হাজার হাজার মানুষ বুঁদ নেশায়! কয়েক বছরে কাশ্মীরে কেন হু হু করে ছড়াল মাদক মহামারী?

Kashmir Drug Addition Problem: জম্মু ও কাশ্মীরের প্রায় এক মিলিয়ন মানুষ, অর্থাৎ এই অঞ্চলের জনসংখ্যার প্রায় ৮% গাঁজা, ওপিওডস বা সেডেটিভ সহ কিছু ওষুধ ব্যবহার করে।

কাশ্মীর! আশাবাদীরা বলবেন, এই সমস্যা একদিন মিটবেই। বাস্তবাদীরা বলবেন, কোনওদিনই জম্মু-কাশ্মীরের সমস্যা মিটবে না কারণ মেটানো হবে না। কাশ্মীর দেশের অংশ, অন্তত ম্যাপ তাই বলে। অথচ কাশ্মীরের জীবনের সঙ্গে বাকি সারাটা দেশের কোনও পরিচয়ই নেই। সিনেমায় দেখানো উপত্যকা, ট্যুরিস্ট স্পট আর 'দেশাত্মবোধক' সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত ছবি-ভিডিও ছাড়া কাশ্মীরকে আমরা কীভাবে চিনি? কাশ্মীরের পাহাড়ি জীবনের অস্থিরতা আর অনিশ্চয়তার তুলনায় কোনও কিছুই পর্যাপ্ত উদাহরণ হয়ে উঠতে পারেনি। ভারত বলে কাশ্মীর তাদের, পাকিস্তান বলে তাদের! কাশ্মীর কী বলে? ১৯৮৯ সাল থেকে, কাশ্মীরে ভারতীয় শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হয়েছে। প্রতিবছর মৃত্যু হয় মানুষের। ২০১৯ সালে, ভারত পূর্ববর্তী জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যকে দু'টি ফেডারেল শাসিত অঞ্চলে বিভক্ত করে। এই ভাগাভাগির পরে উত্তেজনা আরও বাড়ে। এইসবের মধ্যেই কাশ্মীরে এখন নতুন সংকট হয়ে উঠেছে মাদক! কাশ্মীরে মাদকাসক্তি বাড়ছে। শয়ে শয়ে তরুণ মাদকাসক্ত! সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য, কোনও স্থানীয় নেশার দ্রব্য নয়! হেরোইনের মতো কঠিন ড্রাগ সেবনের হার বাড়ছে ভূস্বর্গে।

মার্চ মাসে একজন মন্ত্রী সংসদে জানিয়েছিলেন, জম্মু ও কাশ্মীরের প্রায় এক মিলিয়ন মানুষ, অর্থাৎ এই অঞ্চলের জনসংখ্যার প্রায় ৮% গাঁজা, ওপিওডস বা সেডেটিভ সহ কিছু ওষুধ ব্যবহার করে। তুলনামূলক কোনও পরিসংখ্যান না থাকলেও চিকিৎসকরা বলছেন, রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। বছর দশেক আগেও স্থানীয় হাসপাতালে প্রতিদিন ১০-১৫টি মাদকাসক্তির ঘটনা আসত। এখন প্রতিদিন ১৫০-২০০ জন আসেন মাদকাসক্তির সমস্যা নিয়ে। বিষয়টা যে মোটেও সুবিধার নয়, স্বীকার করছেন IMHANS-এর মনোরোগ বিশেষজ্ঞ এবং অধ্যাপক ডঃ ইয়াসির রাথার৷ পাহাড়ি অঞ্চলে মাদকের অপব্যবহার নতুন কোনও সমস্যা কিন্তু নয়। কিন্তু আগে গাঁজা বা অন্যান্য স্থানীয় নেশাই করতেন মানুষ। হেরোইনের কোনও গল্পই ছিল না! কেন মাদকের প্রতি আসক্তি বাড়ছে দ্রুতগতিতে? বিশেষজ্ঞরা একাধিক কারণ দেখছেন নেপথ্যে। জন্ম থেকে অশান্তির মধ্যে বাস, জীবনের নিরাপত্তা নেই কোনও, চাকরি নেই, মর্যাদা নেই! সবটা জন্ম দিচ্ছে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার, সেই সমস্যা থেকে তড়িঘড়ি নিষ্কৃতি পেতে তরুণ-যুবকরা মাদকের শরণে আসছেন।

আরও পড়ুন- কাশ্মীর থেকে রাশিয়া অবধি সুড়ঙ্গ! যে সাতটি গুহার রহস্যভেদ হয়নি আজও…

তবে পাকিস্তান উঁকি দিয়েছে এখানেও। দেশের পুলিশ বলছে, বিপুল পরিমাণ নিষিদ্ধ পদার্থ বাজেয়াপ্ত হয়েছে যার পিছনে পাকিস্তানের যোগসূত্র খুঁজে পেয়েছেন তারা। মাদক চোরাচালানের অর্থ কাশ্মীরে জঙ্গিগোষ্ঠীদের কাজে ব্যবহৃত হয় বলে তাদের দাবি। মাদক ব্যবসায়ীদের কয়েকজন বলছেন, পঞ্জাব ও দিল্লিসহ ভারতের অন্যান্য রাজ্য থেকেও নেশার দ্রব্যের সরবরাহ পান তারা।

জম্মু ও কাশ্মীর প্রশাসন গত বছর একটি সমীক্ষা চালায় (২০১৮ সাল থেকে এই অঞ্চলে কোনও নির্বাচিত সরকার নেই)। ওই সমীক্ষায় কাশ্মীরের ৫২,০০০ এরও বেশি মানুষ হেরোইন সেবনের করার কথা স্বীকার করেছে। সমীক্ষায় আরও প্রকাশ্যে এসেছে যে, মাদকদ্রব্যটি পেতে একজন মানুষ মাসে গড়ে প্রায় ৮৮,000 টাকা খরচ করেন! সাধারণ মানুষের হাতে এত টাকার জোগানই বা কীভাবে আসছে সন্ত্রস্ত কাশ্মীরে?

কাশ্মীরের স্বাস্থ্য পরিষেবার পরিচালক ডাঃ মুশতাক আহমেদ রাথার জানাচ্ছেন, সরকার সমস্যা মোকাবিলায় বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। তবে রাজ্যে আরও পুনর্বাসন কেন্দ্রের আশু প্রয়োজন! কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তবে কাশ্মীরে মাত্র দু'টি সরকারি মাদক পুনর্বাসন কেন্দ্র রয়েছে এবং দু'টিই শ্রীনগরে, একটি IMHANS, অন্যটি পুলিশ পরিচালিত। রোগীদের বেশিরভাগই পুরুষ, কিছু মহিলাও রয়েছেন।

শ্রীনগরে একটি দোকান চালান বছর তেইশের এক যুবক। তিন সপ্তাহ IMHANS-এ ছিলেন তিনি। নিজের আয় থেকে প্রতিদিন কিছু হেরোইন কিনতেন। সম্প্রতি বিয়ের কথাবার্তা পাকা হয়েছে, বাগদত্তা পুরো বিষয়টি জানতে পেরেই ওই যুবককে পুনর্বাসনকেন্দ্রে পাঠান। বছর ১৫-র কিশোর, দাড়িগোঁফের রেখাও নেই চেহারায় তেমন, অথচ বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে ড্রাগ ব্যবহার শুরু করে ফেলেছেন। কী করে মিলছে এই মাদক? কাশ্মীরে যে সহজেই ড্রাগস পাওয়া যায় স্পষ্ট করে জানিয়েই দিয়েছেন ওই কিশোর।

আরও পড়ুন- ভূস্বর্গের নীচে ৫৯ লক্ষ টন ‘সাদা সোনা’র আবিষ্কার! রাতারাতি ভাগ্য বদলাচ্ছে কাশ্মীরের

চিকিত্সকরা বলছেন কাশ্মীরে হেরোইনের মতো কঠিন ড্রাগের ব্যবহার তীব্রভাবে বেড়েছে। ২০১৯ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে মাদকবিরোধী আইনের অধীনে ৫,০০০ এরও বেশি মামলা নথিভুক্ত হয়েছে এখানে। মাদকদ্রব্যের বিক্রি এবং ব্যবহার সম্পর্কিত আইন ছাড়াও জননিরাপত্তা আইনের মতো কঠোর আইনও ব্যবহার করছে। তবে সবকিছুর পরেও হু হু করে মাদকের নেশা ঢুকে পড়েছে ঘরে ঘরে, মহামারীর মতোই!

শুধু তো মাদকের নেশা না। ড্রাগ ব্যবহারকারীরা মাঝে মাঝে একই সিরিঞ্জ ব্যবহার করেন, ফলে হেপাটাইটিস সি-এর মতো সংক্রমণের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। মাদকের জন্য বিপুল পরিমাণে কাঁচা টাকা জোগাড় করতে গিয়ে চুরির মতো অন্যান্য অপরাধও বাড়ছে। নিজেদের ঠেকিয়ে রাখতে পারছেন না কাশ্মীরের নতুন প্রজন্ম। পুনর্বাসন কেন্দ্রে গিয়ে, সামান্য সুস্থ হয়ে ফিরেও ফের হেরোইনের নেশা টেনেছে নিশির ডাকের মতোই! পাকিস্তানের তরুণ প্রজন্মকে নেশায় আচ্ছন্ন করার নেপথ্যে কোনও বড় কারণ রয়েছে কি? নেশাগ্রস্ত তরুণদের দমিয়ে আসলে কি কাশ্মীরকে 'শান্ত' প্রমাণ করতে চাইছে যুযুধান রাষ্ট্রশক্তিরা, আর তলে তলে চলছে কোনও বিশেষ প্রস্তুতি? যুদ্ধ শুধুই ময়দানে হয় না, সবচেয়ে মারাত্মক লড়াই চলে বিষপ্রয়োগের, তা চলে গোপনে। একদিন সেই বিষের প্রভাব টের পাওয়া যায়, রাষ্ট্র হাসে। আর সাধারণ মানুষের অনেকটাই দেরি হয়ে যায়।

More Articles