'মেঘে ঢাকা তারা'-র শেষ নিয়ে আপত্তি ছিল মৃণাল সেনের
একটা পর্যায়ে মৃণাল সেন যখন বলছেন, "নিজের দিকে ক্যামেরা ঘোরালাম", সেখানে নিজেকেই প্রায় কাটাছেঁড়া করার একটা প্রক্রিয়া শুরু হল।
মৃণাল সেন সবসময়ই আমার খুব পছন্দের চলচ্চিত্রকার। সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণাল-মৃণাল, ওই প্রজন্মের চলচ্চিত্রকারদের মধ্যে তো এই তিনজনের নামই করা হয়। এঁদের মধ্যে মৃণাল সেন কোথায় স্বতন্ত্র বলে আমার মনে হয়, সেটা একটু বলি। চলচ্চিত্রকাররা দর্শকমনকে নাড়া দেন দু'ভাবে। এক হল, বিষয়গত জায়গা থেকে। দ্বিতীয়ত, চলচ্চিত্রের ভাষার নিরিখে। চলচ্চিত্রের ভাষা নিয়ে একজন পরিচালক কী পরীক্ষানিরীক্ষা করছেন, এমন কী ভাষ্য তৈরি করছেন, যা তাঁর একান্তই নিজের, সেটাই তাঁর শৈল্পিক উৎকর্ষের অভিজ্ঞান। লক্ষ করে দেখলে দেখা যাবে, সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণাল- এই তিন মহান চলচ্চিত্র পরিচালকেরই নিজস্ব ঘরানা আছে। তার সঙ্গে অবশ্যই জুড়ে যায় তাঁর রাজনৈতিক দর্শন, সমাজগত বীক্ষা ও দায়বদ্ধতা, সময় ও মানুষকে ধরার চেষ্টা। কিন্তু আমরা যখন আন্তর্জাতিক পরিচালকদের নিয়ে কথা বলি, আব্বাস কিয়েরোস্তামি হোক, মাইকেল হ্যানেকে হোক, বা ইউরোপীয় বা মার্কিন ঘরানার পরিচালক যাঁরা- দেখতে পাই, তাঁদের প্রত্যেকেরই নিজস্ব ভাষা রয়েছে। সেই ভাষার উন্মেষ চলচ্চিত্রকে সামগ্রিকভাবে আরেকটু এগিয়ে নিয়ে যায়। মৃণাল সেনেরও তেমন একটা নিজস্ব চলচ্চিত্রভঙ্গি ছিল, তার সঙ্গে সামাজিক দায়বদ্ধতাও ছিল। দুটো একসঙ্গে জড়িয়ে একটা নতুন ধারা ভারতীয় চলচ্চিত্রে এনেছিল বলে আমার মনে হয়।
যেখানে মৃণাল সেনকে আমার অভিনব লাগে, এই ধারাটার বিবর্তনও ঘটিয়েছিলেন তিনি। প্রথমদিকে একভাবে ছবি বানাতেন, পরের দিকে সেই আঙ্গিকটা পালটে ফেললেন। কারণ তার সামাজিক ও ঐতিহাসিক পাঠগুলো বদলাতে থাকে। শিল্পী যে জীবিত, এটাই তার সর্বোত্তম প্রমাণ। সে সারাক্ষণ তার নিজের মাধ্যমটাকে নিয়ে ভাঙাগড়া চালিয়ে যাচ্ছে, তার সমাজকে দেখার চোখ পাল্টাচ্ছে, ইতিহাসের পাঠ বদলাচ্ছে, মতবাদ পাল্টাচ্ছে- এটাই তো শিল্পীর বেঁচে থাকার মার্গ। তাই একটা পর্যায়ে মৃণাল সেন যখন বলছেন, "নিজের দিকে ক্যামেরা ঘোরালাম", সেখানে নিজেকেই প্রায় কাটাছেঁড়া করার একটা প্রক্রিয়া শুরু হল। অর্থাৎ, যেসময় তিনি 'একদিন প্রতিদিন', 'খারিজ' বা 'আকালের সন্ধানে' বানাচ্ছেন, সেই সময় থেকেই এই বদলটার শুরু। ওঁর প্রথমদিকের ছবি, বলা চলে, অনেকটা ডাইড্যাক্টিক। নিজস্ব একটা ফর্ম ছিল সেই ছবির, নির্দিষ্ট রাজনীতিও ছিল। তখন অনেকগুলো ইনফ্লুয়েন্সও কাজ করেছিল ওঁর, যেমন সোভিয়েত ইউনিয়নের সিনেমার দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত ছিলেন। জিগা ভার্তভের কথা বলতেন। সেই ধাঁচটা পাল্টে ফেললেন পরে।
আমার সঙ্গে ওঁর একটা অদ্ভুত ব্যক্তিগত যোগাযোগ ছিল। সেটা খুবই ইন্টারেস্টিং। বাবা (অরুণ মুখোপাধ্যায়) যেহেতু ওঁর 'পরশুরাম'-এ প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন, সেই সূত্রে মৃণাল সেনের আমাদের বাড়িতে আসা। শেষের দিকে মৃণালদার সঙ্গে আমার অনেক কথা হত ফোনে। আমার নাটক 'তিস্তাপারের বৃত্তান্ত' দেখেছিলেন ২০০০ সালে। তারপর কথাবার্তা বাড়তে শুরু করল। নানা বিষয় নিয়ে কথা হয়েছে। আমার ছবি দেখে তাই নিয়ে কথা বলেছেন, থিয়েটার নিয়েও কথা বলেছেন। রাজনৈতিক বিষয় নিয়েও কথা হয়েছে। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দীর্ঘ কথা হয়েছে মৃণালদার সঙ্গে। সেগুলো আমাকে খুবই ঋদ্ধ করেছে।
একটা খুবই আগ্রহব্যঞ্জক কথা হয়েছিল আমার সঙ্গে, সেটা একটু বলি। ঋত্বিক ঘটকের ছবি নিয়ে ওঁর নিজস্ব কিছু পর্যবেক্ষণ ছিল। 'মেঘে ঢাকা তারা'-র শেষ অংশটা নিয়ে কথা হয়েছিল একবার। সেই বিখ্যাত দৃশ্য, যেখানে নীতার ভূমিকায় সুপ্রিয়া চৌধুরী, শঙ্করের চরিত্রাভিনেতা অনিল চট্টোপাধ্যায়কে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, 'দাদা, আমি যে সত্যি সত্যি বাঁচতে চেয়েছিলাম', পাহাড়ের ওপর ক্যামেরা প্যান করছে- সেই অংশটা নিয়ে ওঁর একটা জোরালো যুক্তি ছিল। উনি বলেছিলেন, শঙ্কর, নীতার ভাই, যে নিজে একজন শিল্পী, সে এসে খবর দেয় নীতাকে, যে নীতার প্রাক্তন প্রেমিক ও নীতার বোনের বিয়ে হয়েছে, ওদের একটা সন্তান হয়েছে, ওরা সুখে আছে। এখন, একজন অনুভূতিপ্রবণ মানুষ, যার সূক্ষ্ম বোধ আছে, সে জানে তার বোন অসুস্থ, তাকে নানা মানসিক সমস্যার জন্য একটা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে রাখা হয়েছে, সে বাড়ি থেকে দূরে আছে- তাকে কি এই খবরটা দেওয়া উচিত ছিল? সে জানে, কেন নীতা এই অবস্থায় এসে পৌঁছেছে, সে একজন শিল্পী মনের মানুষ, সে কেন এই যন্ত্রণার কথা স্মরণ করাবে? শেষের দৃশ্যের কান্না ও চিৎকারের জন্যই কি ওই কথাটা বলালেন ঋত্বিক? এটা মৃণাল সেনের প্রশ্ন ছিল, ওঁর মনে হয়েছিল, চরিত্রের সঙ্গে যায় না এই আচরণটা। এই ক্রিটিকটা ওঁর ছিল।
ওঁর নিজের মতামতও পাল্টেছে। উনি বামপন্থী বলতেন নিজেকে খোলাখুলি। একটা সময় বললেন, 'বামপন্থীরা আমাকে আর নাড়া দেয় না', সম্ভবত বিদেশে। আনন্দবাজার পত্রিকার প্রথম পাতায় সেই উক্তিটা বেরল, খুব শোরগোলও হয়েছিল তাই নিয়ে সেসময়। ফলে ওঁর মনন, আদর্শ, পাঠ পাল্টেছে। সঙ্গে সঙ্গে ছবিও পাল্টে গেছে। ওঁর পাণ্ডিত্য ছিল বহুমাত্রিক। কখন কী বই পড়ছেন, তাই নিয়েও কথা হত আমাদের। মৃণাল সেন নিয়ম করে রাত ন'টার খবর শুনতেন। খুব সচেতন ছিলেন সমাজ ও সময় নিয়ে। এইসব কারণেই ওঁর ছবিরও একটা গভীর প্রভাব আমার ওপর পড়েছে। সাম্প্রতিককালে আমার ছেলেকে আমি 'পদাতিক' দেখালাম। আমার ছেলে নিখিলেশের পনেরো-ষোলো বছর বয়স, সত্যজিৎ রায় ও ঋত্বিক ঘটকের ছবিও ও দেখেছে। 'পদাতিক' ওঁর খুব ভালো লেগেছে। এই প্রজন্মের ছেলে, যে নেটফ্লিক্স দেখছে, যার কাছে বিশ্ব সিনেমা এক্সপোজড, তার কাছেও মৃণাল সেনের আবেদন রয়েছে। আমিও ফিরে ফিরে দেখি ওঁর ছবি। 'আকালের সন্ধানে' দেখলাম কয়েকদিন আগে। ওঁর ক্রাফটের ওপর একটা দক্ষতা তো ছিলই, কিন্তু সিনেমার নিজস্ব ভাষা নির্মাণেও মৃণাল সেন অনন্য।
(কথোপকথনের ভিত্তিতে অনুলিখিত)