প্রিয়জনেষু মা, ২৩ বছর আগে চলে যাওয়া তোমার সঙ্গে এভাবেই তো কথা বলি...

Mother's Day 2023 - "শাড়ি বদলে চুড়িদার পরে নাও" আমি কোনওদিন এ কথা বলিনি তোমাকে। কেন বললাম না মা?

MM

প্রিয়জনেষু মা,

গ্রীষ্ম এসে গেল। রিমলিটা কিছুতেই গ্রীষ্ম বলবে না। মুখ টিপে হেসে বলে, "মা গ্রীষ্ম না, সামার।" ইচ্ছে করে ইংরেজি বলবে। আমি তখন ভুরু কুঁচকে বলব, "এত ইংরেজিতে ফরফর করিস কেন রে? বাংলায় বলতে কী হয়?"

"ইংরেজিতে বললেই বা কী হয়?", রিমলি আমার দিকে তাকিয়ে দুষ্টু মুখ করে ভুরু নাচাবে।

আমি তখন হো হো করে হেসে উঠব। নরম গলায় বলব , "তুই কি বোকা? বোকা না হলে অন্য ভাষায় কেউ মা’র সঙ্গে কথা বলে?"

রিমলি বলবে, "আমি একদম বোকা নই। যে কোনও ভাষায় সামারের গরমটা একই থাকবে।"

"মোটেও না, গ্রীষ্ম বললে আমি নিউইয়র্কে বসেও বৈশাখ খুঁজে পাব। আর সামার..."

সব কথা থামিয়ে বারো বছরের রিমলি তখন আমার কোমর জড়িয়ে ধরবে। আদুরে গলায়, "তাহলে দুটোই। অল্প বৈশাখ। আর অনেকটা সামার", বলেই দৌড়ে দোতলায় উঠে যাবে। আমি ক্ষেপে যাব। খানিকক্ষণ ওইটুকু মেয়েকে চিৎকার করে "তবে রে" বলে তাড়া করব। তারপর ওপরের ঘরে গিয়ে কিছুক্ষণ "পিলো-ফাইট" চলবে। রিমলি আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। আমি বলব, "ওরে বাবা মরে গেলাম, বাঁচাও।" অবশেষে রুকু এসে আমাকে উদ্ধার করবে। দিদিকে সরিয়ে বলবে, "মাকে ছাড়। ছাড় বলছি!" দশ বছর হলে কী হবে, জানো মা, চামড়ার বল দিয়ে খেলতে-খেলতে রুকুর কব্জিতে বেশ জোর হয়েছে। এক হাতে আমাকে টেনে অন্য হাতে দিদিকে সরিয়ে দেবে এমন। ইচ্ছে করে ইংরেজিতে কথা বলা, আমার অভিযোগ, ধমক, বালিশে-বালিশে যুদ্ধ, রিমলির কাছে আমার হার মেনে "মরে গেলাম" বলা, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে রুকুর মাকে উদ্ধার করা, সবটাই ভাই বোন খুব উপভোগ করে। ঠিক যেন ওদের ‘স্কুল প্লে’-র মতো।

ছবি সৌজন্যে- পত্রপ্রেরক

রুকু এরপর আমার হাতে একটা ব্যাডমিন্টন র‍্যাকেট ধরিয়ে বলবে, "চলো, খেলব। স্নিকার পরো।" আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করব, "এখন খেলব? রান্না কে করবে?"

শাসন করার গলায় ও বলবে, "তুমি সিক্স পয়েন্ট পেয়ে জিতলে বাবাকে রেস্টুরেন্টে নিয়ে যেতে বলব।" আমি তখন ঝুঁকে স্নিকারের ফিতে গিঁট দিতে দিতে বলব, "মাদার্স ডে'র দিন রেস্তোরাঁয় তো প্রি-বুকিং করতে হবে।"

রুকু বিজ্ঞের মতো ঘাড় নাড়িয়ে বলবে, "বুকিং করতে হবে না। কাম অন! চলো চলো!"

তুমি বেরনোর সময় মা দুর্গাকে প্রণাম করতে বলতে। মনে আছে মা? এমন অভ্যেস করিয়েছ, ছেলের সঙ্গে ব্যাকইয়ার্ডে খেলতে বেরোলেও প্রণাম ঠুকবই! রুকুর সঙ্গে খেলতে যাওয়ার সময় ঠাকুরকে ফিসফিসিয়ে বলে যাই , "আমাকে হারিয়ে দিও ঠাকুর।" এই খেলার সময় তোমার কথা খুব মনে পড়ে। আমিও যখন রুকুর মতো তোমার হাত ধরে খেলতে ডাকতাম, তুমি বলতে, "ধ্যাত! শাড়ি পরে খেলা যায় নাকি বোকা?" ছোট মামা একবার বলেছিল তুমি নাকি ছোটবেলায় প্রচুর খেলাধুলো করতে। গাছে চড়তে। অথচ "শাড়ি বদলে চুড়িদার পরে নাও" আমি কোনওদিন এ কথা বলিনি তোমাকে। কেন বললাম না মা? বলাই হলো না। তুমি খেলতে বেরোলে আমি জানি, তুমিও ঠাকুরকে প্রণাম ঠুকে বলে যেতে, "আমাকে হারিয়ে দিও ঠাকুর। রিমঝিমটা জিতে গেলে এক গাল হাসি দেয়, আর হেরে গেলেই মুখ থমথমে। চোখ ছলছল।"

আজ অবশ্য রুকু হেরে যাবে। ইচ্ছে করে। আমি সিক্স পয়েন্ট পাব। ঘরে ফিরে দেখব বিশ্ব একটা কেক বেক করেছে। আর রিমলি চিজ টপড কাবাব গ্রিল করছে। রুকু অমনি বিশ্বকে জড়িয়ে ধরে বলবে , "ইয়ে! ড্যাডি'জ কুকিং! বলেছিলাম না মা, এই রেস্টুরেন্টে বুকিং লাগবে না।" রিমলি তখন কোমরে হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করবে, "আমি রান্না করিনি?" রুকু মিটিমিটি হাসবে। বলবে, "তুই কিস্যু পারিস না!" ব্যস! আবার ভাই বোনের মারপিট শুরু! রিমলি তখন আমার সুরে বলে উঠবে, "ওরে বাবা মরে গেলাম, বাঁচাও!"

আমার মাদার্স ডে- মা। আমার বিশ্ব। এখানেই শেষ করছি। আবার একদিন লিখব। যেমন মনে মনে লিখি। তেইশ বছর আগে চলে যাওয়া তোমার শরীর ও মনের সঙ্গে এভাবেই কথা বলি, মাঝে মাঝেই।

 

- ইতি ‘আমি’

More Articles