Web series review: কল্পনার রাক্ষস নেমে এসেছিল বাস্তবে? যে গবেষণা নিয়ে আজও রটে ফিসফাস
'স্ট্রেঞ্জার থিংস' সিরিজের প্লটে আছে কিছু গভীর রহস্য আর সঙ্গে আছে বাস্তব ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে আসা এক অজানা রহস্যর হাতছানি।
নেটফ্লিক্স-এর অন্যতম জনপ্রিয় শো 'স্ট্রেঞ্জার থিংস'-এর সিজন ৪ মুক্তি পেয়েছে কিছুদিন আগেই, এবং প্রকাশ পেতেই তা বিপুল জনপ্রিয়তাও লাভ করেছে। এই সিরিজের বাকি সিজনগুলোর জনপ্রিয়তাও কিন্তু এখনও তুঙ্গে। কিন্তু ওয়েব সিরিজটির নেপথ্য ঘটনা কী? থ্রিলার, হরর ও সাই-ফাই জঁরের মিশ্রণে নির্মিত এই ওয়েব সিরিজ, এখানেই শেষ নয়, আছে মাইন্ড রিডিং, সময় ভ্রমণ, ও অন্য এক সমান্তরাল পৃথিবী। এই সিরিজের প্লটে আছে কিছু গভীর রহস্য আর সঙ্গে আছে বাস্তব ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে আসা এক অজানা রহস্যর হাতছানি। এই ওয়েব সিরিজটির নির্মাতা দুই বিখ্যাত যমজ ভাই রস ডাফার ও ম্যাট ডাফার, যাদের ডাফার ব্রাদার্স বলা হয়ে থাকে। ২০১৬ সালে নেটফ্লিক্স-এ এই সিরিজের প্রথম সিজন মুক্তি পেতেই ওয়েব সিরিজটি সবার মনে জায়গা করে নেয়।
গল্পের সূচনা হয় গত শতকের আটের দশকে, চার বন্ধু, যথা মাইক, লুকাস, উইল ও ডাস্টিনকে কেন্দ্র করে। প্রথম এপিসোড 'দ্য ভ্যানিশিং অফ উইল বায়ার্স'-এ হঠাৎ করেই একদিন উইল বায়ার্সের নিখোঁজ হয়ে যাওয়া ও তাকে খুঁজতে গিয়েই রহস্যের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে বাকি তিন বন্ধু। ঘটতে থাকে নানা অদ্ভুত ঘটনা, পাকতে থাকে গল্পের জট। দেখা পাওয়া যায় ইলেভেন নামে একটি মেয়ের, যার টেলিকাইনেটিক ক্ষমতা, বা সুপারপাওয়ার রয়েছে। এছাড়াও ঘটতে থাকে কিছু অতিপ্রাকৃত বিষয়, সঙ্গে চলতে থাকে নানা দুর্ঘটনা, অনুসন্ধান করতে গিয়ে প্রকাশ্যে আসে এইসব অদ্ভুত কার্যক্রমের সঙ্গে সরকারের সংযোগের কথা। জানা যায় 'আপসাইড ডাউন' বলে এক দুনিয়ার কথা, যা আমাদের জানা পৃথিবীর এক অন্য ডাইমেনশন। পরতে পরতে গন্ধ পাওয়া যায় রহস্যর।
ডাফার ব্রাদার্স বিভিন্ন কল্পবিজ্ঞান-সংশ্লিষ্ট কর্মকাণ্ডর দ্বারা তাদের এই গল্পের প্লট সাজিয়েছেন। কিন্তু 'স্ট্রেঞ্জার থিংস' দেখতে বসে সবাই হয়তো এই ওয়েব সিরিজকে নিছক মনোরঞ্জনের জন্যই দেখবেন, কাল্পনিক সিনেমাতে সময় ভ্রমণ, মাইন্ড রিডিং, এই পৃথিবীর মতোই হুবহু এক সমান্তরাল পৃথিবী এরম উদাহরণ আমাদের প্রায় সকলেরই দেখা। আর এই এই ওয়েব সিরিজে আটের দশকের জনপ্রিয় বহু মার্কিন সিনেমা, কমিকস ইত্যাদির ছাপও রয়েছে। কিন্তু যদি এমন কিছু তথ্য প্রকাশ পায়, যেখানে 'স্ট্রেঞ্জার থিংস'-এর কাহিনি সত্য বলে প্রমাণিত হয়, তখন?
আরও পড়ুন: মহাকাশে কীসের হৃদস্পন্দন? কোন রহস্যের সন্ধান পেলেন বিজ্ঞানীরা?
ভাবতেই অবাক লাগছে যে, এরম কোনও অতিপ্রাকৃত কল্পবিজ্ঞানের ঘটনা বাস্তবে সম্ভব কী করে? না, এমন কোনও প্রমাণ এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায়নি, যা 'স্ট্রেঞ্জার থিংস'-এর গল্পের সত্যতা একশো শতাংশ সত্যি বলে রায় দিয়েছে, কিন্তু কিছু মানুষ এমন বক্তব্য বিশ্বের সামনে তুলে ধরেছেন যে, তাঁরা নাকি নিজেরাই এই অতিবৈজ্ঞানিক কর্মকাণ্ডর সঙ্গে জড়িত ছিলেন ও সঙ্গে সঙ্গে সেই রহস্যময় 'মনটক' প্রোজেক্ট সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্যও প্রকাশ করেছেন। বলে রাখা ভাল, এই সিরিজের প্রথম নামও ছিল 'মনটক', যা এই সরকারি প্রোজেক্টের নাম অনুসারেই। আসুন, সেই ইতিহাসের ঘূর্ণিপাকে ঢোকা যাক, যার অপর নাম 'মনটক' প্রোজেক্ট।
মনটক প্রজেক্টের ভিত্তি স্তাপন ঘটে ইউএস-এ নিউ ইয়র্ক লং আইল্যান্ডের একটি যায়গা মনটক নামক স্থান থেকে। এই আর্মি বেস ১৮০০ সাল থকে ১৯৫০-এর দশক পর্যন্ত ঠান্ডা যুদ্ধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সক্রিয় বেস থাকলেও পরবর্তীতে এখানে আর্মিদের ট্রেনিং ও সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণাও এখানে করা হতো, তবে গবেষণাগুলি ছিল একটু অদ্ভুত ধরনের। যার সম্পর্কে অন্ধকারে ছিল গোটা বিশ্ব। তাহলে এই বৈজ্ঞানিক ল্যাবের গোপন কথা প্রকাশ পেল কী করে?
১৯৯০ সালে হঠাৎ করেই আত্মপ্রকাশ ঘটে প্রেস্টন নিকোলস নামে এক ব্যাক্তির। যার আবির্ভাব সূচনা ঘটায় এক জল্পনার, সরকারের দিকে আঙুল তুলতে বাধ্য করে বিশ্বকে। নিকোলস মনটক প্রজেক্ট সম্পর্কে কিছু আশ্চর্য ও কল্পনাতীত ঘটনা সকলকে জানান। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, সরকারই এই মনটক প্রোজেক্টের মূল উদ্যোক্তা ছিল, ও নিকোলস নিজে এই গবেষণার সঙ্গে যুক্তও ছিলেন। এরপরই আসে আসল চমক, যখন বৈজ্ঞানিক বলেন যে মাইন্ড রিডিং, টেলিকাইনেসিস দিয়ে মানুষের ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলা, ইত্যাদি নিয়ে পরীক্ষায় তাঁরা সাফল্য অর্জনও করেছেন। আরও অনেক বিস্ফারক তথ্য তিনি তুলে ধরেন, বলেন এইসব পরীক্ষা করা হতো বাচ্চাদের ওপর, বিশেষ করে আশ্রয়হীন, অনাথ শিশুদের ওপর। তাদের রাস্তা থেকে ধরে এনে বানানো হতো এই অদ্ভুত গবেষণার গিনিপিগ। এমনকী, গর্ভবতী মায়েদের ওপর চলত পরীক্ষা, যাতে তাদের বাচ্চারা বিশেষ শক্তির অধিকারী হয়। জন্মদাত্রী মায়েদের থেকে কেড়ে নেওয়া হতো বাচ্চাদের। এই সবই হতো মার্কিন সরকারের নির্দেশে। অবাক লাগে এই ভেবে যে, সরকার কী করে এমন নিষ্ঠুর হতে পারে? খোদ সরকার নিজে কী করে এই অন্যায় কর্মকাণ্ড চালাতে পারে?
নিকোলসের এই বক্তব্যগুলি বাস্তবে এতই আলোড়নের সৃষ্টি করে যে, সবাই ঘটনার সত্যতা জানতে মরিয়া হয়ে ওঠে। অনুসন্ধানকারীরা জানায় যে, নিকোলসের কথা সব ঠিক, তা যেমন প্রমাণ করা যায়নি, তা যে মিথ্যে তাও তারা প্রমাণ করতে পারেনি। কারণ মনটক প্রজেক্টের অন্তর্গত এমকেআলট্রা নামে কিছু গবেষণা এখনও বর্তমান। ফলে বিশ্ববাসী এক প্রকার নিকোলসের কথা বিশ্বাস করে নিতে বাধ্য হয়।
নিকোলস বলেন, তাঁর এতদিন বাদে আত্মপ্রকাশের।অন্যতম কারণ হলো তাঁর স্মৃতি লোপ পেয়েছিল, বা বলা ভালো, তাঁর স্মৃতি লোপ ঘটানো হয়েছিল, যাতে এই গবেষণার খবর বাইরে প্রকাশ না পায়। এরপরই ১৯৯২ সালে প্রেস্টন নিকোলস ও পিটার মুন প্রকাশ করেন তাঁদের বই ‘দ্য মনটক প্রজেক্ট: এক্সপেরিমেন্ট ইন টাইম’। বইতে মনটক প্রজেক্ট সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য আলোচনা করেন নিকোলস। যে মুহূর্তে নিকোলসের বক্তব্য আলোড়নের ঢেউ তুলেছে, ঠিক তখনই আর এক চমকের সঙ্গে হাজির অন্য এক মনটক প্রজেক্টের সাক্ষী ডানকান ক্যামেরন। তিনিও দাবি করেন যে, তাঁরও স্মৃতি লোপ পেয়েছে। ফলে তিনি নিকোলসের সাহায্য নেওয়ার জন্য তাঁর কাছে হাজির হন। দু'জনেই তাঁদের হারানো স্মৃতি পুনরুদ্ধার করতে ফিরে যান মনটকের সেই পরিত্যক্ত আর্মি বেসে ও আশ্চর্যভাবে ডানকান সেই স্থান চিনতেও পারেন।
এরপর আরও গভীরভাবে তাঁদের লোপ পাওয়া স্মৃতির ওপর পরীক্ষা শুরু করেন তাঁরা, ও ফিরে পেতে থাকেন তাঁদের হারানো স্মৃতি। ভেসে উঠতে থাকে অতীতের অনেক গোপন রহস্যের
প্রতিচ্ছবি ও বুঝতে পারেন, তাঁরা দু'জনেই এককালে এই প্রোজেক্টের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন। ডানকান ও নিকোলস বুঝতে পারেন যে, ডানকান ছিল হতদরিদ্র বাচ্চা, যার ওপর সমস্ত পরীক্ষা করা হতো। একে একে তাঁদের মনে পড়তে থাকে, কী কী পরীক্ষা বা গবেষণা তাঁরা করে চলছিলেন।
তাঁদের প্রথম এক্সপেরিমেন্ট ছিল ‘সিইং আই’। অর্থাৎ, ডানকান যদি যে-কোনও মানুষের ওপর যথেষ্ট মনোযোগ দেয়, তাহলে সেই মানুষটি ও ডানকানের মধ্যে একটি সংযোগ স্থাপন হবে। এর ফলে ডানকান সেই মানুষটির চোখ দিয়ে দেখতে পেত ও সেই মানুষটির দেহকে সে অনুভব করতেও পারত। ইত্যাদি নানা ধরনের পরীক্ষা ডানকানের ওপর করে চলছিল বৈজ্ঞানিকরা। ধীরে ধীরে ডানকানের শক্তি এতই বৃদ্ধি পেতে লেগেছিল যে, তাঁর কল্পিত বস্তু বাস্তবেও দেখা দিতে থাকে। এইভাবে নাকি ডানকান একদিন বাস্তব জগতে হাজির করে তাঁর কল্পিত এক রাক্ষসকে, ঘটনার আকস্মিকতায় ভয় পেয়ে বৈজ্ঞানিকরা প্রোজেক্টই বন্ধ করে দেন। বোঝাই যাচ্ছে, এই সিরিজের মূল চরিত্র ইলেভেন আসলে ডানকানের আদলে তৈরি। এরপরই তাঁর স্মৃতির লোপ ঘটে বলে জানান নিকোলস, ও এও বলেন যে, তাঁরা নাকি ওই সময়ে সময় ভ্রমণেও সাফল্য অর্জন করেছিলেন।
বাস্তবে এই ঘটনার সত্যতা নিয়ে অনেক মতভেদ বর্তমান। এই দুই বিজ্ঞানীর আত্মপ্রকাশের পরেও অনেক ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটে ও তাঁরাও বলেন যে, তাঁরাও এককালে মনটকের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এরপরই ১৯৮৫ সালে ইউএস প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন সর্বসমক্ষে সরকারের বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য ক্ষমা চান। মনটক প্রজেক্ট বাস্তবে থাকুক বা না থাকুক, ডাফার ব্রাদার্স কিন্ত ঘটনার সঠিক প্রয়োগ করেছেন।এই সিরিজের নাম তাঁরা 'মনটক' রাখতে চাইলেও বিভিন্ন সমস্যার জন্য শেষ অবধি 'স্ট্রেঞ্জার থিংস' নামটি রাখতেই তাঁরা বাধ্য হন। বাস্তবের মনটক প্রজেক্ট সিরিজে হয়ে গেছে হকিন্সের হকিন্স ল্যাব। গল্পের গভীর বুনন, অসামান্য কাজ আর নেপথ্য কাহিনির রহস্য কিন্তু 'স্ট্রেঞ্জার থিংস'-কে সত্যি স্ট্রেঞ্জ করে তুলেছে।