মনিদার বানানো সিনেমাগুলো দেখতেই পেল না নতুন প্রজন্ম

মনিদার করা সেলুলয়েডের কিছুই কি সত্যিই কখনও নতুন প্রজন্ম দেখতে পাবে না? ভাগ্যের ওপর কোনওদিন আস্থা রাখিনি, কিন্তু 'দুর্ভাগ্য' শব্দটিকেও অভিধানের বাইরে রাখতে পারিনি। মনিদার ক্ষেত্রে 'দুর্ভাগ্য' শব্দটা প্রায়ই ইতিউতি ঘুরে-ফির...

যে কোনও মানুষকে কাছ থেকে দেখার যেমন কিছু সুবিধা আছে তেমন অসুবিধাও আছে। কাছ থেকে দেখার প্রথম সুবিধাটা হলো যে, তা পুরোটাই আমার ব্যক্তিগত জানা-বোঝা। সেখানে ভালো-মন্দ নিক্তি দিয়ে মাপতে হবে না। উল্টো দিকে, এই কাছ থেকে দেখার বিপদ হলো, তা নিয়ে যদি বলতে বা লিখতে যাই, তাহলে আবার সকলের সঙ্গে একমত হওয়া যাবে না। সেখানে তখন চলে আসবে একেক জনের একেকরকম দেখা। একেক জনের একেকরকম শোনা।

ওপরের কথাগুলো নিজের খেয়ালেই লিখে ফেললাম। প্রায় তেইশ বছর আগে এই দিনে চলে গিয়েছিল গৌতম চট্টোপাধ্যায়। অনেক বলেছি, অনেক লিখেছি তাকে নিয়ে। তবু আজ দিশেহারা লাগে। কী লিখব তাকে নিয়ে?

'মহীনের ঘোড়াগুলি' ব্যান্ডের আরব্যঘোটক গৌতম চট্টোপাধ্যায়কে লোকে মূলত চিনেছিল একজন যুগান্তকারী সংগীতজ্ঞ হিসেবে, আর কেউ কেউ চলচ্চিত্রকার হিসেবেও। আমরা প্রথম চিনেছিলাম পাড়ার 'মনিদা' হিসেবে।

সেই জানা-বোঝার সলতে পাকাতে পাকাতে কেমন যেন প্রদীপের নিচে অন্ধকার মেখে তার আলোকোজ্জ্বল উপস্থিতি আজও টের পাই। আজ সে কিংবদন্তি! আজ সে সংগীতজগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র! কিন্তু এমন তো শুরু থেকেই ছিল না। সেইসব বেলা-অবেলার দিনরাত্রির আখ্যান হয়তো আরও পরে লিখিত হবে। কিন্তু যখন একটা মানুষ মিথ হয়ে যায় কিংবা মিথ করে দেওয়া হয়, তখন গজিয়ে ওঠে বেখাপ্পা গল্প। এই যে বলছি 'গল্প', তার পিছনে মূলত কাজ করেছে, না দেখা, না বোঝা।

একটা আপসহীন লড়াই, সমাজের মধ্যে থেকে সমাজের এগিয়ে থাকা কথাগুলো বলে ফেলা আর পরীক্ষামূলক যে কোনও চিন্তাকে অগ্রাধিকার দেওয়া ছিল মনিদার অন্যতম চর্যাচর্য। অসম্ভব পরিশ্রম করতে পারার ক্ষেত্রে যেমন সুনির্দিষ্ট , আবার আড্ডাবাজিতে তার তুলনা মেলা ভার। পরিচালককে প্রথমত একজন দক্ষ সংগঠক হতে হবে, সেকথা অনেক আগেই পড়ে ফেলেছি। কিন্তু চাক্ষুষ করেছি মনিদাকে দেখে। অসম্ভব সাংগঠনিক ক্ষমতা ছিল তার। সেই কারণে মনিদার প্রতি আকর্ষিত হয়েছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। আমাদের বয়সের মধ্যে ছিল দেড় দশকের ফারাক। কিন্তু ভাবটি হলো বন্ধুর, কখনও দাদার মতো, শিক্ষকের মতো। সেই কারণেই যখন শুনি, মনিদার নেশা ও বিশৃঙ্খল জীবনের গল্প, তখন বলতে ইচ্ছে করে যে, এসব বলা বন্ধ করো। নেশা মনিদা করত, কিন্তু তা অপর্যাপ্ত নয় কখনও। মনিদা কখনওই বিশৃঙ্খল ছিল না। তা হলে মাত্র পঞ্চাশ বছরের মধ্যে এত কাজ করতে পারত না। আরও কাজ করে যাওয়া উচিত ছিল বলে যারা মনে করে, তাদের কথায় আমি জুড়ে দেব যে আমাদের সংস্কৃতি সে সুযোগ মনিদাকে দেয়নি। মনিদার কাছ থেকে বারবার শুনেছি যে, "প্রত্যেকটি শিল্পচর্চায় একটি সুসংহত বোধ থাকা দরকার। তবেই তুমি তোমার কাজকে ভাঙতে পারবে। নতুন কিছু তৈরি করতে পারবে, সৃষ্টি করতে পারবে।" এই বলাটা শুধু বলা নয়, করে দেখানো। অর্থাৎ শুধু জ্ঞান নয়, হাতে-কলমে উদ্বুদ্ধ করা। সে গানই হোক অথবা সিনেমা, কিংবা ভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান।

এই ভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান বলতে আসলে সময়ের থেকে এগিয়ে থাকা কিছু শিল্পকর্ম। একটা সময় মনিদা স্প্যানিশ কবি লোরকা পড়তে শুরু করে। সেখানে তার আবিষ্কার হল 'দুয়েন্দে', যা কিনা স্প্যনিশ লোকঐতিহ্য থেকে লোরকা তুলে এনেছিলেন। এই আঙ্গিকের মধ্যে নানা ধরনের মাধ্যম ব্যবহার করার চল আছে।

তো মনিদা তার নিজস্ব মিউজিকাল স্কোর তৈরি করে তার সঙ্গে কোরিওগ্রাফিকে জুড়ে নিয়ে অসাধারণ একটা পারফরম্যান্স বা অনুষ্ঠান করেছিল। যেমন যেমন লোকজন দরকার, তা জুটিয়ে এই কাজটির মধ্যে ঢুকে পড়ল একটার পর একটা রিহার্সালের মধ্যে দিয়ে।

একটি শো হয়েছিল কলকাতার শিশির মঞ্চে।

ব্যস, ওই পর্যন্তই। ওই যে বলছিলাম, আমরা তৈরি ছিলাম না। সেই সন্ধ্যায় যারা এই অনুষ্ঠান দেখেছে, তারা প্রত্যেকেই একটা অন্য গৌতম চট্টোপাধ্যায়কে আবিষ্কার করেছে। কাবেরীর নাচ নিয়ে এটা ছিল তার অন্যতম কাজ 'ইন সার্চ ফর দুয়েন্দে'। এরও পরে 'সময়' ছবিটি আটকে যাবে আর আমরা মনিদার কোরিওগ্রাফি নিয়ে কাজ দেখার থেকে বঞ্চিত হব।

একেকটি কাজের পিছনে শুধু পরিশ্রম নয়, তার জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ। অর্থ জোগান থেকে কলাকুশলীদের চিহ্নিত করা থেকে সমগ্র কর্মকাণ্ডের নেতৃত্ব দেওয়া একজন প্রকৃত ডিরেক্টর হয়ে। আমরা সেসময় দেখেছি, এবং তার তাবৎ কার্যপ্রণালী কিন্তু কখনোই গাম্ভীর্যপূর্ণ বা বিরক্তিকর ছিল না। ছিল না তার কারণ, মনিদার রসবোধ আর তার মানুষ চেনা, কর্মী চেনা মন।

আসলে যেকথা লিখব, বলে শুরু করেছিলাম তা তো উত্থাপনই করতে পারিনি। তা হলো, মনিদার করা সেলুলয়েডের কিছুই কি সত্যিই কখনও নতুন প্রজন্ম দেখতে পাবে না? ভাগ্যের ওপর কোনওদিন আস্থা রাখিনি, কিন্তু 'দুর্ভাগ্য' শব্দটিকেও অভিধানের বাইরে রাখতে পারিনি। মনিদার ক্ষেত্রে 'দুর্ভাগ্য' শব্দটা প্রায়ই ইতিউতি ঘুরে-ফিরে আসে। বড় মন খারাপ করে দেয়। 'নাগমতী' থেকে 'সময়' হয়ে দূরদর্শনের জন্য করা 'লেটার টু মম' কিংবা কার্বিদের নিয়ে ছবি- সবই বিভিন্ন বিভ্রাটে জড়িয়ে আছে। কোথাও দ্বন্দ, কোথাও মোকদ্দমা। গত তেত্রিশ বছর ধরে একথা কেউ বলেনি।

একটা না-দেখা সেলুলয়েডের ইতিহাস শেষ হয়ে গেল?

More Articles