৩ বার তাজমহল, ২ বার লালকেল্লা বিক্রি করে দিয়েছিলেন ভারতের সবচেয়ে বড় ঠগ নটওয়ারলাল!

Mister Natwarlal: জীবদ্দশায় তাঁর উপর প্রায় ৪০০ টিরও বেশি জালিয়াতির মোকদ্দমা চলছিল। তার মধ্যে ১৯ টি মামলার রায়দান হয় যেখানে তাঁকে মোট ১১৩ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

এবারও বউয়ের লেখা চিঠি পড়ে নিরুত্তাপ কয়েদি। অবাক হচ্ছেন জেলারও। গত দুই মাস ধরে প্রতি সপ্তাহে নিজের দুর্দশার কথা জানিয়ে ক্রমাগত স্বামীকে চিঠি পাঠিয়ে যাচ্ছেন স্ত্রী, কিন্তু স্বামী নির্বিকার। জেলের নিয়ম অনুযায়ী বাইরে থেকে কোনও পত্র যদি ভেতরে আসে এবং ভেতর থেকে কোন পত্র যদি বাইরে যাওয়ার হয়, তাহলে তা সবার আগে জেলারকে পড়াতে হয়। জেলার পড়ে সম্মতি দিলেই সেই পত্র ভেতরে বা বাইরে যেতে পারে। স্বাভাবিকভাবেই ওই চিঠিগুলিও পড়েছিলেন জেলার। এহেন কঠিন পরিস্থিতি সত্ত্বেও এমন ধুরন্ধর কয়েদির এই নিস্পৃহতা তাঁকে ভাবাচ্ছিল। একদিন বাধ্য হয়ে তিনি ওই কয়েদিকে জিজ্ঞেস করেই ফেললেন, “কী হে, তোমার স্ত্রী নিজের সমস্যা জানিয়ে এত চিঠি পাঠাচ্ছে তোমাকে, অথচ তুমি তো কোনও উত্তরই দিচ্ছ না।” প্রত্যুত্তরে ওই কয়েদি বলেন, “আপনি যখন বলছেন সাহেব তাহলে এবার একটা উত্তর লিখে পাঠিয়ে দেব।” নিজের কথা মতো সেই কয়েদি স্ত্রীর উদ্দেশ্যে চিঠি লিখলেন। কিন্তু যা লিখলেন তাতে হইচই পড়ে গেলে জেলে।

ওই চিঠিতে কয়েদি লিখেছিলেন, “তুমি তো জানোই আমাদের ক্ষেতে সোনা পোঁতা রয়েছে, তুলে বিক্রি করে দাও।” চিঠি ওই কয়েদির স্ত্রীর কাছে যাওয়ার আগেই পুলিশ গ্রামে চলে গিয়েছিল সোনা উদ্ধারে। কয়েকশো লোক লাগিয়ে পুরো জমি খুঁড়ে ফেলেও সোনা মেলেনি। কয়েকমাস বাদে জেলে কয়েদির স্ত্রীর চিঠি এল, তাতে লেখা পুলিশরা ক্ষেত চষে দিয়ে যাওয়ার ফলে ফসল এবার খুব ভালো হয়েছে। জানলে অবাক হবেন ছোটবেলার এই গল্প আদৌ গল্প নয়, ঘোরতর বাস্তব! ঘটনাটি ঘটে লখনউ সেন্ট্রাল জেলে এবং ওই কয়েদির নাম ছিল নটওয়ারলাল। ওই জেলের পুলিশি রেকর্ডে এই ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ রয়েছে।

১৯১২ সালে বিহারের জিরাদেই গ্রামে জন্ম হয় মিথিলেশ কুমার শ্রীবাস্তবের, যাঁকে বর্তমানে গোটা দেশ চেনে নটওয়ারলাল নামে। ঘটনাচক্রে ওই একই গ্রামে জন্মেছিলেন ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ। ভাগ্যের পরিহাস, দু’জনেই ওই একই স্টেশন থেকে ট্রেন ধরেছিলেন জীবন বদলাতে। একজন সংসদে পৌঁছে দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি হলেন অপরজন সেই সংসদকেই বিক্রি করে দিলেন! অবাক হচ্ছেন? তবে শুরু থেকে শুরু করা যাক।

মিথিলেশ নিজের জীবনের প্রথম জালিয়াতি করেন ১৭-১৮ বছর বয়সে। স্থানীয় এক বৃদ্ধ তাঁকে শহরের ব্যাঙ্কে ড্রাফট জমা করতে দিয়েছিলেন। তাঁর নকল করার ক্ষমতা ছিল ঈশ্বরপ্রদত্ত। জমা করার সময় ড্রাফটে ব্যক্তির সই দেখে নকল করে নেয় মিথিলেশ। তারপর খেপে খেপে প্রায় ১০০০ টাকা অ্যাকাউন্ট থেকে তুলে নেয়। এই কুকর্মের কথা জানাজানি হতেই তাঁর বাবা তাঁকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেন, মিথিলেশ গিয়ে পৌঁছয় কলকাতায়। এই কলকাতায় থাকতে থাকতেই বছর আঠেরোর তরুণ মিথিলেশ হয়ে ওঠে নটওয়ারলাল। কলকাতায় একজন মাড়োয়ারি শেঠের কাছে কাজে ঢোকে নটওয়ারলাল। শোনা যায় প্রথম সেখানেই এই ‘নটওয়ারলাল’ নামটি ব্যবহার করে সে। সেখানে কয়েক বছর কাজ করে ওই মাড়োয়ারি শেঠের সাড়ে চার লাখ টাকা হাতিয়ে চম্পট দেয় নটওয়ারলাল। তিরিশের দশকে এই টাকার পরিমাণ ছিল অনেক। এভাবেই অপরাধ জগতে পা রাখে ভারতের সবচেয়ে বড় ঠগ, মিস্টার নটওয়ারলাল। তাঁর সবচেয়ে বড় অস্ত্র ছিল দু’টি- সই নকল এবং ছদ্মবেশ ধরার ক্ষমতা।

 

একবার নিজের ছদ্মবেশ ধারণের অসামান্য ক্ষমতা দিয়ে দিল্লির পোড়খাওয়া ব্যবসায়ীদের ঘোল খাইয়ে দিয়েছিলেন নটওয়ারলাল। ১৯৮৫ সালের ঘটনা। দিল্লির কানৌট প্লেসে একটি নামী ঘড়ির দোকানে সাদা কুর্তা পাজামা পরে ঢুকলেন নটওয়ারলাল। নিজের পরিচয় দিলেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী নারায়ণ দত্ত তিওয়ারির পিএ হিসেবে। ঘড়ির দোকানে জানালেন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী একটি বৈঠক ডেকেছেন। সেখানে উপস্থিত সকল হাই প্রোফাইল সাংসদ এবং মন্ত্রীদের রাজীব গান্ধী ঘড়ি উপহার দিতে চান। সুতরাং তাঁকে যেন সবচেয়ে ভাল এবং দামি ঘড়িগুলি দেখানো হয়। সব মিলিয়ে মোট ৯৩টি ঘড়ি কেনেন নটওয়ারলাল। ঘড়ির দোকানের মালিককে তিনি বলেন তাঁর সঙ্গে কাউকে পাঠিয়ে দিতে তাঁর নর্থ ব্লকের বাংলোতে। সেখানে তিনি ড্রাফট দিয়ে দেবেন। ইংরেজিতে তুখোড় ছিলেন নটওয়ার। এহেন ভদ্র সভ্য সম্ভ্রান্ত চেহারার লোক যে জালিয়াত হতে পারে তা কল্পনাও করতে পারেননি ওই ঘড়ির দোকানের মালিক। ঘড়ির দোকানের একটি লোককে সঙ্গে নিয়ে নর্থ ব্লকের একটি বাংলাতে যান নটওয়ারলাল, ড্রাফটও দেন। কিন্তু ড্রাফট জমা করাতে গিয়ে দেখা যায় ড্রাফটাই নকল! শোনা যায়, নটওয়ারলাল সমাজসেবী বা বিশিষ্ট কোনও কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর সেক্রেটারি বা কোনও বড় দলের নেতা সেজে বড় অঙ্কের চাঁদা বা ডোনেশন নিয়ে আসতেন টাটা-বিড়লা-আম্বানিদের কাছ থেকে। নিখুঁত নথি ও অসামান্য বাকপটু হওয়ায় তাঁরা কেউই সন্দেহই করেননি তাঁকে।

আরও পড়ুন- কুমিরকে ভোগ দিয়ে লাশ লোপাট! ভারতীয় সিরিয়াল কিলার চিকিৎসকের গল্প হার মানাবে ক্রাইম থ্রিলারকে

জানলে অবাক হবেন একবার বা দুইবার নয়, পুরো তিন তিনবার তাজমহল বিক্রি করে দিয়েছিলেন নটওয়ারলাল। একবার আমেরিকা থেকে তাজমহল দেখতে এসেছিলেন এক নবদম্পতি। তাজমহলের সৌন্দর্য দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়েছেন তাঁরা। এই অপার্থিব সৌন্দর্য প্রত্যক্ষ করছেন এবং ভাবছেন যদি তাঁরা তাজমহলের মালিক হতে পারতেন। তাঁরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিলেন যদি কোনওভাবে এই ভালবাসার চিহ্ন সারা জীবনের মতো তাঁদের নামে করে দেওয়া যেত। এমন সময় হাজির নটওয়ারলাল। মানুষকে নিজের কথায় ফাঁসাতে ওস্তাদ ছিলেন তিনি। মার্কিন দম্পতির সব কথাই পেছন থেকে শুনছিলেন নটওয়ার। সটান ওই দম্পতির সামনে গিয়ে নটওয়ারলাল বললেন, “আপনারা চাইলেই কিনে নিতে পারেন এই পুরো তাজমহল। আমি ভারত সরকারের কর্মচারি। আমাদের মতো আরও কয়েকজনের হাতে এই তাজমহল বিক্রির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আমাদের দেশের দৈন্য দশার কথা তো আর কারও অজানা নয়। মানুষের মুখে অন্ন তুলে দিতে হিমশিম খাচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকার। তার উপর হাজার হাজার টাকা খরচ করে এই তাজমহলের রক্ষণাবেক্ষণ করা আমাদের দ্বারা অসম্ভব।” নটওয়ারলালের এই কথাতেই গলে গেলেন ওই মার্কিন দম্পতি। পরদিন সুচারুরূপে নকল দলিল বানিয়ে তাজমহল কেনাবেচা হয়ে গেল মোটা টাকায়! পরে তাজমহলের দখল নিতে গিয়ে ওই মার্কিন দম্পতির যা নাজেহাল অবস্থা হয়েছিল তা বলার মতো নয়। কথায় বলে মানুষ ভুল করে শেখে, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ফিরিঙ্গিরা শেখেনি। তাই তো শুধু একবার নয়, তিন তিনবার বিদেশি দম্পতিদের কাছে তাজমহল বিক্রি করেছেন নটওয়ারলাল। শুধুই কি তাজমহল? দু’বার লালকেল্লা, একবার রাষ্ট্রপতি ভবন এবং একবার ৫৪৫ জন সাংসদসহ সংসদটাই বিক্রি করে দিয়েছিলেন ঠগ শিরোমণি নটওয়ারলাল।

নটওয়ারলাল নিজের জীবনের অধিকাংশ জালিয়াতিই করেছেন সই নকল এবং ছদ্মবেশ ধারণ করে। জীবদ্দশায় তাঁর উপর প্রায় ৪০০ টিরও বেশি জালিয়াতির মোকদ্দমা চলছিল। তার মধ্যে ১৯ টি মামলার রায়দান হয় যেখানে তাঁকে মোট ১১৩ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। কিন্তু ঘটনাচক্রে মাত্র ২০ বছর জেলে রাখা গিয়েছিল তাঁকে। নটওয়ারলাল প্রথম হাজতবাস করেন ১৯৪২ সালে। সেই থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত মোট ৯ বার জেল থেকে পালিয়েছেন তিনি। ৮ বার পুলিশ তাঁকে ধরতে পারলেও শেষবার অর্থাৎ নবম বার তাঁকে আর ধরা যায়নি। একবার তো জেলের পুলিশরাই তাঁকে সাহায্য করেছিলেন পালাতে! ১৯৫৭ সালের লখনউ সেন্ট্রাল জেলের ১১ জন পুলিশকর্মীকে প্রায় ৫ লক্ষ টাকা ঘুষ দিয়ে জেল থেকে পালিয়েছিলেন তিনি। পরে টাকা গুনতে গিয়ে দেখা যায় সবকটি নোটই নকল।

আরও পড়ুন- পৃথিবীর শেষ কোথায়? পাহাড় ঘেরা ছোট্ট শহর উশুইয়াই আজও বিস্ময়ে ভরা

তবে তাঁর সবচেয়ে চর্চিত পলায়ন ছিল ১৯৯৬ সালে। তখন পায়ের সমস্যার জন্য চলাফেরা করতে পারছেন না ৮৪ বছরের বৃদ্ধ নটওয়ারলাল। আদালত নির্দেশ দিল কানপুর থেকে নিয়ে এসে দিল্লি এইমসে চিকিৎসা করাতে হবে তাঁকে। কানপুর থেকে ট্রেনে করে দিল্লিতে নিয়ে আসা হয় নটওয়ারলালকে। ট্রেন থেকে নামিয়ে আবার হুইল চেয়ারে বসানো হয় তাঁকে। সেসময় তিনজন পুলিশ সঙ্গী ছিলেন নটওয়ারের। এদের মধ্যে অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করতে যান একজন, আরেকজন যান জলের বোতল আনতে। তৃতীয়জন নিজের এক পরিচিতর সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়ায় গল্প জুড়ে দেন তাঁর সঙ্গে। সেই তৃতীয় পুলিশ কিছুক্ষণ পর ফিরে দেখেন হুইল চেয়ার ফাঁকা! হাওয়ায় মিলিয়ে গেছেন নটওয়ারলাল। কেউ ভাবতেও পারেনি বিগত কয়েক মাস ধরে এভাবে সুন্দরভাবে অভিনয় করে, পুলিশদের বোকা বানিয়ে পালিয়ে যাবেন বৃদ্ধ অশীতিপর নটওয়ারলাল।

এরপর অবশ্য কেউ আর কোনদিনও তাঁকে দেখতে পাননি। ২০০৯ সালে নটওয়ারলালের উকিল আদালতে জানান নটওয়ারলাল ২৫ জুলাই মারা গেছেন তাই বিচারাধীন মামলাগুলি খারিজ করে দেওয়া হোক। অবশ্য পরিবারের তরফে জানানো হয় ১৯৯৬ সালে রাঁচিতে একটি পথ দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান নটওয়ারলাল। গোটা দেশের কাছে তিনি জালিয়াত হলেও নিজের গ্রাম জিরাদেইয়ের লোকের কাছে ভগবান। বড়লোকেদের থেকে জালিয়াতি করে টাকা হাতিয়ে তিনি বিলিয়ে দিতেন গরিবদের মধ্যে। ওই গ্রামে আজও নটওয়ারলালের পৈতৃক ভিটে রক্ষণাবেক্ষণ করেন গ্রামের মানুষরা। সেখানে গিয়ে নটওয়ারলালের নামের আগে ‘বাবু’ বা ‘মিস্টার’ না লাগালে আপনি বিপদে পড়তে পারেন। এহেন সম্মান ওই গ্রামে আরেকজন ব্যক্তিকেই দেওয়া হয়, ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ।

More Articles