নলেন, পাটালির মধ্যে লুকিয়ে আছে এই গুড়ও! কোত্থেকে বাংলায় এল 'পয়রা' শব্দটি?
Origin of Bengali Word Poyra: ভেলির ব্যুৎপত্তি যদি দ্রাবিড় থেকে আসতে পারে, পয়রা-র না আসার কী আছে?
এবারের শব্দ পয়রা। পয়রা বললেই যেন পয়রা গুড়ের নাম মনে আসে। বিশেষ করে পৌষের এই দিনগুলিতে। তা, পয়রা শব্দটি এল কোথা থেকে? শব্দটি সব অভিধানে নেই। অধিকাংশ প্রামাণ্য অভিধানে পাবেন না পয়রা। বেশির ভাগ অভিধানেই পয়মাল শব্দটির পরই পয়লা শব্দের দেখা মেলে। মাঝে পয়রা নেই। কয়েকটি মাত্র অভিধান পয়রাকে জাতে তুলেছে। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার, হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বঙ্গীয় শব্দকোষেও পয়রা শব্দটি নেই। অথচ আমাদের শিউলিরা সেই কবে থেকেই পয়রা গুড় ঘরে তুলছে শীতকালে।
অশোক মুখোপাধ্যায়ের সমার্থ শব্দকোষে তরল অর্থে পাতলা, পয়রা, চাপল, গলাৎ শব্দগুলির কথা বলা আছে। দু' একটি অভিধানে তৎসম পয় শব্দ থেকে 'রা' প্রত্যয় যোগে পয়রার ব্যুৎপত্তি নির্ণয়ের চেষ্টা করা হয়েছে। তৎসম শব্দ পয়-এর মানে দুধ বা জল। অভিধানগুলির মত, দুগ্ধবৎ বা জলবৎ তরলং মানেই পয়রা। রাজশেখর বসুর চলন্তিকায় পাচ্ছি, পয়রা গুড় [ < পয়স্ ] পাতলা গুড়। গোলাম মুরশিদ সম্পাদিত বাংলা আকাডেমির বিবর্তনমূলক বাংলা অভিধানে আছে, পয়ড়া [ সং পয়ঃ] বিণ তরল। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তর কবিতা থেকে উদ্ধৃতি আছে, "মাতে মন সুখদ পয়রা গুড় পেলে।" ১৮৫৮ সালে লেখা কবিতায় পয়রা গুড়ের উল্লেখ পয়রার প্রাচীনত্বকে সার্টিফিকেট দিচ্ছে বৈকি!
জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের 'বাঙ্গালা ভাষার অভিধান'-এ পয়রা/পয়রা বিষয়ে লেখা হয়েছে, [পয়াড়(দ্রঃ) > বর্ণবিপর্যয়ে পয়ড়া > ড়= র = পয়রা ]। পয়াড় মানে কী? জ্ঞানেন্দ্রমোহন লিখেছেন, "পয়াড়- [প্রবাহ > গ্রাম্য] প্রবাহ; স্রোত"। অর্থাৎ এই অভিধানে পয়ঃ থেকে পয়রার ব্যুৎপত্তির থিওরিকে মান্যতা দেওয়া হয়নি। প্রবাহ বা স্রোত তথা পয়াড়ের সঙ্গে তাতরসীয় গুড়ের সম্বন্ধ খোঁজা হয়েছে। বস্তুত পয় বা প্রবাহ, যাই হোক না কেন, নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না পয়রা শব্দটি সংস্কৃতমূল কিনা। সংস্কৃত বা তৎসম ব্যুৎপত্তি হলে, হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় পয়রা শব্দটিকে অবশ্যই অভিধানভুক্ত করতেন। তিনি সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত ছিলেন প্রকৃত অর্থে। সংস্কৃত থেকে জাত শব্দের ব্যুৎপত্তি তাঁর নজর এড়ায়নি কখনও। যদিও দ্রাবিড় মূল খুঁজতেও পিছপা হতেন না তিনি।
আরও পড়ুন- নলেনের স্বাদ নোনতা! শেষ পাতে গুড়ের বদলে কেমিক্যাল খাবে বাঙালি?
তবে পয়ঃ-র সঙ্গে রা প্রত্যয় যুক্ত করার ব্যাখ্যা কেউ দেননি। পয়োহর মানে যে দুধ বা জল হরণ করে। এক্ষেত্রে রস সংগ্রাহক। প্রথম তরল গুড়টা রসের কারবারির প্রাপ্য। তাই তাকে স্মরণ করতেই হয়তো পয়োহরা বলা হত খেজুর রস জ্বাল দিয়ে প্রাপ্ত প্রথম তরল গুড়কে। পয়োহরা > পয়োঅরা > পয়রা। আবার পয়োধর মানে নারীবক্ষ, মেঘ ছাড়া নারকেলও হয়। নারকেলের জলের সঙ্গে মিল থাকায় প্রথম প্রাপ্ত তরল গুড়কে পয়োধরা তথা পয়োরা তথা পয়রা বলা যেতে পারে। সংস্কৃত ব্যুৎপত্তি দিলে পুরোটা দেওয়া উচিত। আর 'রা'-প্রত্যয় দিয়ে কেউ যদি পয় থেকে পয়রা আনতে চান তবে সমধর্মী আরও শব্দের উদাহরণ দিতে হবে। তবে স্থান নামের ক্ষেত্রে রা বা ড়া-অন্তক জায়গাগুলি দ্রাবিড়প্রভাবযুক্ত বলে মনে করা হয়।
সাহিত্যিক নরেন্দ্রনাথ মিত্রর ছোটগল্প 'রস' বাংলা সাহিত্যের একটি সেরা লেখা। খেজুর রসের কারবারি মোতালেফ ও তার দুই স্ত্রী মাজু খাতুন আর ফুলবানুকে নিয়ে এক ত্রিমুখী কাহিনি। এখানে মোতালেফকে শিউলি বলা হয়নি, গাছি বলা হয়েছে। একটু উদ্ধৃতি দিই,
"...খানিক বাদেই আবার যেচে আলাপ করল মোতালেফ। সেধে ভেজে মান ভাঙাল ফুলবানুর। পরদিন ফের আবার উনানের পিঠে রস জ্বাল দিতে গিয়ে বসল ফুলবানু। দুপুরের পর ধামায় বয়ে গুড় নিয়ে চলল মোতালেফ হাটে। যাবার সময় বলল, 'এই দুইটা মাস কাইটা গেলে কোনো রকমে তোমার কষ্ট সারে ফুলজান।
... হাটের পর হাট যায়, রসের বতর প্রায় শেষ হয়ে আসে; গুড়ের খ্যাতি বাড়ে না মোতালেফের, দর চড়ে না; কিন্তু তা নিয়ে ফুলবানুর সঙ্গে বাড়ি এসে আর তর্কবিতর্ক করে না মোতালেফ, চুপ করে বসে হুঁকোয় তামাক টানে। খেজুর গাছ থেকে নল বেয়ে চুঁইয়ে চুঁইয়ে রস পড়ে হাঁড়ির মধ্যে। ভোরে গাছে উঠে রসভরা বড় বড় হাঁড়ি নামিয়ে আনে মোতালেফ, কিন্তু গত বছরের মতো যেন সুখ নেই মনে, ফুর্তি নেই।"
মাজু খাতুন তার তালাক দেওয়া আগের বউ। রূপে ফুলবানুর মতো সুন্দরী না হলেও তার সময়ে গুড় বিক্রি করে সুখ ছিল মোতালেফের। তার প্রসঙ্গে একটু উদ্ধৃতি দেওয়া যাক-
"ধামা ভরে ভরে হাটে-বাজারে গুড় নিয় যায় মোতালেফ, বিক্রি করে আসে চড়া দামে! বাজারের মধ্যে সেরা গুড় তার। পড়ন্ত বেলায় ফের যায় গাছে গাছে হাঁড়ি পাততে।"
রস গল্প থেকে এত কথা শোনানোর একটাই কারণ এখানে কোথাও পয়রা গুড়ের উল্লেখ নেই। পাটালি গুড়ের উল্লেখ আছে। নলেনেরও দেখা পেলাম না। হয়তো মোতালেফ শুকনো গুড়ের কারবারি ছিল, তরল গুড় বড় বিপজ্জনক ছিল তার কাছে। কোথাকার গুড় কোথায় গড়ায়!
আরও পড়ুন- সেনানায়ক জন্ম দিলেন আস্ত বাংলা শব্দ? যেভাবে এল ‘জাঁদরেল’ শব্দটি
সত্যিই কি পাতলা বা তরল অর্থই বহন করছে পয়রা? নাকি পয়রা শব্দটিরও নেপথ্যে দ্রাবিড়ীয় প্রভাব? ভেলি গুড়ের যদি তামিল ব্যুৎপত্তি হয়, পয়রার হবে না কেন? জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের অভিধানে ভেলির ব্যুৎপত্তি হল, '[বালুয়া > বেলে(মিহি দানাদার) >। হি. ভেলি।]। সংসদ বাংলা অভিধান জানাচ্ছে, ভেলি গুড়ের ভেলি এসেছে হিন্দি 'ভেলী' থেকে। কিন্তু সত্যনারায়ণ দাশের বাংলায় দ্রাবিড় শব্দ (ব্যুৎপত্তিকোষ) জানিয়ে দিচ্ছে, "ভেলি - বি. এক শ্রেণির গুড়।
কন্নড় বেল্ল, তামিল বেল্লম, তেলুগু বেল্লমু থেকেই এসেছে ভেলি।"
গুগল ট্রান্সলেটেও ইংরেজি Molasses এর কন্নড়-তামিল-তেলুগু- অনুবাদ যথাক্রমে বেল্ল, ভেল্লম, ভেল্লাম দেখাচ্ছে। ভেলির ব্যুৎপত্তি যদি দ্রাবিড় থেকে আসতে পারে, পয়রা-র না আসার কী আছে? ব্যুৎপত্তিকোষেই পাওয়া গেল, কন্নড় 'পয়রু' মানে ফসল। পয়রু থেকে পয়রা আসতেই পারে। যেভাবে শীতের সময় শিউলি তথা খেজুর রসের কারবারিরা পাইকিরিহারে গাছে গাছে কলসি তথা হাঁড়ি লাগায় রস সংগ্রহের জন্যে, তার আগে খেজুর পাতা ও খেজুরের বেলদোগুলিকে পরিষ্কার করে ধারালো কাতান, হাঁসুয়া বা ছ্যান দিয়ে, তাতে ফসল সংগ্রহের সর্বাত্মক প্রয়াসই পরিলক্ষিত হয়। বাস্তবিকই শিউলি বা গাছিদের কাছে শীতের এই মরশুমটি ফসল ঘরে তোলার সময়। পয়রা বাঙালির পদবিও হয়। মনে হয় এটি পয়রা গুড়ের কারবারিদের পদবি ছিল আদতে। কিংবা মাঠে ফসল ফলানো চাষিদের পদবিও হতে পারে পয়রা।
কন্নড় পয়রু থেকে পয়রুয়া হয়ে পয়রা আসতেই পারে তাই। পয়রা গুড়ই বলা হোক বা নলেনই বলা হোক, এখন শীতের সমস্ত মিষ্টান্নেই তার ছোঁয়া। বড়দিনের কেকেও এবার নলেনের স্বাদ পাওয়া গেল। তবে নাহুম বা ফ্লুরিজের নয়, বেঙ্গলের কেকে।