কোন সুযোগে নবীনকে উপড়ে ফেলল বিজেপি? ওড়িশার মতোই হাল হবে বাংলার?

Mohan Charan Majhi: ঠিক যা যা গুণাবলি থাকার দরকার একজন বিজেপি কর্মীর, তার সবকিছুই আছে ওড়িশার নয়া মুখ্যমন্ত্রী মোহন চরণ মাঝির। সাঁওতাল পরিবারে জন্ম তাঁর

এবারের লোকসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদি একটা সাময়িক ধাক্কা খেয়েছেন। তৃতীয়বার মোদি প্রধানমন্ত্রী হলেও তাঁর অহংকার কিছুটা খর্ব হয়েছে। যতই গোদি মিডিয়া বলুক, আবার একবার দেশের দায়িত্ব মোদির কাঁধে, অনেকেই বুঝতে পারছেন হয়তো এবার নরেন্দ্র মোদি এবং বিজেপি ততটা আগ্রাসীভাবে তাঁদের কর্মকাণ্ডকে বুলডোজারের মতো এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে না। একদিকে সঙ্ঘ পরিবারের প্রধান মোহন ভাগবত বলছেন, একজন সঙ্ঘ পরিবারের আদর্শ মেনে চলা মানুষ কখনই অহংকারী হতে পারেন না, অন্যদিকে শরিক দলগুলোর চাপ। সুতরাং এবারের নরেন্দ্র মোদি গত দুই বারের মতো হবেন না, তা হয়তো অনেকেই আশা করছেন। তবে শুধু আশা নিয়ে বসে থাকলে আবারও ভুল করবেন বিরোধীরা। একটা কথা ভুলে গেলে চলবে না, আগামী অক্টোবর মাস থেকে আরএসএসের শতবর্ষ উদযাপন উৎসব শুরু হবে এবং যে লক্ষ্যে তারা একশো বছর ধরে কাজ করেছে, তা থেকে তারা কোনওভাবেই পিছু হটার কথা ভাবছে না। উল্টে সেই লক্ষ্যের দিকে স্থির দৃষ্টি রেখেই আরএসএস এগিয়ে চলেছে।

দীর্ঘদিন আমাদের পাশের রাজ্য ওড়িশাতে বিজেপি দ্বিতীয় স্থানে থাকতে থাকতে অবশেষে এবারে ক্ষমতায় এসেছে তারা। এটিও বিজেপি আরএসএসের একশো বছরের প্রকল্পেরই অন্তর্গত। বিজেপি ওড়িশাতে যাঁকে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে বেছে নিয়েছে, তা দেখিয়ে দেয় হিন্দুত্বের কর্মসূচি থেকে তারা বিন্দুমাত্র সরে আসেনি। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে বিজেপি বেছে নিয়েছে মোহন চরণ মাঝিকে, তিনি আদতে একজন সংখ্যালঘু বিদ্বেষীই। সামাজিক মাধ্যমের বিভিন্ন ছবি এবং খবর দেখা যাচ্ছে যে, তিনি ওড়িশার কেওনঝড়ে, ১৯৯৯ সালে বজরং দলের মাথা, দারা সিংয়ের মুক্তির দাবিতে ধর্নায় বসেছেন। দারা সিংয়ের নামে খ্রিস্টান পাদ্রী গ্রাহাম স্টুয়ার্ট স্টাইন্সের হত্যার অভিযোগ ছিল।
যাঁদের সঙ্গে তিনি ধর্নায় বসেছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম সুরেশ চভানকে। কে এই সুরেশ চভানকে? মূলত দক্ষিণ ভারত এবং মহারাষ্ট্রে ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়ানোর মূল যে চ্যানেল, সেই সুদর্শন টিভির একজন সঞ্চালক সুরেশ চভানকে। লাভ জিহাদ, ইউপিএসসি জিহাদ এই সমস্ত শব্দ আনার মূল কারিগর সুরেশ চভানকে।

আরও পড়ুন- ধ্রুব রাঠী, রভীশ কুমাররা পারেন, বাংলার ইউটিউবাররা পারেন না কেন?

বহু দিন ধরেই, বিজেপি আরএসএসের বিভিন্ন শাখা সংগঠন সংখ্যালঘুদের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ানোর কাজ করছে। তবে গত দশ বছরে, কেন্দ্র সরকারে বিজেপি থাকাতে তা প্রাতিষ্ঠানিকতা পেয়েছে। ওড়িশায় ১৯৯৯ সালে যখন গ্রাহাম স্টুয়ার্ট স্টাইন্স এবং তাঁর পরিবারকে পুড়িয়ে মেরেছিল বজরং দলের সদস্যরা, যার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন দারা সিং, সারা দেশ তখন চমকে উঠ্যেছিল। সেই সময়ের সঙ্গে আজকের সময়ের একটাই পার্থক্য। আজ বিভিন্ন জায়গায় যখন সংখ্যালঘুদের পিটিয়ে মারা হচ্ছে, তার জন্য কোনও শাস্তি হয় না। অন্তত সেই সময়ে হতো। সেই কারণেই অস্ট্রেলিয় পাদ্রী এবং তাঁর পরিবারকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারার দায়ে দারা সিংকে যাবজ্জীবন কারাবন্দি করা হয়েছিল।

সুরেশ চভানকে এবং মোহন চরণ মাঝিরাও ১৯৯৯ সালে সাজা পাওয়া দারা সিংকে ছাড়ার দাবিতে বহুদিন কিছু করেননি। তাঁরা যখন নিশ্চিত হন কেন্দ্র সরকার এখন তাঁদের অনুকুলে কথা বলবে, তখন তাঁরা দারা সিংকে ছাড়ার দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। প্রাথমিকভাবে ১৯৯৯ সালে দারা সিংকে ফাঁসি দেওয়া হবে বলে রায় দেয় ওড়িশা হাইকোর্ট। পরে বহু মানুষের আবেদনের ভিত্তিতে সেই রায় বদল করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ হয়। দারা সিং শুধুমাত্র গ্রাহাম স্টুয়ার্ট স্টাইন্স এবং তাঁর পরিবারকে পুড়িয়ে মারার সঙ্গেই যুক্ত ছিলেন না তার বিরুদ্ধে আরও একজন মুসলমান মানুষকে হত্যার অভিযোগও ছিল। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে, সুরেশ চভানকে জেলে দারা সিংয়ের সঙ্গে দেখা করতে যান কিন্তু তাঁকে জেল কর্তৃপক্ষ অনুমতি দেয়নি। একমাত্র পরিবারের লোক ছাড়া কেউ দারা সিংয়ের সাক্ষাৎ পাবেন না বলে নির্দেশ ছিল। সেই সময়ে জেল কর্তৃপক্ষকে চাপে রাখার জন্য মোহন চরণ মাঝি, সুরেশ চভানকে এবং অন্যান্যরা ধর্নায় বসেন জেলের সামনেই।

ঠিক যা যা গুণাবলি থাকার দরকার একজন বিজেপি কর্মীর, তার সবকিছুই আছে ওড়িশার নয়া মুখ্যমন্ত্রী মোহন চরণ মাঝির। সাঁওতাল পরিবারে জন্ম তাঁর। সরস্বতী বিদ্যামন্দিরে পড়াশোনা করেছেন। সঙ্ঘ পরিবারের আদর্শে বড় হয়েছেন এবং আরএসএসে যুক্ত হয়েছেন।
তারপরে সেই সরস্বতী বিদ্যামন্দিরে শিক্ষকতাও করেছেন বেশ কিছু বছর এবং সবশেষে সর্বক্ষণের কর্মী হিসেবে বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। প্রথমে গ্রামের সরপঞ্চ হয়েছিলেন মোহন, তারপরে আদিবাসী অধ্যুষিত কেওনঝড় বিধানসভায় চারবার নির্বাচিত হন। খেয়াল রাখতে হবে, কেওনঝড়েই গ্রাহাম স্টুয়ার্ট স্টাইন্সকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছিল।

অনেকেই ভাবেন, নবীন পট্টনায়ক এবং তাঁর বিজু জনতা দল ওড়িশায় প্রচুর উন্নয়ন করেছেন। নবীন কোনও দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত নন। কিন্তু বিজেপির নতুন মুখ্যমন্ত্রী বহুবার ওড়িশা বিধানসভায় দেখিয়েছিলেন, কীভাবে পরিবেশ ধ্বংস করে নবীন পট্টনায়ক উন্নয়নের জয়গান করছেন এবং তার মধ্যে কোথায় কোথায় দুর্নীতি হয়েছে। যদি দুর্নীতি হয়েই থাকে, তাহলে তা নিয়ে শোরগোল হয়নি কেন?
শোরগোল হয়নি তার অন্যতম কারণ, যারা উন্নয়নের নাম করে দুর্নীতি করেছেন তাঁরা যেমন নবীন পট্টনায়কের বন্ধু, তেমনই তাঁরা নরেন্দ্র মোদিরও খুব কাছের মানুষ। নবীন পট্টনায়ক কোনওদিনই কেন্দ্রীয় স্তরে নরেন্দ্র মোদির খুব বেশি বিরোধিতা করেননি। তবে বিজেপি দীর্ঘদিন অপেক্ষা করেছে। 

আরও পড়ুন- ২৫ বছর পর নতুন ভূমিকায়, ওড়িশায় ঝড় তুলতে পারবেন নবীন পট্টনায়েক?

দীর্ঘদিন ওড়িশাতে দ্বিতীয় স্থানে থেকে আরএসএস এবং বিজেপি তাদের সংগঠনের শাখা বিস্তার করেছে, আদিবাসীদের মনে ঘৃণা বিদ্বেষ
ঢুকিয়েছে, তারপর ওড়িশাতে ক্ষমতা দখল করে একজন সাঁওতাল মানুষকেই ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত করেছে। ওড়িশায় বিজেপি সরকার আসার ঠিক পরেই ভয়ঙ্কর দাঙ্গা শুরু হয়, মুসলমান এবং খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে বজরং বাহিনীর তাণ্ডব। একদিন যিনি বজরঙ দলের অন্যতম মাথা দারা সিংয়ে মুক্তির দাবিতে ধর্নায় বসেছিলেন, তিনিই আজ সে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। গির্জায় হানা, লুঠ, তারপর কুরবানিকে কেন্দ্র করে তাণ্ডব। 

নবীন পট্টনায়কের আমলে ওড়িশায় যে খনিজ দ্রব্য সংক্রান্ত দুর্নীতি, তার কি এবার তদন্ত হবে? নবীন পট্টনায়ক এবং ওড়িশায় যে সংস্থারা উন্নয়নের জয়ডঙ্কা বাজিয়েছিল, তাঁরাই কিন্তু পিছন দরজা দিয়ে আরএসএস বিজেপিকে সহায়তা করে গেছেন দীর্ঘদিন। এটাই ভয়ের কারণ। দুর্নীতি এবং মানুষদের নিয়ে কিন্তু আওয়াজ তুলেছিলেন রাহুল গান্ধি, ওড়িশার নিয়মগিরিতেই। তাই রাহুল গান্ধি যাতে ওড়িশায় জায়গা না করতে পারেন, তার জন্য বিজেপি এবং নবীন পট্টনায়ক একটা প্রায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করে ফেলেছিলেন যে, বিধানসভা বিজেডির আর লোকসভা বিজেপির থাকবে। তবে এবারের বিধানসভা এবং লোকসভা দুটোতেই বিজেডি পরাজিত হয়েছে বিজেপির কাছে। 

আমাদের রাজ্যেও ক্রমশ আরএসএস তার শাখা বিস্তার করছে। বামপন্থীরা বিধানসভা কিংবা লোকসভায় শূন্য হয়ে গেছে সংখ্যার দিক থেকে। অন্যদিকে বিজেপি ক্রমশ প্রভাব বাড়িয়ে চলেছে। তথাকথিত বামেরা তৃণমূলের বিরোধিতা করছে, আর ওদিকে বিজেপি ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে। সাম্প্রতিক লোকসভার ফলের নিরিখে বা ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের প্ররিপেক্ষিতে মনে হতে পারে, তৃণমূল বিজেপিকে ঠেকিয়ে দিয়েছে। বিজেপিকে আপাতত ঠেকিয়েছে বাংলার মানুষ। আগামীদিনে বাংলাকে ওড়িশা না হতে দিতে চাইলে বাংলার বামপন্থীদেরই নতুন করে ভাবতে হবে। বাংলার বামপন্থীদের এখন একটাই কাজ, সংখ্যালঘুর ভরসা হয়ে উঠতে হবে তাঁদের। শুধু ধর্মীয় নয়, সমস্ত ধরনের সংখ্যালঘুদের বন্ধু হয়ে উঠতে হবে।

More Articles