প্রিয়জনেষু মা, তুমিই তো যজ্ঞের আগুন, তুমিই তো স্নানের জল!
Mother's day 2023" আমাদের সব স্বেচ্ছাচারী আবদারের গোপন আলমারি, অনির্দিষ্ট অন্ধকারের এককহীন আলো-রেখা, পুঞ্জীভূত পাপের ঐকান্তিক শুদ্ধিকরণ- ওই একটিই শব্দ, ‘মা’।
ও মা,
শোনো না, তোমায় একটা চিঠি লিখছি। তোমার পড়ার কি সময় হবে? জানি, তুমি কী বলবে! বেশ, তোমার রাজ্যের কাজ সামলে, তারপরেই পড়ো।
সেই ছোট্টবেলা থেকে সবাই আমাকে বলেছে, আমি নাকি বড্ড ‘মায়ের আঁচল-ধরা’ মেয়ে! শুনেছি, আমি জন্মানোর প্রথম কয়েকবছর তুমি ঠিক মতো স্নান করারও অবকাশ পেতে না। দৈহিক সৌন্দর্যের খোঁজ তখন প্রায় তলানিতে ঠেকেছে। তবু ধৈর্যের প্যারামিটারকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে, প্রাণপাত করেছ অবিরত! অনুভূতির অপ্রতিরোধ্যতা সেই বয়স থেকেই আমার সঙ্গী হয়েছিল। তুমি বিছানা ছেড়ে উঠলেই শুরু হত কণ্ঠরোধী কান্না! একটু বড় হওয়ার পরেও সেই অভ্যেস যায়নি। শুধু কান্নার শব্দ বদলে গেছে ফোঁপানিতে। তুমি জিজ্ঞাসা করেছ বহুবার, তুমি আমার পাশচ্যুত হলে, কী করে টের পাই আমি! উত্তরে বলেছি, "তুমি বিছানা ছেড়ে উঠে গেলে, বিছানাটা কেমন যেন হালকা হয়ে যায়!" আজ বুঝি, যে বয়সে শূন্যতার বোধ না-বোঝার মতো ভাগ্যবান থাকে মানুষ, সে বয়সে শূন্যতাকে অমন ‘হালকা’ বলে ভ্রম হয়। আমি ছিলাম সেই বয়সের অধিকারী। সময়ের দাবিতেই সেই বয়স হারিয়েছি, বহুকাল। আজ যাপনের গহিনে শূন্যতার বোধ নক্ষত্রের দোষে জর্জরিত। তোমার আজন্ম হাড়-জ্বালানো মেয়েটা এখন একা ঝড় সামলায়, অন্তত চেষ্টা করে সামলাতে। না, আর কেঁদে ওঠে না সে। কান্নার বিজ্ঞাপনকে এখন সে মন থেকে ঘৃণা করে। জীবন নিয়ে আবিল বিলাপে তার প্রবল অনীহা।
এই দেখ, তোমায় নিয়ে লিখতে বসে ঘুরে ফিরে সেই নিজের কথাই লিখছি! কেন এমন হয় বলো তো! তোমার সব কথা আসলে কি আমারই? আমি কি ঠিক তোমারই মতো, মা? না, এই 'স্টেটমেন্ট' দেওয়ার দুঃসাহস আমার নেই। শুধু উন্নিদ্র ঝড়ের রাতগুলোতে মনে মনে ঝালিয়ে নিই তোমারই মায়াবী মুখমণ্ডল। তোমার মতো হয়ে ওঠার সোনার হরিণের পিছনে ছুটি না। সে সব এলোমেলো অন্ধকারে বরং জাগিয়ে তুলতে চাই আমার মধ্যেকার ‘তুমি’টাকে। সেই কোন ছোট্টবেলা থেকে আমি যে তোমায় আকণ্ঠ ধারণ করেছি, মা! মনে আছে, ছোটবেলায় আমার খুব সর্দিকাশির ধাত ছিল। কালো মাশকলাই আর সরষের তেল মিশিয়ে তুমি আমায় মাখিয়ে দিতে, নিরাময়ের আশায়। তেল মাখাতে মাখাতে মাঝে মাঝেই গুনগুনিয়ে উঠতে তুমি,
বজ্রমানিক দিয়ে গাঁথা, আষাঢ় তোমার মালা।
তোমার শ্যামল শোভার বুকে বিদ্যুতেরই জ্বালা।।
আমার রোগা-ভোগা শরীরটায় তখনই কি তুমি এঁকে দিতে চাইতে বজ্রমানিকের আদিম আলেখ্য? কানে কানে কি সেই মন্ত্রই দিতে? বড় হয়ে, যতবার রবীন্দ্রসঙ্গীতের নির্মিতি নির্ণয়ে পা বাড়িয়েছি, ততবার এই গানের দ্বিতীয় লাইনে এসে তোমাকেই দেখতে পেয়েছি। থমকে দাঁড়িয়েছি। তোমার কোমল সবুজাভ আদর-যত্নের আড়ালে সুপ্ত বিদ্যুতের জ্বালাময়ী আভাসকে আজীবন লালন করেছ নিজের ভিতর! বিদ্যুতের জ্বালাটুকু একা সামলে, আলোটুকুকে তুলে দিয়েছ আমার হাতে। কিংবা রেখে গিয়েছ পায়ের কাছে। সেই আলো পায়ে আজও পথ হাঁটছি, মা গো।
সমরেশ মজুমদারের ‘উত্তরাধিকার’-এর একটা অংশ খুব মনে পড়ছে। যেখানে ছোট্ট অনিমেষ তার মায়ের কাছে জানতে চায়, অপরিচিত কুলি ও কামিনের অন্তরঙ্গ মুহূর্ত দেখে ফেলায় তার পাপ হয়েছে কিনা! উত্তরে মাধুরী (অনিমেষের মা) উচ্চারণ করেন এক অদ্ভুত বাক্য, "… মায়ের কাছে সব কথা খুলে বললে কোনও পাপ আর থাকে না। তুমি চিরকাল আমাকে সব কথা খুলে বলো অনি।" ক্লাস এইটে, এই অংশ পড়ে কাঁটা দিয়েছিল গায়ে! মা যেন যজ্ঞের আগুন, মা যেন স্নানের জল! ওই শব্দব্রহ্মের স্পর্শে যেন পবিত্র হয় সমস্ত পাপ! সমস্ত ক্ষয় যেন নতজানু হয় তোমার পূর্ণতার অভিঘাতে। আরও একটি বিষয় বড় বিস্মিত করেছিল সেই কিশোরীবেলায়– তুমি আর মাধুরী কীভাবে অবিকল এক কথা বলতে পারলে! পৃথিবীর সব মায়েরা কি তবে একইভাবে কথা বলে? শৈশব থেকে যুবতীবেলা পেরিয়েও নিরন্তর জমে ওঠা নিযুজ-কথা তোমাকে উজাড় করে না দেওয়া পর্যন্ত স্বস্তি পাইনি, আজও পাই না। পাপের কথা, পরাজয়ের কথা, প্রত্যাখ্যানের কথা, আলো-অন্ধকারের কথা, সমস্ত কথকতার শেষে, চিরকালীন বিশ্বাসের মতো নীরব ছায়া দিয়েছ তুমি। তোমার কাছেই তো শেখা, নিশ্ছিদ্র নীরবতার আশ্রয় কত শত যন্ত্রণার পৌরাণিক প্রতিষেধক!
মেয়েরা নাকি প্রেমিকের মধ্যে তার বাবাকে খোঁজে। কিন্তু আমি যে তার ভিতরেও তোমাকেই খুঁজে চলি, মা! প্রেমিকের প্যামপারিং, ভাসমান ভালোবাসার আবদারেও মাথার ভিতর গুনগুনিয়ে ওঠে চন্দ্রবিন্দুর সেই ল্যান্ডমার্কিং লাইন, "…তুমি মায়ের মতোই ভালো…।" মনে হয়, "তোমায় খোঁজা শেষ হবে না মোর।" পথে ঘাটে, ট্রামে বাসে কেউ একটু মিঠে সুরে কথা বললেই, তাকে আমার তোমার মতো লাগে, মা গো! তার স্বরের অপরিচিত গলিঘুঁজির সঙ্গে, তোমার স্বরভঙ্গির খানাখন্দ মিলিয়ে দেখে নিতে মন চায়! এক অনমনীয় বিশ্বাস যেন বাসা বেঁধেছে আমার শরীর জুড়ে – বিশ্বের হৃদয় খুঁড়ে খুঁড়ে নির্মল যা কিছু পেয়েছি এতকাল, সবই আদতে ‘মা’ শব্দের তদগত তর্জমা!
পরাবাস্তবতার রঙ-তুলিতে, ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে কোনও ‘ডাউটলেস ডিভা’ হিসেবে তোমাকে আঁকতে আমার মন চায় না! কলেজের দ্বিতীয় বর্ষে বিমল করের ‘জননী’ গল্পটি পড়ে, বেশ চমকে উঠেছিলাম। যেখানে বস্তুবাদীতার চক্রব্যূহ পেরিয়ে, পাঁচ জন সন্তান তাদের মৃতা মা-কে উপহার দিচ্ছে যাপনানুভূতির বিমূর্ত সব হিরে মানিক। কিন্তু বাস্তবে তোমায় তেমন কিছু দেব, ততখানি হৃদয়ের ঐশ্বর্য আমার নেই। তার চেয়ে বরং, এসো, আমরা একে অপরের ‘হৃদয়ের চক্ষু’ হয়ে বাঁচি। একে অপরের ব্যথার উপশম হই। ‘মাদারহুড’ কিংবা ‘ডটারহুড’, আসলে সবই তো দ্ব্যর্থহীন বন্ধুতার সুরেলা সিম্ফোনি, বলো…
বিথোভেন তাঁর জন্মান্ধ বন্ধু-কন্যাকে জ্যোৎস্নার ধারণা দিতে সৃষ্টি করেছিলেন ‘মুন লাইট সোনাটা’। আমরা তো জন্মান্ধই ছিলাম, মা! তোমরাই তো আনুপূর্বিক জ্যোৎস্না চেনালে আমাদের। সব মায়েরাই কি তবে বিথোভেন নয়? আমাদের সব স্বেচ্ছাচারী আবদারের গোপন আলমারি, অনির্দিষ্ট অন্ধকারের এককহীন আলো-রেখা, পুঞ্জীভূত পাপের ঐকান্তিক শুদ্ধিকরণ- ওই একটিই শব্দ, ‘মা’। ‘জন্মদাত্রী’র ছক ভেঙে, ‘মা’ হয়ে উঠুক আশ্রয়ের নামান্তর। আবিশ্ব, আদরে থাকুক মায়েরা। আর পৃথিবীর সব মায়েদের ভালো থাকার ভিতর আমি যেন তোমাকেই খুঁজে চলি, খুঁজে পাই, মা গো...
ইতি,
তোমার আদুরে-অবাধ্য মেয়ে