টদেরও নিজেদের দিকে টানতে হবে।

সিপিআইএম-এর বৃদ্ধ নেতারা মীনাক্ষীদের নতুন পথে হাঁটার কতটা সুযোগ করে দেবেন বা কতটা সঠিক দিশা দেখাবেন, তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। তাই বামেদের অতীতই বামেদের ভবিষ্যতের জন্য বড় অন্তরায়। মীনাক্ষী ঠিকই বলেছেন একজনের মুখের উপর শুধু রাজনীতি নির্ভর করে না। কোন রাজনীতির প্রতিনিধিত্ব সেই মুখ করছেন জনগণের কাছে সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। তা যেমন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্য সত্যি ছিল, তেমনই মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়ের।

More Articles