"গোটা দেশকে টুপি পরিয়েছে ও", আদানি ইস্যুতে রণংদেহী মহুয়া মৈত্র, আদৌ কি সঠিক সেই বক্তব্য?

Mahua Moitra Slams Adani Modi Relation : এর আগেও মহুয়া মৈত্র সংসদে বেশ উত্তপ্ত ভঙ্গিতে ভাষণ দিয়েছেন। কিন্তু মোদি-আদানি সম্পর্ক নিয়ে যে প্রশ্ন তুলেছেন, তা সত্যি?

“আজ সংসদে দাঁড়িয়ে এক ব্যক্তির ব্যাপারে আলোচনা করব। তাঁর নাম শুরু হয় ‘এ’ দিয়ে, শেষ হয় ‘আই’ দিয়ে। না, তিনি আদবানি নন। এই বক্তৃতার প্রয়োজনে তাঁর নাম দেওয়া যাক ‘মিস্টার এ’। আর তাঁর সংস্থার নাম এ কোম্পানি… এই ব্যক্তিটি গোটা দেশকে টুপি পরিয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, এই ব্যক্তি আপনাকেও টুপি পরিয়েছে।”

সংসদের অধিবেশন কক্ষে দাঁড়িয়ে নিজের বক্তব্য দেওয়ার সময় ঠিক এমনভাবেই আক্রমণ শানানোর কাজটি শুরু করেছিলেন তৃণমূল কংগ্রেস সাংসদ মহুয়া মৈত্র। নাম না করলেও, তাঁর এই বক্তব্যের কাঠগড়ায় কে ছিলেন, তা নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না। ‘মিস্টার এ’ আর কেউ নন, খোদ গৌতম আদানি। আর তাঁর আদানি গ্রুপ, আদানি এন্টারপ্রাইজই মহুয়ার ভাষায় হয়ে গিয়েছে ‘এ কোম্পানি’। নামটির সঙ্গে কুখ্যাত মাফিয়া দাউদ ইব্রাহিমের ‘ডি কোম্পানি’-র ছোঁয়া রয়েছে কি? রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতামত সেটাই। দেশের শত্রু হিসেবে অনেক আগেই দাউদ এবং তাঁর সংস্থাকে চিহ্নিত করা হয়েছে। সেই পন্থাই বাছলেন তৃণমূল সাংসদ মহুয়া।

বিগত কয়েক সপ্তাহ ধরে গোটা দেশের রাজনীতি, ব্যবসা, অর্থনীতির আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে একজনই। গৌতম আদানি এবং তাঁর আদানি এন্টারপ্রাইজ। জানুয়ারির শেষের দিকে আমেরিকান সংগঠন ‘হিন্ডেনবার্গ’-এর রিপোর্টে রীতিমতো ধস নেমেছে আদানির শেয়ারে। সেই বিস্তারিত গবেষণায় বলা হয়েছে, কর্পোরেট ইতিহাসের সবচেয়ে বড় জালিয়াতির কাজটি করছে আদানি গোষ্ঠী। কর ফাঁকি দিয়ে, ভুয়ো কোম্পানি খুলে, জালিয়াতি করেই শেয়ারের দাম হু হু করে বাড়িয়েছে আদানি। হিন্ডেনবার্গের সেই দীর্ঘ রিপোর্টের পরই শুরু হয় বিতর্কের ঝড়। বিশ্বের তৃতীয় ধনী ব্যক্তি থেকে রাতারাতি সরে যান গৌতম আদানি। চোখের পলকে কয়েক কোটি টাকা শেয়ার হাওয়া হয়ে যায়। কেবল তাই নয়, আদানির পেছনে লগ্নি করার জন্য এলআইসি, এসবিআইয়ের শেয়ারও পড়ে যায়।

আরও পড়ুন : পাপ্পু আসলে কেন্দ্রীয় সরকার, যে ভাবে অঙ্ক কষে প্রমাণ করলেন মহুয়া মৈত্র

যেহেতু কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন খোদ গৌতম আদানি, তাই ব্যাপারটি রাজনৈতিক দিকে মোড় নিতেও বেশি দেরি হয়নি। হিন্ডেনবার্গের রিপোর্টের পর ‘দেশাত্মবোধের ধোঁয়া’ তুলে পাল্টা আক্রমণ করে আদানি গোষ্ঠী। সেখানে অবশ্য যুক্তির থেকে বেশি ছিল ‘ভারতের ওপর চক্রান্ত’-এর তত্ত্ব। কিন্তু ব্যাপার হল, সার্বিকভাবে ভারতের অন্যান্য শেয়ারগুলোর দাম কিন্তু পড়েনি। একমাত্র আদানি এবং আদানির সঙ্গে যুক্ত অন্যান্য সংস্থার শেয়ার পড়েছে। সেই সূত্র ধরেই উত্তাল হল সংসদ। আর সেই আগুন ধরালেন খোদ কৃষ্ণনগরের সাংসদ মহুয়া মৈত্র।

ঠিক কী বলেছেন তিনি? বিজেপি নেতাদের বক্তব্য, সংসদে দাঁড়িয়ে অকথা, কুকথা বলেছেন তিনি। অসংসদীয় আচরণ করেছেন। সেই বিতর্ক একটু সরিয়ে রেখে মহুয়া মৈত্রের বক্তব্যের কয়েকটা পয়েন্ট একটু দেখে নেওয়া যাক। কেবল আদানি নয়, মহুয়া বক্তব্য শুরু করেছেন বেশকিছু বিশেষ নাম দিয়ে। তাঁর বক্তব্য ছিল, “যে কোনও কারণেই হোক, কিছু শব্দ ব্যবহার করার আগে আমাদের কয়েকবার ভাবতে বাধ্য করা হয়। আমরা বলতে পারব না ‘চিন’-এর কথা, বলতে পারব না ‘পেগাসাস’। আমরা ‘বিবিসি’, ‘মোরবি’, ‘রাফায়েল’ বলতে পারব না; কখনও কখনও ‘মোদিজি’ও বলতে পারি না।” এই নামগুলির সঙ্গে জড়িয়ে আছে বর্তমান কেন্দ্রীয় শাসক দল অর্থাৎ বিজেপি। এরপরই মহুয়া মৈত্র চলে আসেন আদানি ইস্যুতে।

সংসদে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, “এই মুহূর্তে দেশের সবচেয়ে বিখ্যাত মানুষের সম্পর্কে কিছু কথা বলতে চাই। দুর্ভাগ্যবশত, তিনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও নন। বক্তব্যের সুবিধার জন্য ধরে নিলাম, তাঁর নাম মিস্টার এ (পড়ুন, আদানি)। আমি চাই, সত্যিকারের খেটে উপার্জন করা মেহনতি সংস্থাগুলি দেশের মুখ উজ্জ্বল করুক। এরকম সংস্থাগুলি নয়। এই লোকটি গোটা দেশকে টুপি পরিয়েছে। এই ‘এ কোম্পানি’র (পড়ুন, আদানি এন্টারপ্রাইজ) সম্পত্তি যে পরিমাণে বেড়েছে, সেটা অস্বাভাবিক। এমনকী, গুগল, মাইক্রোসফট, অ্যামাজনও এমন লাভ করেনি। ভারতের বিজয়পতাকা কেবল একজন ব্যক্তির জন্য কখনই টিকে থাকে না। গোটা দেশ, গোটা শিল্প ব্যবস্থার জন্যই টিকে আছে। এই লোকটি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকেও টুপি পরিয়েছে। তাঁর সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে যাতায়াতও করেছেন। তিনি গোটা বিশ্বের সামনে এমন ভাব দেখিয়েছেন, যেন ভারতের প্রধানমন্ত্রীর রিমোট কন্ট্রোল তাঁর হাতে রয়েছে। তাঁকে কিছু বলা মানে ভারতের প্রধানমন্ত্রীকেও বলা।”

আরও পড়ুন : আদানিকে পথে বসাচ্ছে ‘নষ্টের গোড়া’ বামপন্থীরাই! মোদি-ঘনিষ্ঠের পাশে দাঁড়িয়ে যা বলছে আরএসএস

এবার এই বক্তব্যের দিকে একটু আসা যাক। এর আগেও মহুয়া মৈত্র সংসদে বেশ উত্তপ্ত ভঙ্গিতে ভাষণ দিয়েছেন। তথ্য ও যুক্তির মোড়কে পরিবেশন করেছেন তাঁর বক্তব্য। মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে ভারতের অর্থনীতি নিয়েও একই ভঙ্গিতে সংসদে বলেন মহুয়া। তাঁর প্রতিটা ভাষণই ভাইরাল হয়। গৌতম আদানিকে নিয়ে এই বিশেষ বক্তৃতারও গুরুত্ব রয়েছে। কিন্তু মোদি-আদানি সম্পর্ক নিয়ে যে প্রশ্ন তুলেছেন তিনি, তা কি সত্যি?

অবশ্য কেবল মহুয়া মৈত্র একা নন। রাজ্যসভার অধিবেশনে সম্প্রতি একই প্রশ্ন তুলেছেন রাহুল গান্ধীও। রাজ্যসভায় দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য চলাকালীনই তিনি বেশকিছু প্রসঙ্গ তোলেন। বেশকিছু ছবিও সামনে নিয়ে আসসেন। সেখানে রাহুল গান্ধীরও মূল বক্তব্য ছিল, নরেন্দ্র মোদির হাত ধরেই গৌতম আদানির এই উত্থান। তাঁরা দুজনে একসঙ্গে যাতায়াতও করতেন, সেই ছবি ছবি তুলে এনেছেন বিরোধীরা।

মহুয়া মৈত্র, রাহুল গান্ধীদের বক্তব্যকে একেবারে ফেলে দেওয়াও যাবে না। ২০১৪ সালে বিজেপি কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পর বারবার গৌতম আদানি আর নরেন্দ্র মোদির ভালো সম্পর্কের কথা সামনে এসেছে। বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে আদানি গোষ্ঠীকে সাহায্য করেছেন মোদি, দাবি বিরোধীদের। পরিসংখ্যান, আদানির জীবন, কাজ ইত্যাদি দেখলে সেই দাবির সমর্থনে বেশকিছু যুক্তিও পাওয়া যাবে। একটু খুঁটিয়ে দেখলেই দেখা যাবে, ২০০৩ সাল থেকে গৌতম আদানির উত্থানের শুরু। তার আগে তাঁর নাম কজন শুনেছেন, সে নিয়ে অনেকেরই সন্দেহ আছে। গুজরাতের এই ব্যবসায়ী বরাবরের মোদি সমর্থক ছিলেন। বিশেষ করে, গুজরাত দাঙ্গার পর যখন অধিকাংশ শিল্পগোষ্ঠী মোদির পাশ থেকে সরে যায়, তখন তাঁর সঙ্গে দাঁড়িয়েছিলেন গৌতম আদানি।

আরও পড়ুন : আদানির পতনে আসলে লাভ হিন্ডেনবার্গের! কেন পশ্চিমী গবেষণাই আজও মান্যতা পায় দেশে?

সেই সময়ে গুজরাতের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির হাত ধরে একের পর এক শিল্পপতিকে নিজের দিকে আনার চেষ্টা শুরু করে আদানিরা। অর্থনীতি ও ব্যবসার জগতের বিশেষজ্ঞরা প্রমাণস্বরূপ দেখিয়েছেন আদানিদের ব্যবসার পরিমাণ। ২০০০ সালের একেবারে শুরুর সময় যে অঙ্কটি ছিল মাত্র ৩০০০ কোটি টাকা, প্রায় ১০ বছর পর সেটাই হয়ে যায় ২৫,০০০ কোটি টাকা! তারপর আসে ২০১৪ সাল। বিজেপি কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসে, প্রধানমন্ত্রী হন নরেন্দ্র মোদি। তারপর কার্যত রকেটের স্পিডে ওপরে উঠতে থাকেন গৌতম আদানি। ২০২২-এর মধ্যেই তাঁর সম্পত্তি হয়ে দাঁড়ায় অন্তত সাড়ে পাঁচ লক্ষ কোটি টাকা!

মূলত ২০১৪-র পর থেকে আদানির দহরম মহরম আরও বেড়ে যায়। খেয়াল করলে দেখবেন, প্রধানমন্ত্রী মোদির বিদেশ সফরের সঙ্গে বারবার যুক্ত হয়েছেন গৌতম আদানি। ইজরায়েল, অস্ট্রেলিয়া, শ্রীলঙ্কা থেকে বাংলাদেশ – প্রতিটা জায়গায় যখনই নরেন্দ্র মোদি গিয়েছেন, তার ঠিক পরপরই সেখানে শিল্প তৈরির কাজে লেগে পড়েছেন আদানি। এই তালিকায় আর কেউ নেই। বাংলাদেশের সেই বিদ্যুৎ বিক্রির চুক্তির জন্য ইতিমধ্যেই সেখানে শুরু হয়েছে বিক্ষোভ। খোদ স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া আদানি গোষ্ঠীকে প্রায় ১০০ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছে বলে দাবি বিরোধীদের। সেইসঙ্গে প্রায় ৬টি বিমানবন্দরের দায়িত্ব দেওয়া হয় আদানিকে। এই সমস্ত কাজই হয়েছে ২০১৪-র পর। বিরোধীদের দাবি, সবটাই হয়েছে খোদ প্রধানমন্ত্রীর হাত মাথায় থাকায়।

খেয়াল করে দেখুন, আদানি ইস্যু নিয়ে এখনও পর্যন্ত বিজেপি কিংবা নরেন্দ্র মোদি খুব স্পষ্ট করে কিছু বলেননি। বারবার এই প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়েছেন কেন্দ্রের নেতারা। নয়তো প্রসঙ্গ এড়িয়ে অন্য দিকে চলে গিয়েছেন। এসবিআই, এলআইসি-র শেয়ার পতন নিয়েও স্পিকটি নট বিজেপি। উল্টে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ বা আরএসএস আসরে নেমে আদানির পাশেই দাঁড়িয়েছে। আরএসএসের বক্তব্য, আদানির সঙ্গে অন্যায় করা হচ্ছে। এসব বামপন্থীদের চক্রান্ত! ঘুরেফিরে কেন্দ্র হোক বা রাজ্য সরকার, ‘চক্রান্ত তত্ত্ব’ ছেড়ে বেরোতে পারছেন না কেউ। মহুয়া মৈত্র কিংবা রাহুল গান্ধীর বক্তব্যকে অস্বীকার কি করা যাবে? দেশাত্মবোধের জিগির না তুলে উপযুক্ত যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করলেই তো সব মিটে যায়। আদানি গোষ্ঠী কি এখন মোদির দিকেই তাকিয়ে আছে? নতুন কোনও অঙ্ক চলছে ভোটের বাজারে?

More Articles