‘আমায় রবি ঠাকুর বানিয়ে দে মা!’ মোহন ভাণ্ডারিকে দেশ চিনল যে গল্পে
চিমনির দিকে তাকিয়ে সে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। এখন, এই ভাঁটার পাশে একটা গাছতলায় শুয়ে শুয়ে ছোটবেলাটাকে খুঁচিয়ে আরাম মেলে বেশ! ধুলোয় ঢাকা পা পেরিয়ে গেলে সে ছোটবেলা নরম লাগে ভীষণ। আজকের হাড্ডিসার শরীর তাতে আরো ভারী হয়। ভাঁটার চিমনির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নিজের বাতিল মানুষটুকুর সঙ্গে সে চিমনিটার মিল পেতে থাকে খুব। বন্ধ ভাঁটার বাতিল একখান চিমনি, সমস্ত কিছুর সঙ্গে যে নিজেকেও জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাক করে ফেলেছে ধীরে ধীরে। এখন ধোঁয়াও আর তার সঙ্গ দেয় না!
—এই গল্পই বিখ্যাত করেছিল মোহন ভাণ্ডারিকে। পাঞ্জাবি ছাত্রদের পাঠ্যবইয়ে এই গল্প জায়গা করে নিয়েছিল প্রায় কয়েক দশক। পাঞ্জাবের স্বনামধন্য লেখক মোহন ভাণ্ডারী এ বছর নভেম্বরের ২৬শে চলে গেলেন চিরঘুমের দেশে।
১৯৩৭ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি পাঞ্জাবের সাংগ্রুর জেলার বনবহুরা গ্রামে ভাণ্ডারির জন্ম। বাবার একটা ছোট্ট দোকান ছিল। তবে বাবার জুয়ার নেশা সেই দোকান, পরিবারের জমানো পুঁজি—সব আত্মসাৎ করে। সে অর্থে অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না ভাণ্ডারীদের। কিন্তু সেই গ্রাম ছোট্ট বুকের নরম মাটিতে এমন শিকড় ছড়ালো, শেষ জীবন অবধি যার টুকটাক সবুজ পাতা ফুল ঝরে পড়ত তাঁর গল্পের আনাচে কানাচে। বিখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব ডঃ আত্মজিৎ অনেক পরে ভাণ্ডারির ‘ঘোট্না’ গল্পটি বিশ্লেষণ করে দেখাবেন, কত সাবলীল ভাবে শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার যন্ত্রণা, একাকীত্বের ছবি এসে গিয়েছে লেখকের কলমে। শহর চণ্ডীগড়ের বাসিন্দা যে গুটিকয় লেখক গ্রামকে মর্মে মর্মে চিনতেন, মোহন ছিলেন তাঁদেরই একজন।
জীবনের প্রথম গল্পটি লিখেছিলেন ক্লাস নাইনে পড়তে। এরপর তাঁকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি। ভাণ্ডারীকে মূলত ছোট গল্পকারই বলা যায়। বর্তমানের দীর্ঘ ক্লান্ত ছায়া তাঁর প্রায় সমস্ত ছোট গল্পতেই। সাংগ্রু থেকে চণ্ডীগড়, একে একে গড়ে উঠবে লেখকের সাতটি ছোটগল্পের সংগ্রহ, যার মধ্যে পাঁচটি অনূঅদিত হবে উর্দু ও হিন্দিতে। ১৯৮৪ এবং তার পরবর্তী পরিবেশ ক্রমে ঠাঁই পাবে ‘মুন দি আখ’ বইটিতে। বইটি ১৯৯৭ সালে সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কার পায়। এছাড়াও সারাজীবন অনুবাদ করেছেন, সম্পাদনা করেছেন বিভিন্ন গ্রন্থ। সমাজ ও সাহিত্য তাঁর কাছে হয়ে উঠেছিল পরস্পরের আয়না। ২০১৫ সালে সাম্প্রদায়িকতার প্রতিবাদে, অসহিষ্ণুতার প্রতিবাদে অন্যান্য অনেক শিল্পীর সঙ্গে মোহন ভাণ্ডারিও এই পুরস্কার ফিরিয়ে দেন। “ব্যথিত হই, এই অসহিষ্ণুতা, এই সাম্প্রদায়িকতা প্রতিটা মুহূর্তে আমাদের আহত করে, তাই আমরা রুখে দাঁড়িয়েছি। পুরস্কার ফিরিয়ে দেওয়া দেশের এই অস্বস্তিকর পরিবেশের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ মাত্র!” বলেছিলেন ৭৮ বছর বয়সি এক বৃদ্ধ, উজ্জ্বল দৃষ্টিতে ঝরে পড়ছিল আত্মবিশ্বাস।
নিজের সম্বন্ধে বিরাট কিছু ধারণা ছিল না। ছিল না রিফর্মার হওয়ার ইচ্ছেও। অনন্ত মানব চরিত্রের স্রোত—তার এক একাগ্র ছাত্র, এইমাত্র। সেক্টর ১৭য় চণ্ডীগড়ের কফিহাউস কালচারের প্রাণপুরুষ ছিলেন বলা যায় তাঁকে। পাঞ্জাব এডুকেশন ডিপার্টমেণ্টে চাকরি করতেন বন্ধু-বৎসল মানুষটি। লাঞ্চ খেতেন রোজ ভূষণ ও অমল গিরি, দুই সাহিত্যিক বন্ধুর সঙ্গে। চিত্রশিল্পী রাজ কুমারকেও কখনও কখনও দেখা যেত সেই আসরে। কফি আর ধোঁয়ার আড্ডায় ভেসে আসত সাহিত্যের টুকরো টাকরা নানা প্রসঙ্গ।
‘তিল চাওলি’, ‘মানুখ দে পর’, ‘কাথ দি লট’, ‘পচ্চন’, ‘মুন দি আখ’, ‘বারফ লাতারে রুখ’, ‘তন পত্তন’, ‘কথা ওয়ার্তা’ — এই সব গল্প থেকে যাবে। এছাড়া থেকে যাবে ‘ম্যায়নু টেগোর বনা দে, মা’, যে গল্পটি লেখককে জনপ্রিয়তা দিয়েছিল। এক দিনমজুরের গল্প। গাছতলায় শুয়ে শুয়ে সে ভাবে ছেলেবেলার কথা। কেরানি তাকে রিসিপ্টটা দিলেই সে বেরোয়। কিন্তু ঘণ্টা দুই হল কেরাণীর দেখা নেই। সকাল থেকে বার চারেক টিপ মেরেছে সে তার তিনটি গাধা নিয়ে। এইবার রোদ উঠছে। রাস্তাও কম না। যাবে সে এক নেতার বক্তৃতা শুনতে। কোথায় কোন এক স্কুলের প্রতিষ্ঠা দিবসের বক্তৃতা। কিন্তু কেরানি তাকে দেরি করিয়ে দেয়। গাছতলায় একা বসে সে স্মৃতিমেদুরতায় ভোগে। ছোটবেলায় সে স্কুল যেত রোজ। মনে পড়ে সেই লম্বা চুলদাড়ি বৃদ্ধ কবির কথা। যিনি তখন পাঞ্জাবের গ্রামে গ্রামে লোকগান সংগ্রহ করে ফিরছেন। স্কুলমাস্টারের সঙ্গে তাঁর আলাপ কীভাবে সে জানে না। কিন্তু মাস্টার তাকে নিজের কবিতা শুনিয়েছিল মনে আছে। বুড়ো কবি রবীন্দ্রনাথের গল্প করত খুব, তার গান শুনে রবীন্দ্রনাথ কেমন মোহিত হয়েছিলেন! গানের পর গান। ওরেব্বাস! রবীন্দ্রনাথ কি খুশি! তারপর নাকি মজলিসে দুজনেই দুজনকে শোনান কিছু স্বরচিত কবিতা। বদ্রুর পলক পড়ে না। হাঁ করে সেই সবকিছু সে একেবারে গিলে ফেলে বেমালুম। জীবনে সেই প্রথম ডানাওলা কবিরা মাটিতে নেমে রক্তমাংসেরই মানুষ হয়ে ওঠে তার কাছে। তাহলে সেই বা লিখতে পারবে না কেন! লিখেও ফেলে একখান কবিতা। মাষ্টার তাকে উৎসাহ দেয়। “তুমি পারবে, চেষ্টা করলেই পারবে রবীন্দ্রনাথ হতে। তুমি এইটুকু বয়সে যা লিখেছ, আমাদের ঐ বুড়ো কবির কলম তার ধারে কাছে গিয়েছে কখনও!” উত্তেজনায় গীতাঞ্জলী প্রায় বার চারেক পড়ে ফেলে বদ্রু। কিন্তু এইখানে ঘা খেতে হয়। কিছুই তেমন বুঝতে পারে না সে। একসময় বদ্রু প্রায় সমস্ত বিষয়েই কবিতা লিখতে পারে, কিন্তু কী মুশকিল! কেউ তার কবিতা শুনলে তো! নাহলে দেখ, স্কুলের অ্যাওয়ার্ড ফাংশনে কি সে পুরস্কার কম পেয়েছিল? এত পুরস্কার এত পুরস্কার পায় যে তা বয়ে আনার জন্য আরেকজন বন্ধুকে বলতে হয়। পড়াশোনায়, দৌড়ে মায় কবিতা প্রতিযোগিতাতেও সে প্রথম। ঠিক সেদিনও এক নেতা বক্তৃতা দিচ্ছিলেন সেই অনুষ্ঠানে। “তোমাদের মধ্যে থেকেই উঠে আসবে দেশের পরবর্তী মহান নেতারা! আরো আরো গান্ধী আরো আরো রবীন্দ্রনাথ! জানো তো রবীন্দ্রনাথকে বড় মানুষ করেছিলেন কে? তাঁর মা!” বদ্রু হু হু করে ঘরের দিকে ছুটতে থাকে। মার কোলে সমস্ত পুরস্কার ফেলে দিয়ে মাকে জড়িয়ে সে কি মিনতি, “মা, ওমা, আমায় রবীন্দ্রনাথ করে দে না মা! আমায় রবীন্দ্রনাথ করে দে!” বদ্রুর মা থ! এ কী কাণ্ড! পাগলটা যে কার কথা বলছেরে বাবা? কী সব উল্টোপাল্টা, ধ্যাৎ।
এই ঘটনার পর কেটে গিয়েছে অনেক গুলো বছর। বাবার স্ট্রোক হওয়ার পরে স্কুল ছাড়তে হয়েছে। বেছে নিতে হয়েছে দিন মজুরি। ধুলোয় মাখামাখি বদ্রুর মনে পরে তার মাস্টারের কথা। তিনি বলতেন, রবীন্দ্রনাথ হিরে জহরতে লোভ ছিল না। মায়ের কাছে ছোট্ট রবি চাইতেন কেবল মাটির গন্ধ। একটু ধুলো মেখে একটু মাটির কাছাকাছি যেন খেলতে পান। আকাশ ফুটিফাটা। কিসমত দেখ! নাক অবধি সেই ধুলোয় ঢেকে গেল, বদ্রু রবীন্দ্রনাথ হতে পারল কই! জ্বলন্ত সূর্যকে গালি দিয়ে, আকাশকে গালিগালাজ করে এই না পারার খানিকটা বদলা সে তুলতে পারে! আর থেকে থেকেই গাঁয়ের সেই বুড়ো কবির কুড়িয়ে আনা লোকগান ঠাণ্ডা পানির মতো উপচে আসে তার গলা বেয়ে। চড়া রোদে শুকনো ফাটা পায়ে ক্লান্ত অবসন্ন গাধা তিনটে নিয়ে সে গন্তব্যে পোঁছায়! সেই অনুষ্ঠান, সেই শিক্ষক ছাত্রদের ভিড় দেখতে দেখতে বদ্রুর ফের মনে পড়ে সেই বুড়োর কথা। বদ্রুও তাকে কত লোকগান শুনিয়েছে! আবার আসবে বলে লোকটা আর কোনওদিন এলই না। এলে তাকে বদ্রু এবার নিজের লেখা গান শোনাবে। মাস্টারের কথা মনে পড়ে, যে মাস্টার তাকে রবীন্দ্রনাথ হওয়ার উৎসাহ দিয়েছিল। স্কুল ছেড়ে দেওয়ার পরেও লিখেছে সে বহু, গোস্তাখি হয়েছে নাকি? মাস্টার সে 'মজুরের কবিতা' ছুঁয়েও দেখেননি। মজুরে কি লিখতে পারে! রবীন্দ্রনাথের স্বপ্নের ধুলো ধীরে ধীরে বদ্রুকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলতে থাকে! মাথায় রয়ে যাওয়া একটি আনকোরা কবিতায় পালিয়ে আসে বদ্রু! কিন্তু, চটক ভাঙে! এত চিৎকার করে কে? কবিতা তাকে নামিয়ে দিয়েছে কোনও এক চাষার ক্ষেতে গাধা সমেত। ক্ষেত নষ্ট হওয়ার জ্বালায় প্রচণ্ড রাগে তড়পাতে থাকে চাষা। তখনও বদ্রুর চোখের পাতা ভারি। কাঁচা দিবাস্বপ্ন ভেঙে সে হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকে! গালিতে কাজ হচ্ছে না বুঝে চাষা শাবল হাতে তাড়া করে বদ্রুকে। এইবার গাধাগুলোকে তাড়াতে তাড়াতে ছুটতে শুরু করে সে। প্রচণ্ড ভয়, প্রচণ্ড একটা ভয়—
বদ্রু হাতের লাঠিটা দিয়ে সপাং সপাং মারতে থাকে গাধা গুলোকে! ক্রমে একটা ধূসর কুয়াশা ঢেকে দেয় ওদের চারজনকে!
পাগড়ির একপাশে বেঁধে রাখা গুড়ের ঢেলাটা, তখনও, তার পিঠের ওপর আছড়ে আছড়ে পড়ছে!
তথ্যঋণ
“Acclaimed Punjabi Short Story Writer Mohan Bhandari Passes Away at 84.” 2021. Hindustan Times. November 26, 2021.
Bhandari, Mohan. n.d. ‘I Want to Be Tagore’: The Story for Which Every Punjabi Student Knows Mohan Bhandari (1937-2021).”
Service, Tribune News. n.d. “Mohan Bhandari Writer Reached out to All with Lucid Story-Telling.” Tribuneindia News