পঞ্চাশের কাছাকাছি মৃত্যু, আক্রান্ত ৮২৮! সত্যিই HIV মহামারী ত্রিপুরায়?

Tripura HIV cases: ত্রিপুরার ২২০টি স্কুল এবং ২৪টি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় জুড়ে এই মহামারী ছড়িয়ে পড়েছে। এই খবর ঘুরছে সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে। কিন্তু কতটা সত্যি এই খবর?

করোনা বা ডেঙ্গু নয়। হঠাৎ করেই এইচআইভি মহামারী। এক ধাক্কায় ত্রিপুরায় ৪৭ জনের মৃত্যু। আক্রান্ত অন্তত ৮২৮ জন। মৃত এবং আক্রান্ত প্রত্যেকেই পড়ুয়া। ত্রিপুরার ২২০টি স্কুল এবং ২৪টি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় জুড়ে এই মহামারী ছড়িয়ে পড়েছে। এই খবর ঘুরছে সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে। কিন্তু কতটা সত্যি এই খবর? এইডসের মতো ভয়াবহ রোগ কীভাবে এত লোকের মধ্যে ছড়ালো, তা-ও আবার এত দ্রুত! বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ ছড়িয়েছে গোটা দেশ জুড়ে।

শোনা যাচ্ছে, ইঞ্জেকশনের মাধ্য়মে মাদক সেবনের ফলেই নাকি পড়ুয়াদের মধ্যে দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে এই রোগ। ইতিমধ্যেই বিষয়টি নিয়ে হইচই ছড়িয়েছে দেশ জুড়ে। এই পরিস্থিতিতে একটি বিবৃতি জারি করা হয়েছে ত্রিপুরা সরকারের তরফে। তারা জানিয়েছে, এই খবর সম্পূর্ণ সত্য নয়। বরং বিষয়টি বিভ্রান্তিকর। সরকারের তরফে জানানো হয়েছে, এই সংখ্যাটা কোনও এক বছরের নয়। এই পরিসংখ্যানগুলি আসলে গত ১৭ বছরের সম্মিলিত হিসেব।২০০৭ সালের এপ্রিল মাস থেকে ২০২৪ সালের মে মাস পর্যন্ত হিসেবে ওই বিরাট সংখ্যক এইডস আক্রান্তের খবর ছড়িয়েছে ত্রিপুরায়।

আরও পড়ুন: অবশেষে বাস্তব হতে চলেছে অসম্ভব! এইডস এবার সারবে ‘কাঁচি’ দিয়েই?

সেই বছরগুলির মধ্যে ৮২৮জন পড়ুয়া ত্রিপুরার এআরটি সেন্টারে তাঁদের নাম নথিভুক্ত করেছিলেন এটা হল ওই বছরগুলিতে সব মিলিয়ে কতজন পড়ুয়া তাঁদের নাম নথিভুক্ত করেছিলেন তারই গোটা সংখ্য়া। সেই সঙ্গেই বিবৃতিতে বলা হয়েছে যে ৮২৮জন পড়ুয়া গত কয়েক বছরে যারা এআরটি সেন্টারে নাম নথিভুক্ত করেছিলেন তাদের ফ্রিতে ন্যাকোর গাইডলাইন মেনে প্রয়োজনী চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। আর যে ৪৭জন মৃত্যুর কথা বলা হচ্ছে তা ২০০৭ সাল থেকে ২০২৪ সালের মে মাস পর্যন্ত।

১৯৯৯ সালের এপ্রিলে যাত্রা শুরু করেছিল ত্রিপুরা স্টেট এইডস কন্ট্রোল সোসাইটি বা টিএসএসিএস। ২০০৭-এর এপ্রিল থেকে শিক্ষার্থীদের মধ্যে এইচআইভি সংক্রমণের পরিসংখ্যান রাখা হয়। সেই পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সেই সময় থেকে ২০২৪-এর মে মাস পর্যন্ত, রাজ্যে ৮২৮ জন শিক্ষার্থী এইচআইভি পজিটিভ বলে শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে ৫৭২ জন শিক্ষার্থী এখনও বেঁচে আছে এবং ৪৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। সরকার আরও দাবি করেছে, অনেক শিক্ষার্থীই উচ্চশিক্ষার জন্য ত্রিপুরার বাইরে দেশের অন্যান্য জায়গার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাড়ি দিয়েছে।

ত্রিপুরা স্টেট এইডস কন্ট্রোল সোসাইটির পক্ষ থেকে একটি বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ন্যাশানাল এইডস কন্ট্রোল প্রোগ্রাম ১৯৯৯ সালের এপ্রিল মাস থেকে এই কর্মসূচি ত্রিপুরায় প্রয়োগ করা হয়েছে। ত্রিপুরা স্টেট এইডস কন্ট্রোল সোসাইটি সমস্ত প্রচেষ্টা জারি রেখেছি এই রোগ আটকানোর ক্ষেত্রে । সেটা সমস্ত গাইডলাইন মেনে করা হয়েছে। ন্যাশানাল এইডস কন্ট্রোল প্রোগ্রাম অনুসারে এটা করা হয়েছে।

হিউম্যান ইমিউনোডেফিসিয়েন্সি ভাইরাস (এইচআইভি) বা এইডস একটি সংক্রামক রোগ। যা রক্ত, লালার মতো শরীরের যে কোনও দেহরসের মাধ্যমে সংক্রমিত হতে পারে। মূলত দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার উপরেই আঘাত করে এই ভাইরাস। যার ফলে শরীরে একাধিক রোগব্যধি দানা বাঁধে। একই সঙ্গে একাধিক রকম ক্যান্সারে আক্রান্ত হতে পারে মানুষ। এবং ক্রমে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ে। এই ভাইরাস একবার দেহে সংক্রমিত হলে ওষুধ ও চিকিৎসার মাধ্যমে তার গতি কমানো সম্ভব হলেও, পুরোপুরি নির্মূল সম্ভব নয়। ফলে এখনও এক বিভীষিকার নাম এইডস। যৌন মিলন থেকে শুরু করে দূষিত সূঁচ বা সিরিঞ্জের ব্যবহার থেকেও ছড়াতে পারে এই রোগ। এই রোগের বাড়বাড়ন্ত আটকাতে সরকারের তরফে বহুদিন ধরেই বহু পরিকল্পনা ও প্রচারমূলক কর্মসূচী নেওয়া হয়েছে। সচেতনতা ছড়ানোও সম্ভব হয়েছে একটা পর্যায়ে। তার মধ্যেই ত্রিপুরায় এ ধরনের রোগের সংক্রমণকে কেন্দ্র করে উদ্বেগ ছড়িয়েছে।

ত্রিপুরায় এইচআইভি সংক্রান্ত যে খবর ভাইরাল হয়েছে, তা পুরোপুরি ঠিক নয়। তবে তাতে যে একেবারে উদ্বেগমুক্ত হওয়া গিয়েছে, তা কিন্তু নয়। সূত্রের খবর, ২০২২-২৩ সালে ত্রিপুরায় সব মিলিয়ে নতুন HIV সংক্রামিত হয়েছেন ১৮৪৭জন। মৃত্যু হয়েছে ৬৭ জনের। ২০২৩-২৪ সালের HIV নতুন সংক্রমণের সংখ্যা ১৭৯০জন। মৃত্যুর সংখ্য়া ৪৪। এইডসে এই মুহূর্তে সেখানে ঠিক কতজন আক্রান্ত বা কতজন মারা গিয়েছেন, তা নিয়ে যাতে কোনওরকম বিভ্রান্তি না ছড়ায় সেকারণেই সামগ্রিকভাবে তথ্য় জানানো হয়েছে সরকারের তরফে। তবে এইডস সংক্রমণের সঙ্গে সত্যিই মাদকসেবনের কোনও যোগ রয়েছে কিনা, তা নিয়ে কিছু স্পষ্ট করে বলা হয়নি।

আরও পড়ুন: আদৌ কি টিকায় নির্মূল হয় এই রোগ? কীভাবে মানব শরীরে প্রথম প্রবেশ করেছিল এইডস?

তবে সম্প্রতি, ত্রিপুরা জার্নালিস্ট ইউনিয়ন, ওয়েব মিডিয়া ফোরাম এবং টিএসএসিএস-এর যৌথ উদ্যোগে একটি কর্মশালার আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানে টিএসএসিএস-এর জয়েন্ট ডিরেক্টর শুভ্রজিৎ ভট্টাচার্য পরিস্থিতির গুরুত্ব বোঝাতে ওই পরিসংখ্যান দিয়েছিলেন। তাঁরা জানিয়েছিলেন,রাজ্যের মোট ১৬৪টি স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও হাসপাতাল থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। সমস্ত ব্লক এবং মহকুমা থেকে রিপোর্ট সংগ্রহ করা হয়েছে। TSSES-এর যুগ্ম পরিচালক এখনও পর্যন্ত ২২০টি স্কুল, ২৪টি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় চিহ্নিত করা হয়েছে, যেখানে শিক্ষার্থীরা মাদক নেয়। তিনি আরও জানান, 'আমরা রাজ্য জুড়ে মোট ১৬৪টি ডেটা দেখেছি। ART (অ্যান্টিরেট্রো ভাইরাল থেরাপি) কেন্দ্রগুলিতে ৮২৭৯ জনকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এইচআইভি আক্রান্ত মোট লোকের সংখ্যা ৫,৬৭৪। এর মধ্যে ৪৫৭০ জন পুরুষ এবং ১১০৩ জন মহিলা। তিনি বলেন, 'যারা আক্রান্ত হচ্ছে তাদের বেশিরভাগ জই ধনী পরিবারের। এইচআইভিতে আক্রান্ত এমন পরিবারও আছে যেখানে বাবা-মা দুজনই সরকারি চাকরি করেন। সন্তানদের সব চাহিদা পূরণ করেন। হাতে টাকা দেন। আর সেই টাকা থেকেই নেশা করেন পড়ুয়ারা।'

টিএসএসিএস-এর কর্তারা আরও জানিয়েছিলেন, ২০২৪ সালের মে মাস পর্যন্ত, ত্রিপুরার অ্যান্টিরেট্রোভাইরাল থেরাপি কেন্দ্রগুলি ৮,৭২৯ জন এইচআইভি আক্রান্তকে নিবন্ধিত করা হয়েছে। তাদের মধ্যে, জীবিত রয়েছেন ৫,৬৭৪ জন। এর মধ্যে ৪,৫৭০ জন পুরুষ, ১,১০৩ জন মহিলা এবং একজন ট্রান্সজেন্ডার আছেন।

More Articles