'ভিনদেশি তারা' গৌতমদার জন্য গাইব ভেবে রেখেছিলাম
গৌতমদার বা মহীনের অনুষ্ঠান শুধু স্টেজেই শেষ হয়ে যেত না, তা ছড়িয়ে থাকত স্টেজের বাইরেও। এই যে উন্মাদনা, গানটাকে সঙ্গে নিয়ে সবসময় ঘুরে বেড়ানো, গৌতমদার থেকে এটা সত্যিই শেখার। 'মহীনের ঘোড়াগুলি' সবসময়ই আমাদের গানের মধ্যে মিশে...
আমি কলেজে ভর্তি হয়েছি ১৯৮৬ সালে। সেই বছরই মাধ্যমিক, সেই বছর স্কটিশচার্চ কলেজে ভর্তি হলাম। সেই সময় কলেজে ফেস্ট ছিল একটা বড় ব্যাপার, স্কটিশে হতো ক্যালিডোনিয়া। সেখানে বাইরে থেকে নানা দল আসত, নানা ধরনের গানবাজনা করত তারা। সেইরকম একটা ফেস্টেই শুনলাম, 'ভালো লাগে জ্যোৎস্নায় কাশবনে ছুটতে'। এরকম যে একটা গানের চলন হতে পারে, সেই সময় ধারণা ছিল না। 'ভালো লাগে জ্যোৎস্নায়' গাইছে একটি ছেলে, তার নাম উপল, যার সঙ্গে পরে আলাপ হবে। উপল কখনও গাইছে 'তোমাদের সন্ধ্যাগুলি', আমরা কলেজের ফয়ারে গাইতাম 'পথের প্রান্তে কোন সুদূর গাঁয়'। 'মহীনের ঘোড়াগুলি', 'নগর ফিলোমেল', রঞ্জন প্রসাদ- এদের নিয়ে একটা অন্য গানের দুনিয়া তৈরি হলো, যা আমাদের চেনা বাংলা গানের থেকে আলাদা, মনে হচ্ছে, যা আমাদের গান। আর এই মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই গৌতম চট্টোপাধ্যায়কে আমাদের আবিষ্কার শুরু।
সেই সময়টায় 'মহীনের ঘোড়াগুলি'-র রেকর্ড বা ক্যাসেট বাজারে ততটা সুলভ ছিল না। তা সত্ত্বেও বেশ কিছু গান আমরা শুনে ফেলেছিলাম। 'চৈত্রের কাফন' শুনেছি, 'ভালো লাগে জ্যোৎস্নায়' শুনেছি। তখনও 'পৃথিবীটা নাকি' তৈরি হয়নি।
এর অনেকটা পরের কথা, আমরাও তখন টুকটাক গান বানাচ্ছি, নয়ের দশক শুরু হয়ে গেছে। কবীর সুমন, নচিকেতা, অঞ্জন দত্তদের পদচারণা শুর হয়ে গেছে। আমি কলেজে পড়তে পড়তেই চাকরি পাই 'যুগান্তর' কাগজে। আমাদের সম্পাদক ছিলেন নাম করা সাংবাদিক দীপঙ্কর চক্রবর্তী, এখন আর তিনি নেই। আমাদের কালচারাল সাপ্লিমেন্টটি সম্পাদনা করতেন। দীপঙ্করদার সঙ্গে 'মহীনের ঘোড়াগুলি'-র যোগাযোগ ছিল। খুবই বাউন্ডুলে মানুষ ছিলেন দীপঙ্করদা, কখনও নবনীতাদি (দেবসেন), কখনও গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে থানা গেড়ে বসে থাকতেন। সেই সময় শুনি, দীপঙ্করদা কিছু সুর গুণগুণ করছেন। জানতে পারলাম, 'আবার বছর কুড়ি পরে' তৈরি হচ্ছে। একটা জমায়েত হতো, সন্ধের দিকে গৌতমদা আসত, ওরা সকলে মিলে মদ্যপান করতে যেত, তখন দারুণ দারুণ বার ছিল ওদিকে, 'রেখা', 'উইন্ডসর', 'গালিব', 'গালিব'-এ আবার গজল বাজত। আবার কখনও ঝামেলা করে, পুলিশের সঙ্গে মারপিট করে হয়তো ফিরে এল সবাই মিলে। এতটাই অদ্ভুত ছিল ওদের যাপন! সেই জমায়েতেই একদিন একটা লম্বামতো ছেলে এল, সুরজিৎ, সে গাইল 'আমি ডানদিকে রই না আমি বামদিকে রই', সেই প্রথম শোনা গানটা। তখনও গানটা রেকর্ড হয়নি।
শুনতে পারেন: আবার বছর কুড়ি পরে
বইমেলায় বসত গৌতমদা, তাকে ঘিরে থাকত অনেক মানুষ। এই সবের মধ্যে থাকতে থাকতে পরে আলাপ হয়ে যায় গৌতমদার সঙ্গে। গৌতমদার গানের যে আলাদা জায়গাটা সেটা সব সময় আমাদের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। আর স্টেজে গান গাওয়ার যে প্রাণ, যে স্পন্দন, সেটাও গৌতমদার থেকে আমরা পেয়েছি।
'মহীনের ঘোড়াগুলি' আর 'চন্দ্রবিন্দু' একসঙ্গে অনুষ্ঠান করেছে। সত্যজিৎ রায় ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট-এর ওপেন এয়ার অডিটোরিয়াম যেদিন উদ্বোধন হয়, সেই দিনটাতে শো করেছিলাম আমরা। শুরুতে করেছিলাম আমরা। তখন আমাদের একটা অ্যালবাম বেরিয়েছে, গৌতমদা আমাদের গান শুনেছে, ভালো লেগেছে ওর। আমরাও ওর বাড়ি যেতে শিখেছি। সেই শো-টা আমাদের কাছে দুরন্ত ব্যাপার ছিল। মহীনের শো-তে হিরণ মিত্র স্টেজে ছবি এঁকেছিলেন, মনে পড়ে। গিটারে ছিল সুব্রত, গানগুলো যার লেখা, সেই জয়জিৎ লাহিড়ীও ছিল।
'আবার বছর কুড়ি পরে' ছিল সম্পাদিত অ্যালবাম। গৌতমদার গানে কখনও অনায়াসে মিশে যায় ল্যাটিন, কখনও রক। তার সঙ্গেই শিকড়টা ধরে রাখছে সেই গানগুলো। মহীনের সবচেয়ে জরুরি কাজের মধ্যে একটা হলো বাউল জ্যাজ। আমাদের খুবই অনুপ্রেরণা দিয়েছে বাউল জ্যাজ। পরে 'চন্দ্রবিন্দু'-র জন্য কীর্তন নিয়ে কিছু কাজ আমরা করেছি। সেগুলোর নেপথ্যে অবশ্যই 'মহীনের ঘোড়াগুলি'-র অনুপ্রেরণা কাজ করেছে। সে 'রিক্সাওয়ালা' হোক, 'বসন্ত দিনে' হোক বা 'আমরা বাঙালি জাতি' হোক।
পারফরমার হিসেবে গৌতমদার থেকে অনেক কিছু শেখা। গৌতমদার সবচেয়ে বড় গুণ ছিল, গৌতমদার গোটা জীবন ছিল গান নিয়ে। মহীন আর চন্দ্রবিন্দু-র যৌথ শো-টার কথাই যদি বলি, ওই অনুষ্ঠানটা চলাকালীন পাওয়ার অফ হয়ে যায়। গৌতমদা গান থামায়নি। একসময় অনুষ্ঠানটা শেষ হয়, শেষ হয়ে যাওয়ার পর আমরা আবার একটা দল মিলে একটা জায়গায় বসে গান গাওয়া শুরু করলাম। আমরা গৌতমদাকে আর্জি করলাম, 'এই গানটা গাও, ওইটা গাওয়া হয়নি', এর সঙ্গে একটা নেশার পরিসরও ছিল, এই করতে করতে ভোর হয়ে এল।
ফলে গৌতমদার বা মহীনের অনুষ্ঠান শুধু স্টেজেই শেষ হয়ে যেত না, তা ছড়িয়ে থাকত স্টেজের বাইরেও। এই যে উন্মাদনা, গানটাকে সঙ্গে নিয়ে সবসময় ঘুরে বেড়ানো, গৌতমদার থেকে এটা সত্যিই শেখার। 'মহীনের ঘোড়াগুলি' সবসময়ই আমাদের গানের মধ্যে মিশে থাকবে।
শুনতে পারেন: ভিনদেশি তারা
একটা ঘটনা বলে শেষ করি। গৌতমদা যেদিন মারা যান, সেদিন আমরা 'ত্বকের যত্ন নিন'-এর ডেমো ক্যাসেট করছিলাম। রেকর্ডিং চলছিল সল্টলেকের অনেকটা ভেতরে। ফলে আমরা শ্মশানে পৌঁছতে পারিনি। আর তখন চটজলদি দক্ষিণে যাওয়াও যেত না। সেই নিয়ে আমাদের একটা খারাপ লাগা ছিল আমাদের। এর পরবর্তী সময় দশ-বারোটা স্মরণসভায় আমরা গান গেয়েছি। আমাদেরই একজন পয়গম্বর মানুষ ছিলেন গৌতমদা, সেই কারণে গান গাইতে ছুটতাম বারবার। এমনই একটা অনুষ্ঠান চলছিল শিশির মঞ্চে। সেই সময় 'ভিনদেশি তারা' গানটা বানিয়ে ফেলেছি, গাইব কি না বুঝতে পারছি না। ঠিক করলাম, গৌতমদাকে ডেডিকেট করে এই স্মরণসভায় গানটা গাইব। কিন্তু শিশির মঞ্চের সেই অনুষ্ঠানে গানটা সেদিন গাওয়া হয়নি, কারণ যাঁর পরে আমার গাওয়ার কথা, তিনি গেয়ে চলেছিলেন। এই সময় শিশির মঞ্চে এত লোক হয়, যে বাইরের কাচের দেওয়ালটা ভেঙে পড়ে। আমি গৌতমদার জন্য যে গানটা রিহার্সাল করে গাইব বলে ভেবেছিলাম, সেদিন সেই না-গাওয়া গানটা, 'ভিনদেশি তারা' রয়ে গিয়েছিল।