বিশ্বগুরু হওয়ার পথে মোদি! সরকার পতনের দিবাস্বপ্ন দেখা বন্ধ করুক বিরোধীরা

Narendra Modi 3.0: নীতীশ ও চন্দ্রবাবুর মোট ২৮ জন সাংসদের সমর্থন নিয়েও বিরোধী জোট সরকার গড়ার জন্য ম্যাজিক সংখ্যা ২৭২-এ পৌঁছতে পারবে না।

লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশ হওয়ার পরে খুব স্বাভাবিকভাবেই বিরোধী শিবির উজ্জীবিত। নিজেরা সরকার না গড়তে পারলেও, বিজেপিকে যে শরিকদের ভরসায় সরকার চালাতে হচ্ছে এই নিয়েই খুশি বিরোধী শিবির। জোট সরকার চালানোয় অনভিজ্ঞ নরেন্দ্র মোদি যে অচিরেই বিপাকে পড়বেন, তা ভেবেও উল্লসিত বিরোধীরা। এর সঙ্গেই নাম না করে নরেন্দ্র মোদিকে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের প্রধান মোহন ভাগবতের কড়া বার্তা নিয়েও বেজায় প্রফুল্ল মোদি-বিরোধী শিবির। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে শুরু করে মল্লিকার্জুন খাড়্গে সবাই যেন দিন গুনছেন, কবে নীতীশ কুমার ও চন্দ্রবাবু নাইড়ু পাল্টি খেয়ে তাঁদের দিকে আসবেন, আর মোদি সরকারের পতন হবে।

ব্যাপারটি কিন্তু অত সহজ নয়।

ভারতের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যে শাসক-বিরোধী দলের ভারসাম্য বজায় রাখার রীতি এখনও অটুট রয়েছে এটুকুই এই লোকসভা নির্বাচন থেকে বড় প্রাপ্তি। নিজেকে ভগবানের সমতুল্য ভাবা নরেন্দ্র মোদিকে যে সেই আসন থেকে ভারতের নির্বাচকেরা নামিয়ে এনেছেন, সেটিই গণতন্ত্রের জয়। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, এই নির্বাচনে বিজেপি সংখ্যালঘু দল হয়ে যাওয়ায় নরেন্দ্র মোদি হতোদ্যম হয়ে পড়বেন।

তিনি মাঠ ছেড়ে এখনই বেরিয়ে যাওয়ার পাত্র নন। তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্যসভা সাংসদ সাগরিকা ঘোষ একটি প্রবন্ধে নরেন্দ্র মোদির রাজনৈতিক চরিত্র বিশ্লেষণ করতে গিয়ে সঠিকভাবেই বলেছেন যে, এই প্রধানমন্ত্রীর দু'টি সত্ত্বা রয়েছে। একটি হচ্ছে 'নির্বাচনী প্রধানমন্ত্রী' এবং অন্যটি হচ্ছে ভোট-বিহীন সময়ের প্রধানমন্ত্রী।

প্রথম সত্ত্বাটি নির্বাচনী প্রচারের সময় জেগে ওঠে। তখন তিনি কটূ কথা বলা থেকে শুরু করে দেশের ছোটখাটো সমস্যা বা ইস্যু নিয়ে কথা বলতে থাকেন কিন্তু নির্বাচন পর্ব মিটে যাওয়ার পরে তিনি এসব বিষয়ে আর বিশেষ কথা বলেন না। এমন ভাব দেখান যে, তিনি এই তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে মাথাই ঘামান না। তাঁর সামনে তখন আরও বড় কাজ!

আরও পড়ুন- স্বাধীনতার পর এই প্রথম! দেশের মন্ত্রিসভায় ঠাঁই হল না একজন মুসলিম সাংসদেরও

এই কলমচিও আগের একটি প্রবন্ধে লিখেছিল, পাঁচ বছরের মধ্যে নরেন্দ্র মোদি ৫৭ মাস নিজেকে সব কিছুর ঊর্ধ্বে বলে মনে করেন। ২০২৪-এর নির্বাচনের পরে তিনি আরও বেশি করে নিজেকে সব কিছুর ঊর্ধ্বে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবেন। এটিই নরেন্দ্র মোদির শেষ পর্ব প্রধানমন্ত্রী হিসেবে। বিজেপির নিয়ম মানতে গেলে ৭৫ বছর বয়স হয়ে গেলে তিনি দলের মার্গদর্শক মণ্ডলীতে চলে যাবেন। ইতিমধ্যেই তাঁকে মার্গদর্শক মণ্ডলে জায়গা দেওয়া হয়ে গেছে। ধরে নেওয়া যায় তিনি পরবর্তী নির্বাচনে আর প্রধানমন্ত্রী পদের দাবিদার হবেন না।

যদিও তিনি জওহরলাল নেহরুর তিনবারের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার রেকর্ড ছুঁয়ে ফেলেছেন কিন্তু তিনি ২০২৪-এ বুঝে গেছেন যে, তিনি দেশের একমেবাদ্বিতীয়ম নেতা নন। তিনি পশ্চিমবঙ্গ জয় করতে পারেননি। দক্ষিণ ভারতে চন্দ্রবাবু নাইড়ুর ঘাড়ে চেপে আসন সংখ্যা বাড়লেও বা তামিলনাড়ু ও কেরলে ভোট শতাংশ বাড়লেও তিনি একার চেষ্টায় এই রাজ্যগুলি থেকে আসন সংখ্যা বাড়াতে পারেননি। উত্তরপ্রদেশে তাঁর নিজের আসনে জয় এলেও ভোটের ব্যবধান কমেছে এবং বিজেপির আসন সংখ্যাও অর্ধেক হয়ে গেছে প্রায়।

এই অবস্থায় তিনি এবার দেশের দিকে নয় বেশি করে নজর দেবেন বিশ্বের দিকে। তাঁর লক্ষ্যই হবে প্রকৃত অর্থে 'বিশ্বগুরু' হওয়া। নরেন্দ্র মোদি তাঁর প্রধানমন্ত্রীত্বের প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়েও নিজেকে বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী নেতা হিসেবে তুলে ধরতেই ব্যস্ত ছিলেন। ২০১৪ সালের পরে বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজকে আড়ালে রেখে নিজেই বিশ্বভ্রমণে বেরিয়ে পড়েছিলেন নরেন্দ্র মোদি। ২০১৯-এর পরে সেই ভ্রমণে কিছুটা ভাটা পড়লেও, জি-২০ সম্মেলনের প্রধান হিসেবে দিল্লিতে এবং সারা দেশে নিজের বিশ্বগুরু-ইমেজের প্রদর্শনী ভালোই করেছিলেন মোদি।

এবারেও শপথগ্রহণের পরপরই সুযোগ পেয়েই তিনি জি-৭ রাষ্ট্রপ্রধানদের বৈঠকে আমন্ত্রণ রক্ষা করতে ইতালিতে উড়ে গেছেন। যদিও সারা বিশ্ব জানে যে এবার ভারতে তাঁর সরকারের শক্তি কমে গেছে, তবু তিনি বিশ্বনেতা হিসেবে নিজের ইমেজকে কিছুতেই খাটো হতে দেবেন না। তাঁর সেই প্রচেষ্টা চলবেই।

আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত ভোটের প্রচারে শিষ্টাচার মানা হয়নি এবং একজন সেবকের অহংবোধ থাকতে নেই বলার পাশাপাশিই যে কয়েকটি বিষয়ে নরেন্দ্র মোদি সরকারের কাজের প্রশংসা করেছেন তার মধ্যে কিন্তু নরেন্দ্র মোদির বিদেশনীতি রয়েছে। কাজেই মোদি দেশে না হোক, একজন শক্তিশালী নেতা হিসেবেএখন বিশ্ব রাজনীতিতে দাগ রেখে যাওয়ার কাজে যে বেশি মনোযোগ দেবেন এই নিয়ে সন্দেহ নেই।

তার মানে এই নয় যে বিরোধীদের খুশি করে দিয়ে নরেন্দ্র মোদি সরকারের পতন খুব শিগগিরি হয়ে যেতে পারে। নীতীশ কুমার এবং চন্দ্রবাবু নাইড়ু — দু'জনের কেউই ভরসাযোগ্য রাজনীতিক নন। তবে এটিও বেশি বাড়াবাড়ি রকমের প্রত্যাশা যে তাঁরা একটি সরকার তৈরি করেই তার উপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেবেন।

চন্দ্রবাবু নাইড়ু সবে অন্ধ্রপ্রদেশে ক্ষমতায় এসেছেন। অর্থনৈতিকভাবে বিপাকে পড়া রাজ্যকে চাঙ্গা করতে তাঁকে কেন্দ্রের সাহায্য পেতেই হবে। প্রথমে তাঁকে রাজ্য সরকারে জমিয়ে বসতে হবে। তার পরে তিনি কেন্দ্রে কলকাঠি নাড়ার কথা ভাববেন।

অন্যদিকে, নীতীশের কাছে বিজেপি বড় ভরসা। বিহারে বিধানসভা নির্বাচন আরও দেড় বছর দেরি রয়েছে। বিহারে বিজেপির হাত ধরে তিনি লোকসভা নির্বাচনে বেশ ভালোই ফল করেছেন। কেন্দ্রে সবে একটি সরকার এসেছে। তিনি হঠাৎ করে কেন নরেন্দ্র মোদি সরকারের উপর থেকে সমর্থন প্রত্যহার করে নেবেন! তিনি হাওয়া বুঝে চলার রাজনীতিক। এখনও যা বোঝা যাচ্ছে তিনি এমন কোনও হাওয়ার হদিশ পাননি যে বিরোধীদের সঙ্গে হাত মেলাবেন।

সুতরাং বিরোধীদের মোদি-সরকার পতনের দিবাস্বপ্ন দেখা বন্ধ হোক। বরং শক্তিশালী বিরোধী হিসেবে তাঁরা সরকারের প্রতিটি কাজের চুলচেরা বিচার করুক। যেখানেই সরকারকে চাপে রাখা দরকার সেখানেই সংসদের ভিতরে ও বাইরে চাপ বজায় রাখুক।

আরও পড়ুন- বিফলে গেল ক্যামেরামুখী ধ্যান! বিবেকানন্দের কাছেই হেরে গেলেন নরেন্দ্র মোদি?

মনে রাখতে হবে, নীতীশ ও চন্দ্রবাবুর মোট ২৮ জন সাংসদের সমর্থন নিয়েও বিরোধী জোট সরকার গড়ার জন্য ম্যাজিক সংখ্যা ২৭২-এ পৌঁছতে পারবে না। উল্টোদিকে বিরোধী ইন্ডিয়া জোটের শরিক দলের সংখ্যা অনেক বেশি। যেখানে বিজেপি ২৪০টি আসন নিয়ে একক বৃহত্তম দল, সেখানে কংগ্রেস ৯৯ তে।

যে দাপট নিয়ে বিজেপি জোট সরকার চালাতে পারবে, সেই দাপটে কংগ্রেস জোট সরকার পরিচালনা করতে পারবে না। আর নয়তো ১৬ সাংসদের দলের চন্দ্রবাবু নাইড়ুকে বা ১২ সাংসদের দলের প্রধান নীতীশ কুমারকে বা অন্য কাউকে প্রধানমন্ত্রী করে সরকার চালাতে হবে। বিরোধীদের জন্য সে একটি কঠিন কাজ।

ইতিমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রকগুলি নিজেদের হাতে রেখে নরেন্দ্র মোদি প্রমাণ করে দিয়েছেন যে, তাঁর দল বিজেপি সংখ্যালঘু হলেও জোট সরকারের রাশ এখনও তাঁর হাতেই। বিরোধী ইন্ডিয়া জোটের সরকার হলে সেই রাশ কার হাতে থাকবে বা কে কে সরকারকে বাইরে থেকে সমর্থনের রাস্তায় যাবেন, তা নিয়েও জল্পনা চলতে পারে।

মহারাষ্ট্র, ঝাড়খণ্ড ও হরিয়ানার নির্বাচনে বিজেপির শক্তিক্ষয় হলে কেন্দ্র সরকারের উপর তার প্রভাব পড়তে পারে কিন্তু সেই প্রভাবে সরকার পড়ে যাবে কিনা তা নিয়ে এই মুহূর্তে সংশয় থেকে যাচ্ছে।

এই পরিস্থিতিতে বিরোধী দলগুলির দায়িত্ব এনডিএ সরকারের ত্রুটি বিচ্যুতি ও মানুষের খাওয়া, পড়া, চাকরির মতো ইস্যুগুলি নিয়ে সরব হওয়া। ভারতের বহুত্ববাদকে রক্ষা করা। গণতন্ত্রকে সচল রাখা। সরকার কবে ভূপতিত হবে সেই চিন্তা কিছুদিনের জন্য শিকেয় তুলে রেখে এই গুরুত্বপূর্ণ কাজে মন দিক তারা।

More Articles