মৃণাল সেনের ছবিতে জীবন্ত হয়ে উঠেছিল মধ্যবিত্তের রান্নাঘর

মনে পড়ে সেই দোকানের বিবস্ত্র ম্যানিকুইন, আমাদের প্রজন্মের রাগ ও ঘৃণা কীভাবে মৃণাল সেন ছেপে দিয়েছেন ছায়াছবিতে।

শক্তি চট্টোপাধ্যায় যাকে বলেছিলেন, 'অলৌকিক পশ্চাৎভ্রমণ', সেরকমভাবে পিছন ফিরে তাকালে দেখতে পাই, 'কলকাতা ৭১'-এর ম্যাটিনি শো-র শেষে মেট্রো সিনেমার দোতলায় যাওয়ার সিঁড়িতে মৃণাল সেনকে ঘিরে ধরেছে আবেগে থরথর যুবাদল। 'ইন্টারভিউ' থেকে 'কোরাস'- যখনই রাস্তায় হাঁটতাম, মনে হত, অদৃশ্য সহযাত্রী মৃণাল সেন। খুব আশ্চর্যজনকভাবে তিনি আমাদের যৌবনের অভিভাবক ছিলেন। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যান্টিনে বার্লিনের পাল্টা ফোরামের উলরিশ গ্রেগরকে নিয়ে এসে বক্তৃতা দেওয়াচ্ছেন, বা মতিলাল নেহরু রোডের প্রশস্ত বসার ঘরে একইসঙ্গে কথা বলে চলেছেন আলোকচিত্রী কে. কে মহাজন ও এক অখ্যাত মফসসলি তরুণের সঙ্গে। দেশপ্রিয় পার্কের উল্টোদিকের ছোট এই বাড়িটা ছিল আমাদের সিনেমার শান্তিনিকেতন। গোদার কী করছেন বা ভেনিসে সেবার কী হল- এসব মৃণালদা আমাদের বলতেন, কেননা, তখন গুগল ছিল না। মৃণাল সেন সাতের দশকে বামপন্থী যুবকদের মৃণাল সমিতি গড়ে তুলছেন কলকাতার রাস্তাঘাটে। তিনি সর্বজনীন মৃণালদা। তাঁর আড্ডায় না থাকলে সিনেমার 'হাসিখুশি', সিনেমার 'বর্ণপরিচয়' রপ্ত করা যায় না। কীভাবে যে মৃণালদা কলকাতার যৌবনের নির্বিকল্প রাজদূত হয়ে উঠেছিলেন!

 

 

অনেক সময় ভাঙনটাই বড় হয়ে ওঠে। সুদূর ফ্রান্সের সোরবোন থেকে দক্ষিণ শহরতলির যাদবপুর পর্যন্ত সবাই তখন ভাবছে, আমাদের বয়স কুড়ি, আমরাই পাল্টে দেব দুনিয়াটাকে। 'তুমি কোন ভাঙনের পথে এলে'- এরকমই আমাদের মনে হয়েছিল সত্তরের শুরুতে 'ইন্টারভিউ' দেখে। মনে পড়ে সেই দোকানের বিবস্ত্র ম্যানিকুইন, আমাদের প্রজন্মের রাগ ও ঘৃণা কীভাবে মৃণাল সেন ছেপে দিয়েছেন ছায়াছবিতে। তখন আমাদের শহরের মানচিত্রে পাড়ায় পাড়ায় রক্ত, অবরোধ, আগুন, আমাদের গীতবিতান তছনছ হয়ে যাচ্ছে, আমাদের ঘুম, আমাদের জাগরণ, আমাদের সমাধিফলক ঘিরে তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন গেরিলা সমাবেশ। সেইরকম এক ঝড়ের রাতের অভিসারে আমরা দেখলাম মৃণাল সেনের কর্কশ তর্জনী। আমরা জানলাম, ওই ম্যানিকুইন এক পুতুল। সে ব্যর্থ। রাজনীতি আমাদের বলে দিচ্ছিল, সাম্রাজ্যবাদ কাগজের বাঘ, সিনেমা আমাদের জানাল, নব-উপনিবেশবাদ আপাত-সজ্জিত, কিন্তু অন্তরে শূন্যগর্ভ, ক্ষমতাহীন।

 

 

'মহাপৃথিবী' ছবিতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও গীতা সেন

 

আসলে মৃণাল সেন বলতে আমরা যা বুঝি, অন্তত তার মূল অবয়ব যা হয়ে গেছে, তা হচ্ছে শহর কলকাতা ও মধ্যবিত্তর তীব্র আবেগ ও রাগের প্রতিলিপি। একটু ভাবলে মনে হয়, সেই কলকাতা তো পালটে গেছে। সাতের দশকের সেই রূপকথা নিয়ে এখন করে খাওয়ার গল্প তৈরি হতে পারে নতুন করে, কিন্তু আর বাঁদিকের মুঠো শক্ত হয়ে ওঠে না আমাদের। আমরা সবকিছু মেনে নিচ্ছি। এবং আমরা প্রতিবাদ করার বদলে সহাবস্থানে অভ্যস্ত হয়ে উঠছি। এর মধ্যে মৃণাল সেন কোথায়? এমনকী, মৃণাল সেন নিজেও এই বদল বুঝতে পারছিলেন। দেখা যাবে, সাতের দশক শেষ হওয়ার পর থেকে, ১৯৮০ থেকে যে ছবিগুলো মৃণাল তৈরি করছিলেন, 'একদিন প্রতিদিন', 'চালচিত্র', 'খারিজ', 'মহাপৃথিবী', 'অন্তরীণ'- এসব ছবিতে মৃণাল সেন ক্রমশ একা হয়ে যাচ্ছিলেন। তাঁর যে লড়াই ভিয়েতনামের বাইরে ছিল, 'মহাপৃথিবী'-তে দেখলাম, মশারির ভেতর বার্লিনের প্রাচীর ধসে পড়ছে। তিনি বুঝতে পারছিলেন, 'কোলাহল তো বারণ হল, এবার কথা কানে কানে'। আসলে এই যে বামপন্থার স্থিতাবস্থা এল, ক্ষমতায় এল অনড়, অচল নারায়ণশিলার মতো বামফ্রন্ট সরকার, মৃণাল সেন বুঝতে পারছিলেন, তাঁর লড়াই করার পরিসরটা কমে এসেছে। তিনি যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেই স্বপ্ন এখন অনেকটা ফিকে। শহিদ মিনার তখন একটা প্রতিষ্ঠান। ফলে মৃণাল সেন একা হচ্ছিলেন, এবং ইতিহাসও একা হচ্ছিল। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন মৃণাল সেনের ছবিগুলোকে আমাদের থেকে অনেকটাই দূরে নিয়ে যায়, একথা আজকে আর অস্বীকার করে লাভ নেই। 'ভুবন সোম' বা 'খারিজ'-এর মতো ছবিতে যে অন্তর্তদন্ত মৃণাল চালিয়েছিলেন মধ্যবিত্তর অবস্থান নিয়ে, সেই মধ্যবিত্ত, উদারীকরণের পরে, আর্থিক অবস্থার স্থিতিশীলতা আসার পর অনেকখানি আত্মসমালোচনা ভুলে গেল। এবং আত্মপরিতৃপ্তির পাউডারদীপ্তি তাঁর চোখেমুখে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল। দেখা যাবে, যখন 'আমার ভুবন' করছেন, তখন আর মৃণাল সেন নেই, তাঁকে খুব ক্লান্ত, অবসন্ন লাগছে। মনে রাখতে হবে, তিনি দীর্ঘদিন কলকাতা শহরে বেঁচে ছিলেন, চলচ্চিত্র উৎসবে আসতেন, কোনও কোনও সভাসমিতিতেও আসতেন, কখনও কখনও আমাদের সঙ্গে আড্ডাও দিতেন। কিন্তু তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, তিনি যে পৃথিবী দেখেছিলেন, সেই পৃথিবী, সেই নির্জন আমলকি আর শিল্পীর করতলে নেই। সেই পৃথিবী এখন একরৈখিক। মৃণাল সেনের পৃথিবী পালটে গেছে তখন। সুতরাং, তিনি যে আগুনের বাসিন্দা হিসেবে নিজেকে ভাবছিলেন, 'নীল আকাশের নীচে' থেকে যে শহরকে তিনি দেখে এসেছিলেন, সেই শহরটা ক্রমশ পালটে যাচ্ছিল। এলডোরাডোর বুকের ওপর তিনি শুয়ে পড়ে ছবি তুলতে পারেন, কিন্তু সেই ছবি আর লুই মালকে মিছিল থেকে টেনে আনার মুহূর্তকে পুনরুৎপাদিত করতে পারে না।

 

 

ফলে, আজকের প্রজন্ম সেই মৃণাল সেনকে চিনতে পারে না, যে মিছিল মধ্যবিত্তর প্রতি নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন, এমনকী সত্যজিৎ রায় বা ঋত্বিক ঘটকের তুলনায়ও। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক, ১৯৬০ সাল শুরু হলো 'দেবী' দিয়ে, তারপর পয়লা বৈশাখে মুক্তি পেল 'মেঘে ঢাকা তারা', তারপরেই 'বাইশে শ্রাবণ'। সত্যজিৎ যখন উনিশ শতক বা ঋত্বিক যখন কুমারসম্ভবমের পরিপ্রেক্ষিতে সমকালীন সর্বনাশের কথা ভাবছেন, তখন মৃণালের হাতিয়ার শুধু রান্নাঘর। এই কলকাতা, যেখানে ধোঁয়া ওঠে সকালে, যেখানে আধুনিক সর্বজয়া উনুন জ্বালায় 'ইন্টারভিউ'-তে, সেই কলকাতা পালটে গেছে, সেখানে গ্যাস ওভেন এসে গেছে। সিনেমার এই শহর আর তর্জনী উঁচু করে পালটা সিনেমার কথা বলে না। টালিগঞ্জ অনেক বিধুর, বিষণ্ণ। ফলে, মৃণাল সেন নিজেই প্রায় হারিয়ে যাচ্ছিলেন।

'বাইশে শ্রাবণ' ছবির পোস্টার

 

 

আজকের দর্শক যে তাঁকে ততটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করছে না, আমার মনে হয়, ইতিহাসের এই পালটে যাওয়া, যাকে নগরায়ন বলছি, যাকে 'সোসাইটি অফ স্পেকট্যাকল' বলা অনেক বেশি উচিত, এই যে নিরন্তর দৃশ্যের জন্ম, 'আমরা যাইনি মরে আজও, তবু কেবলই দৃশ্যের জন্ম হয়'; এই যে গুগলসভ্যতা, এই যে মুখপুস্তক, এর মধ্যে মৃণাল সেনের ম্লান, নিম্নমধ্যবিত্ত নাগরিককে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই মৃণাল হারিয়ে যাচ্ছেন।

 

 

কিন্তু আমার মনে হয়, একদিন আমরা তাঁকে বিচার করতে পারব, যখন আমরা দেখব, 'আকাশকুসুম' বা 'ভুবন সোম'-এর মতো ছবির মধ্য দিয়ে আসলে ভারতীয় সিনেমার এক নতুনতর ভাষা খুঁজছিলেন মৃণাল। কেউ খেয়াল করে না, 'ভুবন সোম'-এ যখন বাজরা খেতের মধ্য দিয়ে ক্যামেরা চালাচ্ছিলেন কে. কে মহাজন, সেটা প্রায় 'পথের পাঁচালী'-তে সুব্রত মিত্রর প্রত্যুত্তর। কেউ খেয়াল করে না যে, বিজয় রাঘব রাও যখন 'লাগি লগন পতি সখি সঙ্গ', এই রাগ হংসধ্বনি বাজাচ্ছেন, তখন তা বন্ধু ঋত্বিক ঘটকের প্রত্যুত্তর। এবং মেকিংয়ে যে স্মার্টনেস, যৌন বিদ্যুৎলতা হিসেবে সুহাসিনী মুলে ফুটে উঠছিলেন, তা মৃণাল সেনের নিজের অবদান। কিন্তু এখন রাজনীতির পাণ্ডুলিপিতে অনেক ধুলো জমায় আমরা তাঁকে আপাতভাবে খুঁজে পাচ্ছি না। মনে হয়, কিছু দূর অবকাশ দরকার।

 

 

আর সংরক্ষণ? ঋত্বিক ঘটক সত্যজিৎ রায়ের যে শটটা সবচেয়ে বেশি পছন্দ করতেন, অপু যখন পুকুরে মুখ ধোওয়ার সময় কালপুরুষের ছায়া দেখছে, যা দিয়ে পোস্টার হয়েছিল, তা বাঙালি হারিয়ে ফেলেছে। খালেদ চৌধুরীর করা 'বাড়ি থেকে পালিয়ে'-র ক্রেডিট টাইটেল তারা হারিয়ে ফেলেছে। চিরতরে হারিয়ে গেছে মৃণাল সেনের 'অবশেষে' বা 'পুনশ্চ'-র মতো ছবি, মৃণাল সেন জীবৎকালে বিজ্ঞাপন দিয়েও সেসব ছবি খুঁজে পাননি। এখন মার্টিন স্করসেসিরা দায়িত্ব নিচ্ছেন সত্যজিৎ, ঋত্বিকের সংরক্ষণের, ভারতে এ কাজ করছেন দুঙ্গারপুররা। হয়তো একদিন 'ভুবন সোম'-এ কে. কে মহাজনের কাজ, 'খণ্ডহর'-এর রঙের পূরবীর মতো কাব্যিক চলাচল মানুষ বুঝতে পারবে। তবে এখনও ইতিহাসের সেই স্থিরতর দীপ্তি চোখে পড়ছে না, আজ শতবর্ষের প্রাক্কালে একথাই বলার।

More Articles