প্রিয়জনেষু মা, আমার জীবনগাছটাকে জলের জায়গায় রক্ত সিঁচে বাঁচিয়ে রেখেছো তুমিই

Mother's Day 2023: কী নেবে বললেই আমার মা বলেন, “দু'হাজার টাকা দে।" আজব ভদ্রমহিলা!

প্রিয়জনেষু মা,

মাকে আমি ভালোবাসি না।

এই অভিযোগ সারাটা জীবনের। সাড়ে ছাব্বিশটা বছর ধরে এই একই অভিযোগ শুনে শুনে মাথার অর্ধেক চুল উঠে গেছে, চামড়ায় খানিক ভাঁজও পড়েছে বটে। তবুও এ অভিযোগ পাল্টায়নি। আজ অভিযোগকারিনীর জন্মদিন। যেহেতু আমি সব সংখ্যা ভুলে যাই, সকালবেলা ফেসবুকের দৌলতে মনে পড়ল। মাকে জিজ্ঞেস করলাম, "মা, আজ তোমার জন্মদিন, কী খাবে বলো, আমি নিয়ে আসব।" আমি যাকে ভালোবাসি না, সেই অভিযোগকারিনী বললেন, "ভূতের আবার জন্মদিন!"

মায়ের জন্মদিন উদযাপন করা হয় না। মায়ের সঙ্গে আমার আদতেই অনেক ঝগড়া, অনেক মন কষাকষি, অনেক অমিল। মায়ের অনর্গল অবান্তর কথা বলে যাওয়া আমার ভালোলাগে না। মায়ের সব কাজে হুড়মুড় করা এবং কাজটাকে ঘেঁটে দেওয়া আমার ভালোলাগে না। মায়ের সবার সামনে পারিবারিক ঝগড়া নিয়ে আলোচনা করাও আমার ভালোলাগে না। মা আমার জন্য যেসব উজ্জ্বল রঙের চকচকে জামাকাপড় কেনে, সেসব আমার ভালোলাগে না। মা যেসব ভুলভাল টোটকার ভিডিও দেখে ইউটিউবে বা যে সমস্ত চটুল বাংলা গান শোনে– সেইসবও আমার ভালোলাগে না। আমিও জানি আমার কী কী ব্যাপার মায়ের ভালোলাগে না। আমার চুলে তেল না দেওয়া, কোনও কায়িক পরিশ্রম না করা, আমার পুরুষ বন্ধুসঙ্গ, আমার রাতে দেরি করে বাড়ি ফেরা, আমার অবাধ্যতা- মায়ের ভালোলাগে না। মায়ের সঙ্গে আমার প্রত্যেক দ্বিতীয় কথায় খিটিমিটি লাগে।

এতসব খারাপ লাগা নিয়েও সাড়ে ছাব্বিশটা বছর ভদ্রমহিলা সংসার করছেন আমার মতো মেয়ের সঙ্গে! সকালবেলা বিছানায় বসে বাসিমুখে চা খাওয়ার অভ্যেসটা তিনিই প্রশ্রয়ে বজায় রাখার জোর দিয়েছেন। জ্বরে বেঘোর হয়ে পড়ে থাকার সময় বা ব্যথায়, হাত–পা টিপেছেন। রান্না করতে না চাওয়া আমাকে অখাদ্য কুখাদ্য রান্না করে খাইয়ে যাচ্ছেন এতগুলো বছর ধরে। বাড়ির বাইরে থাকলে প্রত্যেক ১০ মিনিটে ফোন করে করে এমন জ্বালিয়েছেন যে আমি রেগে ফোন বন্ধ করে দিয়েছি। তুমুল অশান্তি করেছেন, চিৎকার করে কুকথা বলেছেন। ফোন না নিয়ে বাড়ি থেকে চলে গিয়ে মাসির বাড়িতে ঘাপটি মেরে বসে থেকেছেন, সেখানে গিয়ে তাঁকে সেধে নিয়ে আসতে হয়েছে। ঝগড়া হলেই ব্যাগ গুছিয়ে বা কিছুমাত্র না নিয়েই চলে গ্যাছেন নানা অস্থায়ী ঘাপটি মারার আশ্রয়ে। দিনে সাতাশবার সাতাশটা জিনিস হারিয়ে আমার আর বাবার সময় আর শান্তির শ্রাদ্ধশান্তি করেছেন। আরও ইত্যাদি প্রভৃতি হ্যানা ত্যানা…

কিন্তু, ছেড়ে দেননি।

একদিনের জন্যও, এক মুহূর্তের জন্যও, নিজের দায়িত্ব ত্যাগ করেননি। অসুস্থ থেকেও জানতে দেননি কোথায় কষ্ট হচ্ছে। একেবারে তূরীয় অবস্থায় পৌঁছনোর পর ব্যবস্থা নেওয়া গেছে। হাজার বার মুখঝামটা দিয়েও যখন দেখেছেন না খেয়ে রয়েছি, অখাদ্য কুখাদ্য হলেও রান্না করে মুখের সামনে এসে হাজির করেছেন এবং বুঝিয়ে দিয়েছেন, দুনিয়ায় কেউ যদি দায়িত্ব নিয়ে থাকে, সেটা একমাত্র তিনিই। আমিই নানা কাজের খুঁত ধরে কথা শোনাই এখনও, কিন্তু কথা শুনেও, “আমি আর কিছু করতে পারব না, নিজে করে নে” বলেও আমাকে বাধ্য করেননি কাজ নিজে করতে। আমার যাবতীয় সাংসারিক কাজ করতে না পারার জন্য আমার কাকিমা জেঠিমারা বারবার মাকে দায়ী করেন। শুধু আমি এবং একমাত্র আমিই জানি যে, মা কী করেছেন, কেন করেছেন, করে যাচ্ছেন।

কী নেবে বললেই আমার মা বলেন, “দু'হাজার টাকা দে।" আজব ভদ্রমহিলা! দু'হাজারই কেন, তার জবাব চাইলে বলেন, “আমার দরকার।" তারপরে দেখা যায় ওই টাকার সিকিভাগেরও কম দিয়ে নিজের জন্য একখানা আটপৌরে শাড়ি কিনেছেন আর বাকি টাকাটা দিয়ে আমি জীবনেও অঙ্গে ঠেকাব না সেরকম একটা উজ্জ্বল রঙের চকচকে ঝাকানাকা শাড়ি কিনেছেন আমার জন্য। এবং যেহেতু আমার জন্য কেনা তাই আমাকে জোরজবরদস্তি একবার অন্তত পরতেই হবে। গজগজ গজগজ করতে আমিও সেই শাড়ি পরব এবং তিনি কাঁপা আবছা ছবি তুলে মাসিকে পাঠাবেন আমাকে কত ভালো লাগছে দেখাতে। যদিও আমাকে সেইসব শাড়িতে দেখতে মোটেও ভালো লাগে না। আমাকে দিনরাত বলেন আমি বুড়োটে বলে আমাকে কেউ বিয়ে করবে না। আমি বিয়ে করে সংসার করলেই তিনি শান্তিতে বাড়িময় চিৎকার করে জিনিসপত্র ছড়িয়ে দাপিয়ে অবসর ভোগ করতে পারবেন বলেই ওঁর ধারণা (কী বলব)!

অথচ, তিনিই সেই মানুষটা যিনি আদতেই আমার জীবনগাছটাকে জলের জায়গায় রক্ত সিঁচে বাঁচিয়ে রেখেছেন। সারাজীবন ধরে ওঁকে শুধু খেটে যেতে দেখেছি। তাই এখন মাঝেমাঝে তিনি কাজকর্ম ছড়িয়ে ফেললে নিজে গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করি। কতটা পেরে উঠি, তিনিই জানেন!

মাকে ‘ধন্যবাদ’ বলা হয় না রোজ রোজ, ঘুম থেকে উঠে বা ঘুমোতে যাওয়ার আগে। মাকে বলতে চেয়ে যেসব কথা কোনওদিন বলতে পারিনি, সেসব কথা মনের মধ্যে চেপে রাখার অভিমানে মায়ের সঙ্গে কথা-অন্তরঙ্গতা অনেক কমে এসেছে। মা কোথাও বেরোলে এখনও গালে ‘পাপ্পি’ খেতে চাওয়াটাকে আমার আদিখ্যেতা মনে করার অভ্যেস আমার দৈন্য। ওই একজনই আছেন, যিনি নিজে ক্ষয়ে যেতে যেতে আমাকে গড়ে দিচ্ছেন। ওই একজনই আছেন, যিনি আমাকে অধিকার করেন, ‘আমার ঝিলিক’ – বলার জোর, দাপটটুকু রাখেন।

শুভ জন্মদিন মা। শুভ জন্মদিন। আমার জীবনে বড় বেশি কিছু করার আশা নেই। তবু আমি যেন এইটুকু করতে পারি যে, যতবার তুমি আমার কাছে দু'হাজার টাকা চাইবে, আমি যেন ততবার তোমাকে খালি হাতে না ফেরাই। তোমাকে যেন তোমার দাবির ওই দুটো হাজার টাকা সবসময় দিতে পারি। তোমার সুস্থতা কামনা করি। তোমার সমস্ত অপ্রাপ্তি ভুলিয়ে দেওয়ার ক্ষমতাটুকু অর্জন করতে পারি, এই আশীর্বাদ রেখো। তুমি যখন জানতে পেরেছিলে আমি লিখি, বলেছিলে, “কই আমার জন্য তো কিছু লিখলি না!” তোমার জন্য দুটোমাত্র লাইন ছাড়া সাড়ে ছাব্বিশটা বছরে আমি আর কিচ্ছুটি লিখে উঠতে পারলাম না!
আমাদের সংসারের অন্নপূর্ণা, লক্ষ্মী, কালী, চামুণ্ডা, দুর্গতিনাশিনী, ভালো থেকো, ভালো থেকো। তোমার আয়ু অক্ষয় হোক। তোমার শান্তি পূর্ণ হোক।

আর, আমাকে ছেড়ো না।

 

                                                                                                                                                                                                                             ইতি,

তোমার অলক্ষ্মী মেয়ে

More Articles